সুশান্ত দাস::
আমরা প্রায় সবাই জানি সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত শাল্লা একটি প্রত্যন্ত উপজেলা। অন্যভাবে বলা যায় সহজ সরলতার আদর্শে উর্বর ভূমি। প্রকৃতি যেমন তার ভাসান পানি দিয়ে মাটিকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত উর্বর করে তুলে ঠিক তেমন ভাবে এখানকার মানুষের জীবন-ধারাকেও সহজ সরলতায় উর্বর করে তোলে। বলা যায় এ এক প্রকৃতির আশীর্বাদ ও বড় গুন।
এই অঞ্চলটি পাকিস্তানিদের কবল হতে বাঁচতে জাতি গঠনে যেমন অবদান রেখেছে তেমনি রাজনীতি,সংস্কৃতি, সামাজিক আপ্যায়নতায় তার সহজ-সারল্যতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছে। তাইতো বন্যার কবলে হাওর যখন প্লাবিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমে,এলাকায় আবাসিক হোটেলের আবাসন না থাকায় সহজ-সারল্যতায় ভরপুরে মানুষজন তাঁদের হৃদয় থেকে আপ্যায়নতা স্বরূপ আশ্রয় দিয়েছেন নিজে থাকার বড়-ঘর,লাকাড়ি-ঘর থেকে গরু-ঘর পর্যন্ত। পত্রিকায় সারল্যতার নিদর্শন হিসাবে হয়েছে শিরোনাম। শুধু কি তাই ? ৭১-এ মাতৃভুমিকে রক্ষায় যাঁদের এতো খাটুনি (নৌকা বাউয়া) যাঁরা নিজের পেশা কি তাই বুঝেন না অর্থাৎ মা-মাতৃভূমিকে বুঝে,পেশাকে বুঝেন না কিংবা এক লোটা(পাত্র বিশেষ)ঘি(মাখন)দিয়ে এক লোটা চিটা(হুক্কাতে তামাক বানানোর জন্য পঁচা লাল গুড়) প্বার্শবর্তী বাজার আজমিরীগঞ্জে বিনিময় করতো তাঁদের সহজ সরলতাকে বলুন কি দিয়ে পরিমাপ করা যায় ??? সত্যি অর্থেই বলা যায় প্রকৃতিরদান। যা অন্য কোন অঞ্চলের তুলনায় উদাহরণ যোগ্য।
এই হচ্ছে হাওর জনপদের ধরন। এখানে বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস আর প্রতিবেশী দেশ রতন টাটার কথাই বলুন;এখনো মুখে ফস্কে বেড়িয়ে আসে বিশ্বের সেরা ধনীদের কথা না বলে নিজ গ্রামের নিজ এলাকার ধনীদের কথা। এটাই এলাকার প্রেম,এটাই আঞ্চলিক প্রেম,এটাই দেশ প্রেম আর এটাই সারল্যতা। মনে শ্রদ্ধা না থাকলে এসব উদাহরন দেওয়া যায় না। আর তাই হয়তো র্যাব প্রধান জনাব আবুল্লাহ আল মামুন তাঁর প্বার্শবর্তী গ্রামের ধনী ব্যক্তির নাম ব্যবহার করেছেন (১৮/৩/২০২১ লাইভ প্রোগ্রাম,হবিবপুর নওয়াগাঁও শাল্লা)।
যাই হোক এই সারল্যতায় ভরপুর শাল্লার ৪টি ইউনিয়ের অন্যতম ও ব্যতিক্রম ইউনিয় হচ্ছে হবিবপুর ইউনিয়ন। অন্যতম ও ব্যতিক্রম বলার কারন হচ্ছে পাকিস্তানিদের কবল থেকে বাঁচতে শাল্লার এই একটি মাত্র ইউনিয়ন বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যিনি কখনো পাকিস্তানিদের খাতায় নাম লিখেন নি। যাঁর নাম সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাদির সাহেব। অথচ বাহারা ইউনিয়ে ছিল রাজাকার শরাফত(সুলতানপুর),আটগাঁও ইউনিয়নে রাজাকার খালেক(দৌলতপুর,উজানগাওঁ),শাল্লা ইউনিয়নে রাজাকার কালাই মিয়া চৌধুরী,মনুয়া, বর্তমানে তার নামে হাইস্কুল; ওরা সবাই ছিল তখনকার চেয়ারম্যান,পাকিস্তানিদের দূসর ও প্রেত আত্মা।[তথ্য সূত্র-(১)রনাঙ্গন-৭১(বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ড)পৃষ্ঠা – ৩৫৫।(২) রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ;পৃষ্ঠা – ১৮২।(৩) সুনামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ;পৃষ্ঠা – ৮০]। আর তাদের স্বজন হেফাজতের অনুসারীরা হবিবপুর ইউনিয়নের নওয়াগাঁও গ্রামে সাধারন মানুষের ন্যায় জাতির বীর সন্তানদের খোঁজে খোঁজে বাহিরকরে, করে বাড়িঘরে হামলা।
আজ এক ফেইজবুক স্ট্যাটাসে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সুনামগঞ্জের তরুন সাংবাদিক আ স ম মাসুম লিখেছেন সুনামগঞ্জের শাল্লায় “আল্লা নেই অথচ মামুনুল আছেন”। ( মূল উদৃতি- এলাকায় প্রচলিত কথা ছিলো – শাল্লা, যেখানে নেই আল্লাহ, এই কথাটা প্রচলিত ছিলো বঞ্চনার প্রতীক হিসাবে। ২১ বছর আগের বুলি আজো সত্যি, সেখানে আল্লাহ নেই, আছেন মামুনুল!)
