1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

আদিবাসী হতে হলে আদি বাসের রীতি জানতে হবে।। ফারহা তানজীম তিতিল

  • আপডেট টাইম :: মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, ৮.২৮ পিএম
  • ৩৯১ বার পড়া হয়েছে

আদিবাসী হতে হলে আদি বাসের রীতি জানতে হবে। মানতেও হবে। এই রীতিটা কি? রীতিটা সহজ বনের সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, পাহাড়ের সঙ্গে থাকবার অভ্যাস। পাহাড় আপনার আহার জোগাবে, বসবাসের জায়গা দেবে, কিন্তু আপনি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানাবেন না। বনকে আপনার মনমতো বাগান বানাতে যাবেন না, যেমন করা হচ্ছে, মধুপুরের শালবনে অ্যাকাশিয়া রোপন করে। নদীর মৃত্যু হয়, নদী মরে যায়, গতিপথ বদলায়, জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়— এই সবই প্রকৃতির নিয়মে হতে পারে। তাই বলে আপনি-আমি তো নদীর মৃত্যুর কারণ হতে পারি না। নদী কাঁদে, নদীর কান্না শোনার মতো সংবেদনশীলতা থাকতে হবে।
আদিবাসী কে? সে প্রশ্নের উত্তরে কথা বলতে গিয়ে আমাদের এক বন্ধু এই রকমই কিছু কথা বলছিলেন। আদি বাসের রীতি নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যাটা সুন্দর। তার মনপছন্দ এই ব্যাখ্যা নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা হয়তো মানবেন, হয়তো মানবেন না। আমার কাছে বেশ কিছুদিন ধরে যাঁরা আদিবাসী বলতে আমি কি বুঝি জানতে চেয়েছেন, তাঁদেরও হয়তো আদি বাসের এই রীতিনীতির ব্যাখ্যা দিয়ে খুশি করা যাবে না।
দু’দিন আগে আমার শিক্ষকতুল্য এক সহকর্মী ‘উপজাতি অঞ্চলে’ যেতে চাইলেন? আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘উপজাতি মানে কি স্যার উপনদীর মতো কিছু? কোন্ জাতির উপজাতি কে?’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি অত সংজ্ঞা জানি না।’ আমি ওই শিক্ষককে অনুরোধ করেছি, ‘স্যার, আমরা ভুল শিখেছি বলে আমার ধারণা। কিন্তু, আপনি তো শিক্ষক। আপনি একবার ভাবেন না। কোনো জাতি কি অন্য কোনো জাতির উপ হয়?’ বাংলাদেশের আদিবাসীরা ‘উপজাতি’ শব্দটি পছন্দ করছিলেন না, এখন আমরা ওই শব্দ বিতাড়নের নামে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’জাতীয় যে সব শব্দ ব্যবহার করছি, তা আদিবাসীদের জন্য আরো বেশি বেদনাদায়ক হয়েছে।
আমরা যদি বসতি স্থাপনের ইতিহাস ধরে জানতে চাই বাংলার আদিবাসী কারা, তাহলেও এটা নিশ্চিত যে এই অঞ্চলের আদিবাসী বাঙালি নয়। জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাস নেহায়েত কম দিনের নয়, তবে তারও আগে অনেক জাতি বর্তমানকালের বাংলায় বাস করত। বাঙালি একটি সংকর জাতি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীগুলোর একটি। অন্তত দেড় হাজার বছর আগে আর্য-অনার্য মিশ্রিত প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে এবং ব্রাহ্মী লিপি থেকে সিদ্ধম লিপি হয়ে বাংলা লিপির সৃষ্টি। এর আগে-পরে অস্ট্রিক ও নিগ্রিটো জাতির মানুষসহ বহু জাতির রক্ত এসে মিশেছে বাঙালির সঙ্গে। তাই বাঙালিদের কেউ একটু বেশি লম্বা, কেউ মাঝারি, কেউ আবার বেঁটে। কারও গায়ের রং খুব ফরসা, কেউ শ্যামবর্ণ, কেউ বা কালো। কারও নাক খাড়া, কারও অতটা নয়। মাথার চুল কারও সোজা, কারও অল্প বা বেশি কোঁকড়ানো।
