’জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’- এমন লিখলেই দেবেন একদল এসে কাউন্টার ন্যারেটিভ কপচান ‘মুসলিম জাতির জনক হযরত ইব্রাহিম( আ:)। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু- মুসলমান আলাদা ’ন্যাশন আইডেন্টিটি’ তেমন পুরনো গল্প নয়। ঐতো ১৮৭৫ এর দিকে দয়ানন্দ বেদভিত্তিক আর্যসমাজ গঠন করলেন, বেদই সত্য আর সব বাতিল- এমনকি হিন্দু ধর্মেরও আর কিছু গ্রহনীয় নয়। বৈদিক যুগের মতো জীবন যাপন করতে হবে। সেই যুগে বর্ণপ্রথা ছিলোনা, তাই এটা বাদ। অচ্চ্যুতদের হিন্দু ভুক্ত করতে হবে। এর সাথে ‘ শুদ্ধি আন্দোলন’ চালু করলেন- ধর্মান্তরিত মুসলমানদের আবার হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনা। এটা নিয়ে লাগলো মুসলমানদের সাথে। পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায় যখন আর্য সমাজের নেতা হলেন তখন পালে হাওয়া লাগলো আরো বেশী, রাজনীতিবিদ হিসাবে তার পরিচয়ের কারনে। লালা লাজপত রায়ই প্রথম উচ্চারন করেন- হিন্দু, মুসলমান আলাদা জাতি।
এদিকে বৃটিশ ভক্ত স্যার সৈয়দ আহমদও তাঁর মুসলিম ওরিয়েন্টাল কলেজ ( পরে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়) গঠন কালে একই কথা বললেন- মুসলমানরা আলাদা জাতি।
আরো পরে রহমতুল্লাহ, কবি ইকবাল হয়ে সেটাকে পুঁজি করলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কংগ্রেসে টিকতে না পেরে তিনি জারী করলেন- টু ন্যাশন থিওরি। মুসলমান আলাদা জাতি, তার জন্য আলাদা রাষ্ট্র। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই ব্যারিষ্টারের জাতিতত্ব সেসময়ের প্রায় সকল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরা শুধু মেনেই নেননি, সারা ভারতের মুসলমানদের তারা এটা বিশ্বাস করিয়ে পাকিস্তান কায়েম করিয়েছিলেন।
অভূতপূর্ব বিষয় হলো- মুসলিম জাতীয়তাবাদ ধারনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দেওবন্দের মওলানারা। বিশেষ করে মওলানা হুসেন আহমদ মাদানী ছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের ছাত্র এবং দুজনেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কারাবন্দী ছিলেন সুদূর মাল্টায়।
হোসেন আহমদ মাদানী ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েই মুসলমানদের বুঝাতে চেয়েছেন- ইসলামে এ ধরনের জাতীয়তাবাদের কোন ধারনা নাই। পৃথিবীর সকল মুসলমান এক উম্মাহ কিন্তু এক জাতি নয়। জাতি গঠিত হয় ভাষা, সংস্কৃতি, মুল্যবোধ, ইতিহাস অনেক কিছুর ভিত্তিতে। সমন্বিত জাতিস্বত্বার ভেতরে মুসলমানরা একটা অংশ হয়ে অতীতে ছিলো, ভবিষ্যতে ও থাকতে পারে। এতেই বরং সে শক্তিশালী থাকবে। আলাদা রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নেই।
টু নেশন থিওরী’র মোকাবেলায় সে সময় তিনি বই লিখেন ‘মুত্তাহেদায়ে কাওমিয়াত আওর ইসলাম’। তাঁর এই বইয়ের ইংরেজী অনুবাদ Composite Nationalism and Islam
মওলানা হোসেন আহমদ মাদানী আওলাদে রসুল অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ(দ:) বংশ ধারার ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর সাথে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মুসলিম লীগের বদলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে বেশী করে সক্রিয় হবার জন্য তিনি মুসলমানদের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সিলেট গনভোটে তিনি ভারতের পক্ষে প্রচারনা চালিয়েছিলেন। সিলেট অঞ্চলে তাঁর প্রভাব ছিলো বেশী, প্রতি বছর রোজার একমাস তিনি সিলেটে কাটাতেন।
উল্লেখ্য সিলেট রেফারেন্ডামে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ভোট দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে।
বাংলাদেশের যে হুজুরেরা নিজেদের দেওবন্দী দাবী করেন, তাঁরা কি মওলানা মাদানীর এই বই পড়েছেন? তাঁরা কী মানেন? কেনো তাহলে তাঁরা মুসলিম জাতি বলে চিৎকার করেন?
(লেখকের ফেইসবুক থেকে নেওয়া)