বিশেষ প্রতিনিধি::
জামালগঞ্জের হালির হাওরে চার বিঘা জমি চাষ করেছিলেন উপজেলার কামলাবাজ গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আব্দুল মজিদ। প্রতি বছর এই বোরোধান থেকেই সারা বছরের খাবার সংগ্রহ করে উদ্ধৃত্ত ধান বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য খরচ নির্বাহ করেন। তার মতো সুনামগঞ্জের প্রতিটি উপজেলার কৃষকও এমনটাই করেন। যতই অভাব আসুক এই কৃষকরা কখনো সরকারি চালের জন্য লাইনে দাড়াননা। কিন্তু এ বছর সর্বহারা কৃষককে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। লজ্জায় অনেকে নিজে না দাড়িয়ে স্কুল পড়–য়া শিশু ও নারীদের চাল আটা আনতে পাঠাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলডুবির ঘটনায় স্থানীয় বাজারে চাল আটার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার গত সোমবার থেকে বিশেষ ওএমএস চালু করেছে। এক মাসের বরাদ্দকৃত এই বিশেষ ওমএমস জেলার ৪২টি পয়েন্টে একযোগে চালু হয়েছে। ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ ওএমএসে প্রতিটি কৃষক পরিবার ৫ কেজি করে চাল ১৫ টাকা কেজিতে ও আটা ১৭ টাকা কেজিতে টানা একমাস ক্রয় করতে পারবে। প্রতিটি পয়েন্ট থেকে ২০০ জন পাবে এই বিশেষ ওএমএসের চাল ডাল। কিন্তু বিক্রয় পয়েন্টে শুরু থেকেই কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং চাহিদা বেশি থাকায় ওএমএসের বরাদ্দ বাড়ানো ও সময় বাড়ানোর জন্য জেলা খাদ্য অফিস সরকারের উর্ধ¦তন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছে।
এদিকে বিশেষ এই ওএমএ চালু করলেও স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা সামাল দিতে পারছেনা। এবছর পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে হাওরের সম্পূর্ণ কাঁচা ফসল তলিয়ে গিয়ে লাখো কৃষককে খাদের কিনারে দাড় করিয়ে দিয়েছে। এখন ঘরে খাবার নেই ক্ষেতেও ধান নেই। ফসলডুবিকে পূজি করে স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চাল ডাল আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। সোমবার থেকে প্রতিটি ডিলারের দোকানে লম্বা লাইন লক্ষ্য করা গেছে। ডিলারের নিধারিত বরাদ্দ শেষ হয়ে চাল ও আটা না পেয়েই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন কৃষকরা।
মঙ্গলবার দুপুরে জামালগঞ্জ পয়েন্টে প্রায় সহ¯্রাধিক কৃষক বিশেষ ওএমএস এর চাল ডাল কিনতে জড়ো হোন। কিন্তু বরাদ্দ অনুযায়ী ডিলার ২০০ জনের মধ্যে বিক্রি করেন। অন্যরা না পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের সামনে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
জামালগঞ্জ পয়েন্টে চাল নিতে আসা কামলাবাজ গ্রামের ফসলহারা কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘জীবনে কখনো লাইনে দাড়াইয়া চাল কিনব এটা ভাবিনি। কিন্তু হাওর তলিয়ে গিয়ে আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন লাইনে দাড়িয়ে জীব বাঁচানোর জন্য চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তিনি জানান, তার মতো শতশত কৃষক এখন জীবন বাচাতে লজ্জা ভুলে লাইনে এসে দাড়িয়েছেন। তবে অনেকে লাইনে দাড়িয়েও সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে তিনি জানান।
একই গ্রামের কৃষক সোনাফর আলী বলেন, চৈতমাসে আমাদের সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় প্রান্তিক কৃষকের ঘরে নিদান শুরু হয়। খাবারের টান পড়ে। তখন আধা পাকনা ধান কেটে সেই নিদান দূর করা হয়। কিন্তু এবার ফসল ডুবে যাওয়ায় খাদ্যসংকটে আছেন কৃষক। তিনি এবার হালির হাওরে যে ৩ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন গত এক সপ্তাহ আগে তা তলিয়ে গেছে। এই হাওরের কারো একখন্ড জমিও অবশিষ্ট নেই বলে তিনি জানান।
জামালগঞ্জের ডিলার আকবর হোসেন বলেন, ২০০জনকে ৫ কেজি করে দেবার জন্য আমাদেরকে মাত্র ১টন দেয়া হচ্চে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এর তিন-চারগুণ। যে পরিমাণ মানুষ পণ্য পায়তার তিনগুণ না পেয়ে ফিরে যায়। তিনি জানান, সকল পরিবারেরই একই দশা। একমাত্র ফসল হারিয়ে খাদ্যসংকটে আছেন তারা। এই ডিলার বরাদ্দ ও সময় বাড়ানোর আহ্বান জানান।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আব্দুর রউফ বলেন, ফসলহারা কৃষকের কথা বিবেচনা করে সরকার সুনামগঞ্জ জেলায় এক মাসের জন্য বিশেষ ওএমএস চালু করেছে। ৪২ টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ১টন করে চাল ১৫ টাকা ও আটা ১৭ টাকা কেজিতে বিক্রি করছে নির্র্দিষষ্ট ডিলার। কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রকৃত চাহিদা ও মেয়াদ আরো বৃদ্ধির জন্য আমরা সরকারের কাছে লিখিত আবেদন করেছি।
এদিকে ফসলহারা কৃষকরা গতকালও বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসনের দাবিতে এবং ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে দির্নীতিতে জড়িত পাউবো, পিআইসি ও ঠিকাদারদের দাবিতে জামালগঞ্জে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং সুনামগঞ্জ জেলা শহরেও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আগামী বৃহষ্পতিবার সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে এবং পাউবোর দুর্নীতিবাজদের বিচারের দাবিতে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ সামাজিক আন্দোলন। সংগঠনটি প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এ লক্ষ্যে কর্মসূচি পালন করছে।
ক্যাপশন: জামালগঞ্জ পয়েন্টে বিশেষ ওএমএসের চাল নিতে মানুষের ভিড়।