করোনার নিদানে কেমন আছে আমাদের পাতা ভরা বই? মহামারিকালে বইমেলার সময় বদলেছে, ঝড়ো হাওয়া আর সংক্রমণ সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরিভাবে গুটাতে হয়েছে প্রাণের মেলা। কিন্তু করোনাকালে বই থেকে কী সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? এমন কোনো নজির তা নথি নেই। অনলাইনে দেদার বিক্রি হয়েছে বই। নিজের বইয়ের স্তুপ বারবার ওল্টেছেন বহুজন। লকডাউনে ঘরে থাকা অনেক মানুষকে বেঁচে থাকবার, আরেকজনের পাশে সাহস নিয়ে দাঁড়াবার সঞ্জিবনী দিয়েছে বই। বইহীন, নিরক্ষর বা হয়তো মূদ্রিত বই যাদের কাছে প্রয়োজনীয় নয়, তারাও এই মহামারিকালে তাদের অবিস্মরণীয় সব অমূদ্রিত মৌখিক বয়ান আর স্মৃতিকথার টানটান রসদেই দাঁড়িয়ে আছেন এক দুনিয়াময় ছড়িয়ে যাওয়া ভয়কে চুরমার করে। চৈত্র মাসের শেষেও দেখেছি দেশের উপকূল, হাওর, বরেন্দ্র কী গড় অঞ্চলে অনেক প্রবীণ অপেক্ষা করেছেন বাংলা পঞ্জিকার। করোনাকালে মূদ্রিত বাংলা পঞ্জিকায় এবার অনেক ‘প্রাপ্তবয়ষ্ক আজেবাজে বিজ্ঞাপন’ আছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। গ্রাম কী মফস্বলে খোঁজ নিয়ে জেনেছি বহুজন বই বিনিময় করেছে, উপহার কী সাময়িক ধারের ভেতর দিয়ে বই থেকেছে এই মহামারিকালের জনমানসের মনস্তত্ত্বের স্বাক্ষী হয়ে। যখন আমরা বই পড়ি নিজে বা পড়ে শোনাই বা এ বিষয়ে বলি বা গল্প সাজাই তখন একমাত্র পাঠকের যাবতীয় মনের অলিগলি কেবল বইই দেখতে পায়। বইয়ের কাছে পাঠক বা শ্রোতা হিসেবে লুকানোর কিছুই নেই। এই মহামারির নিদানে আমাদের কী অভিব্যক্তি, চাওয়াপাওয়া, ভাল কী মন্দ আওয়াজ একটি বই পাঠের সময় আমাদের সকল প্রতিক্রিয়া ও যুক্ততা কেবল সেই বই টের পায়, ঠাহর করে। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর মহামারিতে দেশের গ্রামগঞ্জে নানা অঞ্চলে নানা সমাজে কী কী ঘটেছে সেসব গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে খোঁজার ও বোঝার চেষ্টা করে চলেছি। প্রায় শত প্রবীণজনের সাক্ষাতকার নিয়েছি। তাদের ভাষ্য কোনো মহামারিতেই বই শেষ হয়ে যায়নি। হারিয়ে যায়নি। বরং বই বইয়ের মতই থেকেছে। এক মহামারিকাল থেকে আরেক মহামারি বই ধরে রেখেছে সমাজ ও সভ্যতার মনস্তত্ত্ব আর প্রতিক্রিয়া। ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস পালিত হয়। তো মার্চ ২০২০ থেকে করোনা মহামারিকালে আমরা দুটি বই দিবস পাড়ি দিলাম। বই কিন্তু আছে, পাতা ভরা বই, মৌখিক বয়ানের অমূদ্রিত বই। তবে চলতি লেখাটি মূদ্রিত পাতাভরা বই নিয়ে, বিশেষ করে করোনা মহামারিকালে বইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা জানিয়ে।
২.
