বিশেষ প্রতিনিধি::
মরমী সাধকদের জন্মভূমি সুনামগঞ্জে পহেলা বৈশাখসহ বাঙ্গালির প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও আনন্দ উৎসব জমকালো উদযাপিত হয়। উৎসবে থাকে নানা ধরনের রঙের ছটা। মেলা ও চৈত্রসংক্রান্তিসহ নানা আয়োজন। কিন্তু এবার জেলার সকল হাওরে কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় নিঃস্ব কৃষকের কথা বিবেচনা করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রশাসন জমকালো অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। হচ্ছেনা মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রশাসন বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, মেলাসহ জমকালো আয়োজন থেকে সড়ে এসে বিকেলে সীমিত আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্টান আয়োজন করছে। অন্যদিকে জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো উৎসবমুখর উদযাপনের বদলে বিকেলে ফসলহানীর ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দাবি করে প্রতিবাদী গণসঙ্গীত পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় ঐতিহ্য যাদুঘর ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী গণসঙ্গীত পরিবেশন করছে উদীচী। এভাবেই বাঙ্গালির উৎসব পহেলা বৈশাখ পালন করছে ফসলহারা সুনামগঞ্জ বাসী। তারা দ্রুত সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে জেলায় এ বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এ থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার উপর ফসল উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু গত ২৯ মার্চ থেকে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অকালে তলিয়ে যায় হাওরের কাচা বোরো ফসল। ফসলহানীদে সময় মতো বাধ নির্মিত না হওয়া এবং পাউবোর অবহেলাকে দায়ি করে আন্দোলন করে আসছেন। কৃষি বিভাগের মতে এ পর্যন্ত জেলার প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। জেলার ১৩৩ টি ছোট বড় হাওরের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরটি টিকে আছে।
এদিকে একমাত্র ফসল হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন ৩ লাখ ৩৩ হাজার বোরো চাষী পরিবার। সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা। মহাজনের সুদ ও ব্যাংকের লোন পরিশোধ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কথা বিবেচনা করে সরকার গত ১০ এপ্রিল থেকে সুনামগঞ্জে সীমিত আকারে বিশেষ ওএমএ চালু করেছে। ওই দিন থেকে ৪২ জন বিশেষ ডিলার জনপ্রতি ২০০ জনকে ৫ কেজি করে চাল ও ৫ কেজি করে আটা বিক্রি করছেন। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল থাকায় খালি হাতে ওএমএস ডিলারের দোকান থেকে ফিরছেন কৃষকরা।
কৃষকের এই চরম দুর্দশার কথা বিবেচনায় এনে ‘হাওর বাচাও সুনামগঞ্জ বাচাও আন্দোলন’ এর নেতৃবৃন্দ জেলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সুধীজনদের বর্ণাঢ্য বৈশাখ বর্জন করে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। প্রশাসনকেও এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য আয়োজন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান।
বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রশাসন বর্ণার্ঢ আয়োজন থেকে সরে এসেছে। জেলা প্রশাসন রাষ্ট্রীয় ভাবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করার নির্দেশনা থাকলে স্থানী বাস্তবতা ও দাবি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করে আয়োজন সীমিত করার আবেদন জানিয়েছে। প্রশাসন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ বিকেলে সীমিত আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো উৎসবমুখর পরিবেশে উৎসব পালনের বদলে বিকেলে প্রতিবাদী গণসঙ্গীত পরিবেশন করছে। ফসলহানির ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি ও কৃষকদের সহায়তার দাবিতে তারা জেলার বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করছে।
জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি শিলা রায় বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে ফসলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বৈশাখের উৎসব। কিন্তু এবার যেহেতু কৃষকের গোলা শুন্য তাই তাদের মনে আনন্দও নাই। বরং খাদ্য নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে লাখো কৃষক। আমরা এই দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের পুনর্বাসন সহায়তার দাবি জানিয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসব বর্জন করে তাদের সহায়তার জন্য প্রতিবাদী গণসঙ্গীত কর্মসূচি পালন করব।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, একমাত্র ফসল হারিয়ে নিঃস্ব সুনামগঞ্জের কৃষক। এই অবস্থায় কারো পহেলা বৈশাখ বরণ করার অবস্থায় নেই। আমরা কৃষকের বিরাট ক্ষতির কথা বিবেচনা করে প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের পহেলা বৈশাখ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছি। সবাই আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। আমরা পহেলা বৈশাখে উৎসবের বদলে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করব।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামরুজ্জামান বলেন, সুনামগঞ্জের সকল কৃষক ফসল হারিয়ে এখন দিশেহারা। তাদের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ থেকে সড়ে এসেছি। বিকেলে শুধু সাংস্কৃতিক অনষ্ঠান করব সীমিত পরিসরে। সুনামগঞ্জে এবার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হচ্ছেনা বলে জানান তিনি।