বাঙালির জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের সঙ্গে আর্য-অনার্যের লড়াই জড়িয়ে আছে। আর্যদের আদিবাস ছিল উত্তর ইরানে, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। আর্যরা এসে দ্রাবিড়দের অধিকার করে নিল। দ্রাবিড় কারা? আর্য আগমনের অনেক আগে থেকে বাংলায় যে আদি মানুষের অস্তিত্ব ছিল তাদের দ্রাবিড় বলা হয়, নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এরাই অস্ট্রিক বা অস্ট্রোলয়েড গোত্রের মানুষ, আরো সহজ করে বললে বলা যায় কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি। এই জাতিগুলো শুধু বাংলার নয়, গোটা ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা। বাংলাদেশে এখনো সাঁওতালরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা রয়েছে। ভারতে আসার পর আর্যরা ঠিকই বাংলায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। উর্বর ভূমির সন্ধানে খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছর আগে উত্তর ভারতে আসে আর্যরা। ভারতবর্ষের সবচেয়ে উর্বর জমির অঞ্চল বাংলাকে আর্যরা দখল করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেকালে বাংলায় বসবাসকারী কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতির লড়াকু মানুষগুলো প্রতিরোধ তৈরি করেছে। ফলে অহংকারী আর্যরা বারবার পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
আর্য অহঙ্কার, আর্যদের জাতিগত উদ্ধত্যের কথা নৃতত্ত্ববিদ এ কে এম শাহনাওয়াজের ছোটদের জন্য একটি লেখায় খুব সুন্দরভাবে এসেছে, ‘নিজেদের লেখা বেদ গ্রন্থে তারা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছে। অন্যের দেশ দখল করেছে—এ নিয়ে পরে যদি কথা ওঠে, তাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য গল্প ফেঁদেছে। এমনিতে আর্যরা নিজেদের খুব উঁচু জাতের মনে করত। তারা দেখতে ছিল সুন্দর। আগুনের পূজা করত তারা। সে যুগে অগ্নি উপাসকদের সেরা জাতের মনে করা হতো। এই নাক উঁচু আর্যরা লিখেছে, ভারত অপবিত্র দেশ। এখানে বর্বর মানুষেরা বাস করে। আর্যরা অমন দেশে থাকতে পারে না। তবে তাদের একটি সুবিধা ছিল। বিদেঘ নামে একজন মুনি বা পুরোহিত ছিলেন। তাঁর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। বিদেঘের মুখ দিয়ে আগুন বের হতো। তিনি হেঁটে যেতেন আর মুখের আগুনে চারপাশ পুড়িয়ে খাঁটি করা হতো। আর সেই পবিত্র মাটিতে বসত করেছিল আর্যরা।’
বাংলার আদি বাসিন্দাদের তুলনায় নবীন হলেও আমরা বাঙালিরা বোধ হয় আর্যদের জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হচ্ছি। আর্যরা ভাবত এবং অন্যদের ভাবাতে চাইত, তাদের তৈরি ‘সোমরস’ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পানীয়, সাঁওতালদের ‘হান্ডি’ হচ্ছে পঁচা ভাত। আর্য অহঙ্কার, আর্যদের জাতিগত উদ্ধত্যের উত্তরাধিকারীর মতো কাজ হয়েছে আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলার প্রচলন শুরু হয় ২০১০ সালে প্রণীত একটি আইন দিয়ে, যা পরের বছর সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ক্ষুদ্র কি? ওদের সংখ্যা, না আমাদের মানসিকতা? অভিধানে ‘ক্ষুদ্র’ বলতে বোঝায় ছোট, নীচ, সামান্য, অল্প ইত্যাদি। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলাটা যে তুচ্ছার্থে হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি না।
এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংখ্যালঘু জাতি হলো চাকমা। অন্তত হালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনায় তো বটেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা করলেও চাকমাসহ সেখানকার অন্য আদিবাসীরা পাহাড়ের আদি বাসিন্দা বলেই বিবেচিত হবে। অনেককাল আগে সেখানে কিছু বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাঙালির বসবাস ছিল। পরে সামরিক শাসকদের আমলে পাহাড়ে বাঙালিদের নিয়ে রোপন করা হয়েছে, এই সেটেলাররাই পাহাড়ে কুতর্কের আগুন জ্বালিয়েছে, যাতে তাদের বাস প্রশ্নহীন হয়।
(লেখকের ফেইববুক টাইম লাইন থেকে নেওয়া)

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!