নিজে বানান করে পড়া আমার প্রথম বই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। ছোটবেলায় পারিবারিক পাঠ্য ছিল নজরুলের সঞ্চিতা, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সুকান্ত ও সুকুমার সমগ্র। তখন সবে স্কুলের গন্ডিতে ঢুকেছি। বড় বোনের বই পড়ার বাতিক ছিল, মা’র কাছ থেকে পাওয়া। বাবার ছিল ট্রাংক ট্রাংক বই। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকার সময়ই ডারউইনের দুনিয়া কাঁপানো অরিজিন অব স্পিসিস বইটির প্রথম দিকের সংস্করণ ধরে দেখার মহাসৌভাগ্য ঘটেছিল। আলেক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ মা পড়ে শোনাতেনদুপুরবেলার ভাতঘুমের আগে। বিশ্ব সাহিত্য, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ছাড়াও ঘরভর্তি ছিল যোগব্যয়াম আর হোমিওপ্যাথির বই। মার্কস থেকে লেনিন প্রগতি প্রকাশনীর লাল নীল সাদা কালো কত কিসিমের বই আজ নামও ভুলে গেছি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল দেবীপ্রসাদের যে গল্পের শেষ নেই। বসুমতী, উদয়ন, শিশু, পাতাবাহার, দেশ, বেগম, বিচিত্রা এসব সাময়িকীর পাশাপাশি দৈনিক সংবাদ তখন উল্টেপাল্টে দেখা শুরু করেছি। ঠাকুরমার সাথে রামায়ণ আর মহাভারত পাঠের আসরে গেলেও মগজ পড়ে থাকতো মরুতীর্থ হিংলাজ কি মহাপ্রস্থানের পথে। পথের পাঁচালী আর চাঁদের পাহাড়ের ভেতর কোনটা আগে শেষ করেছি খেয়াল নেই। আমাদের বোন তখন জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশদিন শেষ করেছে। আমিও হাতে নিয়েছিলাম, টানেনি। যখন জানলাম আমার নামের প্রথম অংশটি গোর্কির মা উপন্যাস থেকে নেয়া সেখানেও হাত দিয়েছিলাম। মার হাতে তখন বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম আর বাবারইউলিসিস। বাসায় বাংলা পঞ্জিকার চল এখনও আছে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন ঘরদোরের পাশাপাশি বইপত্র, ট্রাংক, আলমিরা সব সাফসুতরো করা হতো। টাল টাল বই রোদে দেয়া হত। বইয়ের সারির ভেতর উঁকি মারতো নানান মাপের আচারের বয়াম। রোদ পোহানো বইগুলি ঝেরে মুছে রাখার সময় আমাদের বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসতো। দেখাদেখি শেষ হতো না। ইংরেজি বই গুলি আমায় একদমই টানতো না। বাবার কাছে ঐগুলিই ছিল যক্ষের ধন। আরব্য রজনী, মহাভারত, ওডিসি আর ইলিয়াড পড়ার পর আমিও নি:সন্দেহে আমার বোনের মতোই বইয়ের প্রেমে পড়ে যাই। চৈত্রসংক্রান্তির পরের দিন নববর্ষকে আমরা বলি ‘মাস পয়লা’। বৈশাখের প্রথম দিন ঘরের দরজায় কাঁচা আম পাতা সাজিয়ে ঝোলানো হয়, তাতে দেয়া হয় রক্তলাল সিঁদূর। নতুন পঞ্জিকাকে কাঁচা হলুদের কষ ও সিঁদূর মাখানো হয়। বইয়ের ট্রাংক কি আলমিরা সর্বত্র তেল-সিঁদূরের ছাপ।
৩.
