আমার বন্ধু অঞ্জন আচার্য বাংলাদেশ নিয়ে মাঝে মাঝে খুব হতাশ হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদেশের মুসলমানরাই তার পৈতৃক ভূমি কেড়ে নিয়েছে ময়মনসিংহে। ভিটেমাটি হারানোর বেদনা কত যে কঠিন, যার হারিয়েছে কেবলই সে-ই বোঝে, অন্য কারো পক্ষে বোঝা অসম্ভব। আমি তাকে বলি, আমি হতাশ নই অঞ্জন। এ দেশ নিয়ে আমি মোটেই হতাশ নই। উগ্রবাদ এদেশের জল-মাটি-বাতাসের সঙ্গে যায় না। নদী যেমন ভাঙে, আবার গড়ে; এদেশের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতিও ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়। যখন ভাঙতে শুরু করে তখন মনে হয় এই ভাঙন আর বুঝি থামবে না, সব বুঝি তলিয়ে যাবে। কিন্তু যখন চর জাগিয়ে দিতে শুরু করে তখন কেবল জাগাতেই থাকে, জাগাতেই থাকে বিস্তীর্ণ চর।
প্রায় দশ বছর ধরে যে কৃষ্ণ ভয়ংকরী মেঘ বাংলাদেশের আকাশ ঢেকে রেখেছিল, তা হুট করেই সরে গেল আজ। ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী সংগঠন হেজাজতে ইসলাম বিলুপ্ত ঘোষিত হলো। তার আগে কওমি মাদ্রাসায় সকল ধরণের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করল ‘বেফাক’। কেন সংগঠনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করল? কেন সকল ধরণের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করল? ভয়ে। নিশ্চিতভাবেই ভয়ে। নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয়ে। তারা বুঝে গেছে ধর্ম ধর্ম খেলা অনেক হয়েছে। আর নয়, এবার ঘরে ফেরার পালা। আর খেলতে চাইলে হাত-পা ভাঙা পড়বে।
সবচেয়ে বড় সুখবর, হেফাজতের গোপন আয়ের উৎসের সন্ধান পেয়েছে সরকার। আয়ের পথ বন্ধ হলে সবই বন্ধ হয়ে যাবে। এতদিন কারা অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে হেফাজতকে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। রাষ্ট্র চাইলে কী না পারে! রাষ্ট কত শক্তিমান, তা দেখা গেল হেফাজতের ঘটনায়। অতিকায় বাঘকে রাষ্ট্র বিড়াল বানিয়ে ছেড়ে দিল। আমরা সহজেই বুঝতে পারছি, হেফাজতকে যিনি ছাড়ের পর ছাড় দিয়েছেন, যিনি লাগামটা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তিনিই এখন আবার লাগাম টেনে ধরেছেন। খুব শক্ত করে ধরেছেন। একটু দেরিতে হলেও তিনি দেশটাকে সর্বনাশের হাত থেকে আপাতত বাঁচিয়ে দিলেন।
এখন সময় এসেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। যার ইচ্ছা রাজনীতি করুক। রাজনীতি মানুষের অধিকার। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পৃথিবীর বহু দেশকে নাশ করে দিয়েছে। মসজিদকে ব্যবহার করে রাজনীতি নয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে রাজনীতি নয়। সময় এসেছে ওয়াজের নামে হিংসা ছড়ানোর সভা বন্ধ করার। মুসলমানরা ওয়াজ মাহফিল করুক, হিন্দুরা কীর্তনের আসর করুক। কিন্তু ধর্মসভার নামে হিংসা ছড়ানো বন্ধ করা হোক।
সময় এসেছে রাষ্ট্রধর্ম বিলুপ্ত করার। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছে সকল ধর্মের মানুষ সমান। একটি বিশেষ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম করা হয়, তখন অন্য ধর্মানুসারীদেরকে অপমান করা হয়। রাষ্ট্রের কাছে সকল ধর্ম, গোত্র, বর্ণ সমান। রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করলে মানুষ রাস্তায় নামবে? বিদ্রোহ করবে? অমূলক ভয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক উদ্যোগ। রাজনীতি ঠিক থাকলে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা কোনো ব্যাপারই না। সময় এসেছে শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পাল্টে দেওয়ার। একটি দেশে এত ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কোনো বিকল্প নেই।
স্বকৃত নোমান। কথাসাহিত্যিক।