অতিমারি করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী চলছে কঠোর লকডাউন। হাওরাঞ্চলের কৃষকের কথা বিবেচনা করে বোরো চাষী ও শ্রমিকদের জন্য লকডাউন শীতিল করেছে সরকার। তবে বরাবরের মতো এবারও করোনা উপেক্ষা করে নিজেদের শ্রমঘামে ফলানো একমাত্র ফসল গোলায় তোলতে কৃষকের স্ত্রী, কন্যা, পুত্রসহ স্বজনদের সবাই বাড়ি ছেড়ে হাওরে অবস্থান করছেন। কষ্টের বোরো ধান যে কোন মূল্যেই গোলায় তুলতে চান তারা। যুগযুগ ধরে এভাবেই বৈশাখে ঘর বাড়ি ফেলে হাওরে নামেন নারী-পুরুষ সবাই। দিনভর হাওরে কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেন। অনেকে হাওরের কান্দায় তৈরি খলাঘরেও অবস্থান করেন রাতদিন।
হাওরাঞ্চলে স্থানীয় প্রবাদ রয়েছে ‘যদি না থাকে ধান কাম/ তে না করে অন্যকাম’। এই সময় ধান কাটা ছেড়ে অন্য কাজে যেতে নেই। যদি ধান কাটার কাজ না থাকে তাহলে অন্য কাজ করা যেতে পারে। দেশের কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা কৃষকরা এখন তাই অন্য সব কিছু ফেলে এখন হাওরে ব্যস্ত। বজ্রপাত, কালবৈশাখি ঝড়, শীলার আশঙ্কায় প্রতিনিয়ত অস্তির কৃষক কষ্টের ধান তুলতে খুবই উদ্রগ্রীব। গত কয়েকদিন ধরে রাতে ঝড়, বৃষ্টি ও শিলার তা-ব দেখা যাচ্ছে। ভারি বৃষ্টি হলে হাওরের ফসলহানির আশঙ্কা থাকে। শঙ্কিত কৃষকরা শ্রমিক না পেয়ে স্ত্রী কন্যা ছেলে মেয়েদের নিয়েই ক্ষেতে নেমেছেন। জেলার সব হাওরে ধান কাটা শুরু হওয়ায় এখন এই চিত্রই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিটি হাওরেই চাষী ও শ্রমিকদের সঙ্গে নারী ও শিশু-কিশোরদেরও কাজ করতে দেখা গেছে।
সরেজমিন শুক্রবার দেখার হাওরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে কমবেশি ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। হাওরে ব্যস্ত কৃষক ও শ্রমিক। ধানখলায় ব্যস্ত নারী ও শিশুরা। দুপুর আড়াইটায় ঝাউয়ার হাওরে গিয়ে দেখা যায় হাছনবসত ও কালিপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন নারী কাজ করছেন। কেউ ক্ষেত থেকে ধানের মুঠো টানছেন। কেউ চিটা ছাড়াচ্ছেন, কেউ রোদে ছড়ানো ধান নাড়া দিচ্ছেন। তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে শিশু কিশোররাও। এসময় দেখা যায় সত্তরোর্ধ জুলেখা খাতুন তার পঞ্চম শ্রেণি পড়–য়া নাতি ফয়সালকে নিয়ে খড় শুকাচ্ছেন। পাশেই খলায় তার মেয়ে ধান শুকাচ্ছেন। এই খলার পাশেই দেখা গেল ষাটোর্ধ শারজান বিবিকে ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ধানখলায় চিটা ছাড়াচ্ছেন। তার ছেলে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে ধান কেটে খলায় এনে রেখেছেন। সেগুলো মাড়াই করে এখন চিটা ছাড়িয়ে শুকাচ্ছেন সারজান বিবি ও তার কন্যারা। এই খলার পাশেই সাহেরা বিবি (৫৫) নামের এক নারী শ্রমিক ধানের বিনিময়ে হাওরে কাজ করতে এসেছেন। তিনি সারাদিন গৃহস্তঘরের নারীদের সঙ্গে কাজ করেন। বিনিময়ে দিন শেষে কিছু ধান পাবেন। এভাবে বৈশাখমাস ব্যাপী কাজ করে তিনি বছরের কয়েক মাসের খোরাক সংগ্রহ করবেন বলে জানালেন। তার মতো দিনমজুর ও দরিদ্র পরিবারের নারীরাও মওসুমি শ্রমিক হিসেবে হাওরে কাজ করে আহারের সংস্থান করেন।