আমরা বড় হয়েছি ছোট্ট মফস্বল নরসিংদীতে। মোহন সিরিজ, দস্যু বনহুর আর চিত্রালী পত্রিকা পড়তো বড়রা। ঐসব তখন শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ। অধ্যাপনার পাশাপাশি বাবার ছিল চাপাতার দোকান। মুন্না টি হাউজ। গ্রাম থেকে আসা আত্মীয় পরিজন যারা ঐ দোকানে আসা যাওয়া করতো তারাই নিষিদ্ধ বই পড়ার অধিকার পেয়েছিল। শুধু শুনতাম রেলস্টেশনের বইয়ের দোকানে ঐসব বই বিক্রি হয়। পঞ্চম শ্রেণির পরেই আমাদেরকে বাসা পাল্টাতে হল। বইয়ের যেমন জগাখিচুরি, আমাদের বাসাটাও ছিল হিন্দু-মুসলিম-বাঙালি-আদিবাসী আর নানা বয়সের এক মাঝারি বাজার। জীবনের প্রথম যেদিন রেল স্টেশনের সেই নিষিদ্ধ বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়াই, মনে হয় এক আস্ত রেলপথ আমাকে ছিঁড়েখুড়ে গেছে। টিফিনের পয়সা জমানো শুরু তখন থেকেই। বোন আর আমি। আমাদের ছোট ভাই তখনও বইয়ের নাগাল পায়নি। প্রগতির পর সেবা প্রকাশনী। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন রেলস্টেশনের সেই নিষিদ্ধ বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জুল ভার্ন থেকে বারোজ, দ্য লিটিল হাউজ অন দ্য প্রেইরি থেকে ড্রাকুলা, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে মার্ক টোয়েন, ফ্রাংকেনস্টাইন থেকে বারমুডা ট্রায়াংগল। আমাদের বাসায় কখনোই পাঠ্যবইয়ের ভেতরে লুকিয়ে বা আলাদা মলাট মেরে কোনো বই পড়তে হয়নি। এমনকি বয়:সন্ধিকাল ও শারীরবিদ্যার বইগুলিও সযতনে আমাদের পড়তে দেয়া হয়েছে। লোলিটা, প্রজাপতি, বিবর বইগুলি যখন পড়েছি তখন হুমায়ন আহমেদ, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব, সুনীল আর মিলনের ভরাজোয়ার। এমনও হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের নতুন কোনো বই বন্ধুরা ভাড়া দিয়ে পড়ে আবার দোকানে জমা দিয়েছি। পরপর চিনতে শিখি হুমায়ুন আজাদ, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, দেবেশ রায়, দ্বিজেন শর্মা, আবুল বাশার, প্রবীর ঘোষ, সত্যজিৎ রায়, সৈয়দ শামসুল হক, জীবনানন্দ থেকে সিকদার আমিনুল হক। বিনয় মজুমদার থেকে পুর্নেন্দু পত্রী, শংখ ঘোষ কি জয় গোস্বামী। বুঝতে শিখেছি প্রেমেন্দ্র মিত্র, উপন্দ্রে কিশোর, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জসীমউদ্দিন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এরা অবশ্য পাঠ্য। বাবার ছিল অভিধান সংগ্রহের নেশা। তখন শুধু বই রাখার জন্য আমাদের নতুন দুটি স্টীলের আলমিরা বানানো হয়েছে। আগের দুটি বাঁশের শেলফ সব মিলিয়ে ভাইবোনদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে আমরা চালু করি ‘সুপাসো পাঠাগার’। পিশিমনির বাড়িতে, সুনামগঞ্জের বলরামপুরে কংকাবতী পাঠাগারটির বয়স ছিল মেলা। আমাদেরও বেশকিছু পাঠক হয়েছিল। বাবার মতো আমার বোনও যখন ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার পরিচয় ঘটে টলস্টয়, কাফকা, সার্ত্রে, জর্জ ওরওয়েল, কামু, হেমিংওয়ের সাথে। যদিও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি তখন চারু মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী আর আদিবাসী জীবন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওঠি। জীবনে প্রথম সমাপ্ত রচনাবলীর নাম ‘বেগম রোকেয়া’।
৪.
আমরা বড় হয়েছি নানা মাপের, নানা কিসিমের বইয়ের ভেতর দিয়ে। আদর্শলিপি থেকে শুরু করে নামতা। কয়েক পাতার চ্যাপ্টা মাপের বই। স্কুলের বইগুলির মাপের সাথে অন্য বইয়ের মিল ছিল না। পঞ্জিকাটি আবার অন্যরকম। অভিধানগুলির সাথে কৃষ্ণের শতনাম, খনার বচন কি পাঁচালী বইগুলির শরীর স্বাস্থ্যে কতই না অমিল। গীতা, বেদ, বাইবেল, কোরান শরীফ কি ত্রিপিটক গ্রন্থগুলোর আলাদা মর্যাদা। লাল সালু কাপড়ে মুড়িয়ে ঘরের সবচে পবিত্রস্থানে এদের স্থান। ¯œান করে বাসী কাপড় পাল্টিয়ে কাঠদানিতে নিয়ে এসব পড়তে হতো। যাতে পা না লাগে, থুথু না ছিটকে পড়ে এমনতর কত সাবধানতা! তাবিজের মতো ছোট্ট কোরাণ শরীফ, তালপাতায় লেখা পুঁথি আর বিশাল আকারের মানচিত্রের বইগুলি দেখে বইদেখা বিষয়ে প্রথম জ্ঞান হারাই। বাবা চালু করেছিলেন বই উপহারের, বিয়ে কি জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠানে। খুব কাছ থেকে খেয়াল করেছি কেউ তা মন থেকে মেনে নেয়নি। বেলা দে’র গৃহিণীর অভিধান বইটি যখন বাসায় প্রথম আসে, তখন আশেপাশের অনেকেই বাসায় ভিড় জমাতে শুরু করে। তো বই আর বই। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। বাংলাদেশের এক বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাকরণে।
৫.
আমাদের এক বিন্দু অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি, বইয়ের দুনিয়া শরীর-মাংশ-মজ্জার এক জীবন্ত চলমানতা। খুব বেশি দিন হয়নি দুনিয়া ভার্চুয়াল বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। এখন বইয়ের দুটি ধরণ। পাতা ভরা বই আর ভার্চুয়াল বই। অনেকে বলেন ‘সফট আর হার্ড কপি’। ভার্চুয়াল বইগুলি আবার ‘ই-বুক’ নামেই পরিচিত। সময়ের চাপে আমারও এমনতর বেশকিছু বইয়ের রসদ আছে। কিন্তু ভার্চুয়াল বইয়ের সাথে কাঁচা হলুদ কি রক্তলাল সিঁদূরের কোনো ওঠাবসা নাই। ইঁদুর-ছারপোকার যন্ত্রণা নাই। ময়লা সাফসুতরোর টালমাটাল নাই। আমাদের অনেক বই দাদুর ছিল, বাবার হাতে এসেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বইয়ের এই বিচিত্র যাত্রাপথ কোনোভাবেই কী ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সম্ভব? ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বইয়ের অন্য মানে, অন্য ব্যাকরণ। বইয়ের স্বভাব ও আচরণ সেখানে ভিন্ন। লেখক, প্রকাশক, পরিবেশক, ক্রেতা, পাঠক সব মিলিয়ে বই ধরে রেখেছে পেশা ও উৎপাদনের এক জটিল সমাজ। এ সমাজে সকলে সকলকে চেনে না। কার বাঁশ বাগানের বাঁশ কাগজকলে যায়, রঙের কারখানায় কার ঘাম ঝরে, কে বই বাঁধাই করে, কে থাকে রাতভর ছাপাখানায় এসব খবর কে রাখে? একটি বই তো আর কেবলমাত্র লেখক আর পাঠকের একতরফা সম্পর্ক নয়। বিস্তর মানুষের ঘাম আর স্মৃতি আখ্যান নিয়ে একটি বইয়ের জন্ম হয়। আমরা কি দুই মলাটের ভেতর কাগজের পাতায় ছাপানো অক্ষরকেই কেবলমাত্র বই হিসেবে জানি? কোনোভাবেই নয়। আমাদের কাছে বই বিদ্যা ও জ্ঞান বহন করে। আর তাই বই পায়ে লাগলে আমরা তার কাছে ক্ষমা চাই, সালাম জানাই। শৈশবে বইয়ের ভেতর বিদ্যাপাতা নামে একপ্রকার ফার্ণ গাছের পাতা রাখতাম। এসব পাতা রাখলে নাকি বইয়ের জ্ঞান বিদ্যাপাতার ভেতর দিয়ে মগজে চলে আসে। এভাবেই বিদ্যা জীবন্ত থাকে। গাছের পাতা আর বইয়ের পাতার রসায়নে।
৬.