হ্যা কথাটা বঞ্চনার প্রতীক বা হাস্যকর হলেও সত্যি। সাংবাদিক মাসুম হয়তো জানেন না সুনামগঞ্জের শাল্লায় মুক্তিযুদ্ধের এতো ক্ষমতা সম্পন্ন দল এতো দিন ক্ষমতায় থাকতেও গড়ে উঠেছে স্বাধীনতা বিরোধীর নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিম্ন মাধ্যমিক থেকে হয়েছে কালাই মিয়া চৌধুরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।মুক্তিযুদ্ধের সরকারি দল ক্ষমতায়, মুখে টু শব্দ করার সাহস নেই, মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সরকারি অনুদানের তামসা দেখিয়ে বিভেদ সৃষ্টি, জনসেবার ভেলকী ধরে দেয়া হয় স্বাস্হ্য সেবা,যেখানে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো সাংসদ ভোটের ভয়ে কাইত (শয্যাশায়ী)। সেইখানে সৃষ্টি কর্তা বলেন আর আল্লা যাই বলেন মামুনুলের বংশধরেরা থাকা অস্বাভাবিক নয় বরং বলা যেতে পারে জানার অভাব বা তাদের চরিত্রের নিমজ্জিততা ! এবং আরো বলা যেতে পারে আজকের এসব ঘটনার সূচনা মাত্র। মামুনুলরা তো এখন দেশ,জাতি মানলেও জাতীয় সংগীত,জনকের ভাস্কর্য মানতে অনিচ্ছুক কিন্তু ৭১-এ কালাইরা জাতীয় পতাকা,জাতীয় সংগীত দূরের কথা এই দেশ স্বাধীন হোক তাই চাইতো না।
শাল্লার ভৌগলিক চিত্রে হবিবপুরের নওয়াগাঁও গ্রামটি দাঁড়াইন নদী ঘেষা হাওরের উত্তর-পূর্বকোনে। গ্রামটিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা,সংগীতজ্ঞ,বসন্ত বাবু সহ অনেক নামি দামি লোক জন্মেছেন। আছেন বর্তমান চেয়ারম্যান সহ নতুন প্রজন্মের অনেক মেধাবী সন্তান। সবাই যে যার যোগ্যতা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মে ব্যস্ত। হয়তো আমার মতো অনেকে দেখতে পারছেন- লাইভ ভিডিও,সংবাদপত্র সহ নিউজ পোর্টালে প্রত্যক্ষদর্শীর চিহ্নিতজনদের নাম শাল্লার কাশিপুর গ্রামের নবাব মিয়া,আলহাদ,লিপন ও তোয়াহীদ।সংলগ্ন দিরাই উপজেলার নাচনী গ্রামের- মো:পংকন,স্বাধীন মিয়া,ইয়ামত আলী,ইনাত আলী,মির্জা হোসেন,ফকর আলী,আলাম উদ্দীন,আনোয়ার হোসেন,স্নেহের আলী,আলামত ও আকামদসহ অনেকের নাম(কালেরকন্ঠ ১৭ মার্চ, ২০২১)দোকানের মালিকের ভাষ্যমতে নাচনী গ্রামের(দিরাই)পংকন,পংকনের ছেলে ও স্বাধীন মেম্বার এই দোকানের কস্টমার বা ক্রেতা হিসাবে চিহ্নিত;ওরাই ছিল আক্রমণের সামনের কাতারে। জানিনা আদৌ এর সঠিক বিচার হবে কি-না? তবুও বীর বাঙ্গালীর সন্তান হিসাবে আশাবাদী এবং সরকারের বহু মূখী সহায়তার উদ্যোগ দৃশ্যত।
বিদেশ পরবাস থেকেও পুরনো দিনের স্মৃতি কল্পনা বার বার টেনে বেড়াচ্ছে। মনেপড়ছে সেদিনের স্কুলবেলার কথা। এখন নিজে স্বশরীরে দূরে থাকলেও চোখে ভেসে আসছে নওয়াগাঁও এর আক্রান্ত পূর্বহাটি হতে হবিবপুরের পাঠনী হাঁটি পর্যন্ত। নখে-দর্পনে চলে আসছে বন্ধু-বান্ধবিদের কথা। ভিডিও ক্লিপে বার বার কণ্ঠ আসছে জীবন বাঁচাতে ধান ক্ষেতে পলায়নের কথা। ভিডিও দৃশ্যে উঠে আসছে ক্লাসের রোল নং-৩,মেধাবী ছাত্র বরুণের চেহারা,আসছে আরেক বন্ধু নন্টুর কথা। ঠাকুরবাড়ি খ্যাত শত বছরের পুরনো কষ্টি পাথরের তৈরি মূর্তি লুটের হাহাকারের কথা। যে সন্তানেরা পাকিস্তানিদের হাত থেকে আমাদের আলগা করে রক্ষা করেছিলেন তাঁদের লাঞ্চনার কথা,শত বছরের কাছাকাছি বৃদ্ধার হারমোনিয়াম তবলা ভাঙ্গার দানবদের তান্ডবের কথা, মা-দের বুক চাঁপা কান্নার কথা। জানি জীবনে আজ যা হচ্ছে তা কাল স্মৃতি হবে। জীবন অশ্রু, হাসি এবং স্মৃতি নিয়ে আসে। অশ্রু শুকিয়ে যায়, হাসি ম্লান হলেও স্মৃতি চিরকাল স্থায়ী হয়। তাই করি টেন বুমের উদৃতি দিয়ে ইতি টানলাম “স্মৃতি অতীতের নয় বরং স্মৃতি হলো ভবিষ্যতের চাবি”।
লেখক- সুশান্ত দাস
রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিককর্মী লন্ডন,যুক্তরাজ্য।
ইমেইল- sushantadas62@yahoo.co.uk