হাওর ডেস্ক ::
দেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসা অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসাগুলোর অলিখিত নিয়ন্ত্রণ হেফাজতে ইসলামের হাতেই। আর এই সুযোগে মাদ্রাসার নামে আসা যে কোনো সহায়তার অর্থ নিজেদের ভোগ-বিলাসে ব্যয় করতেন হেফাজত নেতারা।এমনকী রোহিঙ্গা সংকটের সময় সহায়তার নামে আসা অর্থও গেছে তাদের পকেটে।
জানা যায়, মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে সরকার নির্ধারিত আলাদা বোর্ড থাকলেও, তা শুধুই নামমাত্র। প্রকৃতপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সিন্ডিকেটের ইচ্ছাতেই পরিচালিত হয় সবকিছু। ফলে সহায়তার অর্থ অনৈতিকভাবে নিজেদের মতো করে খরচ করতেন তারা।
এদিকে, অর্থের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকায় নির্ধারিত বোর্ডকে নিষ্ক্রিয় করে মাদ্রাসায় নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পেরেছেন সহজেই। এর ধারাবাহিকতায় মাদ্রাসার শিশুদের ব্যবহার করে একসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার উচ্চাভিলাসও চেপে বসে এই হেফাজত নেতাদের মনে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশজুড়ে তাণ্ডবের পর হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে নড়ে-চড়ে বসে প্রশাসন। ধারাবাহিক অভিযানে একে একে গ্রেফতার করা হয় দলটির নেতৃত্বস্থানীয়দের। গ্রেফতারদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং দায়ের করা মামলাগুলোর ধারাবাহিক তদন্তে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে উঠে এসেছে আর্থিক গরমিলের তথ্যও।
এতিমদের টাকায় বাড়ি-গাড়ি
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার খরচের যোগান আসে সরকারি-বেসরকারি অনুদান থেকে। যার একটি বড় অংশই দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনের দান-সহায়তার। তবে সেসব অর্থের খরচে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি হেফাজত নেতারা।
মাদ্রাসার অর্থায়নগুলো বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে হয়। তারা মাদ্রাসা কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে হেফাজতের কাছে দান করেন। আর সেসব দানের অর্থ নিজেদের বাড়ি-গাড়ি কেনার কাজে ব্যয় করেছেন। হেফাজত নেতাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাটের পাশাপাশি চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। কিন্তু সেসব বাড়ি-গাড়ি কিনতে অর্থের উৎসের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই তাদের কাছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, এতিমদের সহায়তায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে আসা কোটি কোটি টাকা নিজেদের বাড়ি-গাড়ি কেনা ছাড়াও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণে ব্যবহার করছেন মামুনুল হকসহ হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা হেফাজতের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ওই টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে।
হিসাব নেই রোহিঙ্গা সহায়তার অর্থের
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের সংকটের সময় তাদের সহায়তার জন্য অর্থ সহায়তার আহ্বান করে হেফাজতে ইসলাম। সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে। বিদেশ থেকে আসা টাকার হিসাবে নেই গ্রেফতার হওয়া হেফাজত নেতাদের কাছে।
কী পরিমাণ টাকা এসেছে তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত না হলেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তবে বিপুল পরিমাণ টাকা এসেছে। শুধু মামুনুল হকের অ্যাকাউন্টেই ছয় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কত টাকা এসেছে এবং টাকাগুলো কীভাবে এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, হেফাজতের মূল টাকাটা আসতো দলটির অর্থ সম্পাদক মনির হোসেন কাসেমীর কাছেই। তাকে গ্রেফতারের পর তদন্ত পর্যায়ে লক্ষ্য করেছি হেফাজতের যে অর্থায়ন করা হয় তার মধ্যে অনেক বিদেশি। তার সেসব অর্থ সহায়তার হিসাব রাখার কথা। তবে তদন্তে স্বচ্ছতা পাওয়া যায়নি।
কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থও নয়-ছয়
কোরবানির ঈদ এলেই মাদ্রাসায় এতিমদের সহায়তার জন্য কোরবানির পশুর চামড়া দান করার আহ্বান জানানো হয়। জনসাধারণও মাদ্রাসাগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পশুর চামড়া কিংবা চামড়া বিক্রির অর্থ দান করে দেন। অথচ এই চামড়া বিক্রির অর্থেও নয়-ছয় করেছেন হেফাজত নেতারা। প্রতিবছর চামড়া সংগ্রহ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়েরও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তারা।
কোণঠাসা বেফাক-হায়াতুল উলিয়া
মাদ্রাসা পরিচালনা জন্য সরকার নির্দেশিত বোর্ড বেফাক বা হায়াতুল উলিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হেফাজত নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার এই বোর্ডগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বোর্ডগুলো জিম্মি করে ব্যবহার করা হচ্ছিল নিজেদের স্বার্থে। হেফাজতের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার সংগঠনগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার পাশাপাশি হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ফলে অনেক ভালো আলেম-ওলামারা সেখানে সুযোগ পাচ্ছেন না।
এ ধরনের অর্থ যাদের হাতে চলে যাচ্ছে কিংবা অর্থের নিয়ন্ত্রক যারা, তারাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। আবার ক্ষেত্র বিশেষ তারাই এই টাকাগুলোর মালিক হচ্ছেন। কারণ যার কাছে অর্থ আছে, টাকার বিনিময়ে তারাই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
আর্থিক অনিয়মে হতে পারে আলাদা মামলা
ডিবি পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালের ঘটনায় ১৪টি মামলা ডিবি তদন্ত করছে। পাশাপাশি কিছু নতুন মামলারও তদন্তে অন্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে সময় বলা না গেলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাগুলোর চার্জশিট দাখিল করা হবে। তদন্তে পাওয়া আর্থিক অনিময়ের ঘটনায় হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মাদ্রাসাগুলোতে সহায়তার নামে বিভিন্ন উৎস থেকে যে পরিমাণ সহায়তা আসে তা দিয়ে বেশ ভালোভাবে মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার কথা। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের খুবই নিন্মমানের মানবেতর জীবন-যাপনের তথ্য পাওয়া যায়। অথচ সেসব মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার নামে দানের অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন হেফাজত নেতারা।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, হেফাজতের সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতারের পর বেশ কিছু মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। তদন্তে বিদেশ থেকে আসা মাদ্রাসার জন্য, এতিমখানা ও রোহিঙ্গা ফান্ডের বিপুল পরিমাণ টাকার নয়-ছয় করার তথ্য পাওয়া গেছে। এই টাকাগুলো তাদের হিসেবে সঠিকভাবে রাখা হয় না, হিসেবে আমরা স্বচ্ছতা পাইনি।
তদন্তে বিপুল পরিমাণ টাকা তসরুফের তথ্য মিলেছে। যে টাকায় তারা শান-শওকত বাড়ি-গাড়িসহ আভিজাত্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। যারা এসব অর্থ ব্যবহার ও তসরুফ করছেন তারা নিজেরা যেমন টাকার মালিক হচ্ছে তেমনি সিন্ডিকেট গড়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু মামুনুল হকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত এক বছরে ৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আরো বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট আমরা পেয়েছি। আমরা গভীরভাবে মামলাগুলো তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ করছি। সূত্র : বাংলানিউজ