চলতি সময়ে বেশ তর্ক ওঠেছে পাতা ভরা ছাপানো বই আদৌ আর দুনিয়ায় টিকে থাকবে কীনা? চারদিকে বহুজাতিক পুঁজির র্ভাচুয়াল বাজার। বাণিজ্য থেকে ক্ষমতার দরবার সবকিছু পাল্টাচ্ছে। আমার মনে হয় পাতা ভরা ছাপা অক্ষরের বই ‘বই’ হিসেবেই দুনিয়ায় টিকে থাকবে। কারণ ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কি অ্যাজেন্সি সবকিছুই জড়িয়ে আছে পাতা ভরা বইয়ের ঐতিহাসিক ময়দানে। এ ময়দান দুম করে পাল্টে দেয়া যায় না। কারণ বইয়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক বিজ্ঞানসূত্র তৈরি করেছে। এ সম্পর্ক নিরন্তর বিকশিত ও বিস্তারিত হচ্ছে। এখনও দোকানে দোকানে কাংখিত বইটি খুঁজে পাওয়া যায় না। পাঠাগার, প্রতিষ্ঠান কি লেখক প্রকাশকের কাছে বারবার আবদার জানাতে হয়। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রত্যয়টি বেশ জোরালো। ডিজিটাল বাংলাদেশে কি পাতাভরা ছাপা অক্ষরের বই থাকবে? পাতাভরা কিংবা ই-বুকের টিকে থাকা না থাকা কি কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় বিধি বা রাজনৈতিক দরবারের ওপর নির্ভর করে? বইয়ের টিকে থাকবার সাথে এসব চোখরাঙানি যায় না সবসময়। বই টিকে থাকে বইয়েরই জন্যে। সময় থেকে সময় ডিঙিয়ে সমাজের বিবর্তন মেনে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও আজ পাতাভরা ছাপা অক্ষরের বই এবং ই-বুক বিষয়ে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
৭.
ডন কুইক্সোট ও ম্যাগনাম ওপাসের লেখক মিগ্যুয়েল দ্য সারর্ভান্তেস মারা যান ১৬১৬ সনে। অধিকাংশ সূত্র ২৩ এপ্রিলকেই তার মৃত্যুদিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যদিও অনেকের মতে তিনি মারা যান আগের দিন আর ২৩ তারিখে তার শেষকৃত্য হয়। ১৯৯৫ সনে জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব বই ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ঐ বছর দিনটি উইলিয়াম শেকসপীয়র এবং ইনকা গার্সিলাসো দ্য ল্য ভেগাসহ অনেকের জন্ম ও মৃত্যুদিন। দুনিয়ার নানা দেশ নানাভাবে বই দিবস পালন করে। বাংলাদেশ দুনিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থসমূহের উত্তরাধিকার বহন করে। ঋক বেদ থেকে শুরু করে প্রজ্ঞাপারমিতা। এখনও মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, রাখাইন সমাজে নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালায় হাতে লেখা বইয়ের চল আছে। আদিবাসী রবিদাস জাতির ধর্মগ্রন্থ আন্নাস হাতে লেখা। চাকমা তালিক চিকিসাশাস্ত্রগ্রন্থ চাকমা বর্ণমালায় হাতে লেখা। সিলটি নাগরিতে লেখা অনেক পুঁথি দলিলের স্মৃতি এখনও সুরমা অববাহিকায় অনেকে ধরে রেখেছে। মগজ, কলম, হাত, প্রেস, দোকান, ট্রাংক কি তাক। বই ছিল এবং আছে। পাতা ভরা ছাপা অক্ষরের বইয়ের জীবনপ্রবাহ সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্র বইমুখী হয়ে ওঠুক।
#
লেখক ও গবেষক। animistbangla@gmail.com