এই নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল শুধু স্বচ্ছল ও গৃহস্ত পরিবারের নারীরাই নয় দরিদ্র পরিবারের নারীরাও এসময় মওসুমি শ্রমিক হিসেবে ধানের বিনিময়ে হাওরে কাজ করেন। তারা নিজেদের সঙ্গে কন্যা ও পুত্রদেরও নিয়ে আসেন। আবহমান কাল থেকেই এভাবে হাওরের নারীরা কাজ করেন বলে জানান তারা।
শারজান বিবি বলেন, আমার ছেলে আড়াই একর জমি চাষ করেছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ জমির ধান পাকার পর কাটা হয়েছে। শ্রমিক মিলাতে কষ্ট হয়েছে ছেলের। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের সঙ্গে ছেলেও ধান কাটতে শুরু করেছে। ছেলেকে সহযোগিতা করতে বাড়ি তালাবদ্ধ করে মেয়েদের নিয়ে হাওরে এসেছি। তিনি বলেন, না এসে উপায় নেই। যে কোন মুহুর্তে আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। তাই কষ্টের ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে সবসময়। কিভাবে দ্রুত ধান কেটে গোলায় তোলা যায় এই চিন্তায় অস্থির থাকি সবাই।
বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, ছোটবেলা দেখেছি আমাদের মা, চাচীরাও এভাবে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে বৈশাখে হাওরে নামতেন। তাদের দেখাদেখি আমরাও হাওরে নামতে শুরু করি। বৈশাখে কোন কৃষকের স্ত্রী কন্যা বাড়িতে থাকেনা। প্রয়োজনেই ধানখলায় আসতে হয় আমাদের। অনেকে রাতেও খলাঘরে থাকেন।
দেখার হাওরের তাজপুর গ্রামের কিষাণী জোবেদা খাতুন বলেন, দেড় হাল জমিন করছি ইবার। ঘরবাড়ি তালা মাইরা আউরো আইয়া এখন খাজ খরতাছি। আউর গেলে বাচবার উফায় নাই। তাই আমরা বাড়িত না বইয়া আউরো আইয়া কাজো নামছি।
সাহেরা বিবি বলেন, আমি গরিব মানুষ। পরতি বছর বৈশাখে মাইনসের ক্ষেতে আইয়া কাজ করি। সারাদিন কাজ কইরা কিছু ধান পাই। এই ধানে তিনচাইর মাস ঘরো বইয়া খাইতাম পারি।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও নারীনেত্রী নিগার সুলতানা কেয়া বলেন, বৈশাখে হাওরে অন্যরকম চিত্র দেখা যায়। এসময় গ্রামের ধনি গরিক কৃষক পরিবারের কোন নারী বাড়িতে থাকেনা। পুরুষের সঙ্গে তারাও সারাদিন হাওরের কান্দায় পরে থাকেন। ধান শুকানো, ধান পরিবহন, খড় শুকানোসহ নানা কাজ করেন। যুগ যুগ ধরেই হাওরের নারীরা এভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, হাওরের জেলায় কাজ করতে না আসলে জানা হতোনা হাওরের ফসলের প্রতি সবাই কতটা দরদি। এই সময় প্রায় সব কৃষক পরিবারের নারীরা ঘর ছেড়ে সন্তান সন্ততি নিয়ে হাওরে নামেন। তারাও কৃষিকাজ করেন। সবার একটাই লক্ষ্য কিভাবে কষ্টের ধান গোলায় তোলা যায়। হাওরের কৃষির উন্নয়নে নারীদেরও বিরাট অবদান রয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে জেলায় এবছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর। শ্রমিক সংকট দূর করতে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছে। সরকারিভাবে ধান কাটতে পুরাতন ও নতুন মিলিয়ে ২৪৩টি যন্ত্র কৃষকদের ভর্তূকি দিয়ে বিতরণ করা হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত হাওরে গড়ে প্রায় ১৬ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে।