হাওর ডেস্ক::
জুনের প্রথম সপ্তাহে জ্যেষ্ঠ মাসের শেষ বেলায় যখন বর্ষার পদধ্বনি; ঝড়বৃষ্টির দাপট চলছে, তখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠে-ঘাটে-ছাদে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেড়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর এমন সময়ে ঘরবন্দী থাকার ব্যাপক সচেতনতার মধ্যে বজ্রঝড়ের স্বল্প সময়ে কৃষক, জেলে, তরুণ ও কিশোরের মৃত্যু থামছে না।
এদের মধ্যে কেউ গরু আনতে গিয়েছিলেন মাঠে, কেউ বাড়ির পাশে মাঠে ধান কাটছিলেন, কেউ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলেন, কেউ বাড়ি উঠানে ও স্কুলের মাঠে খেলছিলেন, পাট ক্ষেতে কাজ করছিলেন।
চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, টাঙ্গাইল, রংপুর ও মুন্সীগঞ্জে রোববার বজ্রপাতে অন্তত ১৭ জন মারা গেছে।
‘নেত্রকোনা, নরসিংদী, কুমিল্লা’ মিলে দেশের মধ্যাঞ্চলকে ‘বজ্রপাতের হটস্পট’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদরা। এপ্রিল-মে মাসের পর জুন-জুলাইকেও ‘বজ্রপাতপ্রবণ’ বিবেচনা করে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বজ্রপাতের ‘হটস্পট’
আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান বলেন, দেশে বজ্রপাতের ‘হটস্পট’ হচ্ছে মধ্যাঞ্চল। মার্চ-এপ্রিল-মে মাস বজ্রপাতের জন্য অনকূল পরিবেশ বিরাজের প্রবণতা থাকলেও মৌসুমগত পরিবর্তনের কারণে মে-জুলাইয়েও তা বিস্তৃত হতে পারে।
“তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা পেয়েছি, নেত্রকোনা, নরসিংদী, কুমিল্লা- দেশের এ মধ্যাঞ্চল বজ্রপাতের হটস্পট। বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশের মধ্যে এ অঞ্চলে সাম্প্রতি সময়ে বেশি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।”
বজ্রপাতের এ দুর্যোগে প্রাণহানি ও আহত হওয়া ঠেকাতে মানুষের সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বর্ষার আগমন সময়ে দেশজুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবল থাকে। জুনের প্রথম সপ্তাহে এখন ঢাকার পূর্বাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে তা।
এ আবহাওয়াবিদ বলেন, “ঊর্ধ্বাকাশে এখন প্রচুর জলীয় বাষ্প রয়েছে। এ সময় উত্তর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়াও ধাবমান। একদিক থেকে গরম ও আর্দ্র হাওয়া আর অন্য দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস- এমন পরিস্থিতে বজ্রপাতের ঘটনাই স্বাভাবিক, যা কয়েক ঘণ্টার স্বল্প সময়ের মধ্যে তীব্র রূপ নেয়।”
তিনি জানান, সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে বজ্রপাতের প্রবণতা দেখা যায়। সেই সঙ্গে মৌসুমগত আবহাওয়ার পবির্তনের সময়েও বজ্রপাতের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ জন্যে জুন-জুলাইয়েও বজ্রপাতের বড় ঘটনা ঘটে থাকে।
বজ্রপাত ঘনঘটার তীব্রতা
মান্নান জানান, বজ্রপাতের এ মৌসুমে ‘সিগনিফিক্যান্ট’ ঘটনা দেখা যায় ৪ এপ্রিল। ওই মাসে হাতে গোনা চারদিন এমন ঘটেছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ছিল না; মে মাসে প্রতিদিন কোনো না কোনো অঞ্চলে বজ্রপাতের ঘটনা রয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বজ্রপাতের তীব্রতা বেড়েছে। ‘ইভেন্টের পার্টিকুলার ডে বা শর্ট পিরিয়ডে’ বেশি বজ্রপাত বৈশিষ্ট বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে বজ্রপাতের এমন ঘটনাকে ‘শর্ট লিফট লাইটেনিং ফেনোমেনা’ বলা হয়- এর ঘনঘটা বাড়ছে।
এ আবহাওয়াবিদের মতে, যেখানে ১২-১৫ দিন হওয়ার কথা, সেখানে হয়ত ৩১ দিনই বজ্রপাতের ঘটনা রয়েছে কোনো না কোনো জায়গায়। কোনোদিন কম, কোনো দিন বেশি তীব্রতা ছিল। তার মানে এ ‘ফেনোমেনার’ ধারাবাহিক ‘বিহেভিয়ারের’ মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে।
রোববারের বৃষ্টি ও ঝড়ের প্রসঙ্গ টেনে মান্নান বলেন, “রোববারের বজ্রপাতের পর কয়েকদফা বৃষ্টিও হয়েছে, রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেছে। পরপর বজ্রপাত ঘটছে; মানুষেরও কিছু করার থাকে না। ”
সচেতন না হলে আবহাওয়াগত এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।
হাওরে ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক জানান, বজ্রপাত নিরোধক ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ স্থাপনা করার পাশাপাশি ‘আর্লিওয়ার্নিংয়ের’ সর্বশেষ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে প্রচেষ্টা রয়েছে।
তিনি জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে ৭-৮টি জায়গায় বজ্রপাত ডিটেকটিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত হচ্ছে। যেসব জায়গায় বেশি বজ্রপাত হচ্ছে সেসব এলাকায় বজ্রপাতনিরোধক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য জোর দেওয়া হবে।
“আগাম বার্তা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের প্রজেক্টেও যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নেওয়া হয়েছে। চলনবিল ও বরেন্দ্র এলাকায় বজ্রপাত নিরোধক স্থাপনা করা হবে।”
খোলা জায়গায় উঁচু গাছ থাকলে তাতে বজ্রপাতবাহিত হয়ে তা ভূমি স্পর্শ করবে। তালগাছ সাধারণ সবচেয়ে উঁচু হয়ে থাকে। বজ্রপাতে ক্ষয়কত্ষতি কমাতে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারকেল গাছ রোপণ করার উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।
তাল গাছ লাগানোর উদ্যোগের বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, “এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”
ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরিতেও সরকারের উদ্যোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
বজ্রপাত কেন, সচেতনতা
ব্যাংককের রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের জলবায়ু ও দুর্যোগ ড. মোহন কুমার দাশ জানান, কালবৈশাখী তুলনামুলক কম হলেও বজ্রপাতের ঘটনা রয়েছে বেশ। সুনির্দিষ্ট সময়ে বজ্রপাতের বিষয়ে আগাম পূর্বাভাসের অভাব ও মানুষের অসচেতনতার কারণে হতাহতের ঘটনা বেড়েছে।
বজ্রঝড়ের সময় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বজ্রপাতের ভয় থাকে। কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত শুরুর অন্তত আধ ঘণ্টা সময় সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হয়, তখনই বজ্রঝড় হয়ে থাকে। কিউমুলোনিম্বাস মেঘ হচ্ছে খাড়াভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশাল আকৃতির পরিচালন মেঘ; যা থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকানো নয়, বজ্রপাত-ভারি বর্ষণ-শিলাবৃষ্টি-দমকা-ঝড়ো হাওয়া এমনকি টর্নেডোও সৃষ্টি হতে পারে।
বায়ুমণ্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-ভাগের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। এ অবস্থায় বেশ গরম আবহাওয়া দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম আবহাওয়া দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়ায় প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়।
বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে হতাহতের সংখ্যা বেশি থাকত। জুন মাসের প্রথমার্ধেও সাম্প্রতি বছরে প্রবণতা বেড়েছে।
২০১৬ সালে মে মাসে এক দিনে ৩৩ জনের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। পাঁচ বছর আগে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার।
বজ্রপাত নিয়ে জনসচেতনা তৈরিতে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডার অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেলের নির্বাহী প্রধান আব্দুল আলীম বলেন, “গণমাধ্যমের তথ্য পযালোচনা করে আমরা দেখেছি- লকডাউনের মধ্যে ৬ জুন একদিনেই অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। বরাবরের মতো কৃষকের সংখ্যাই বেশি, তারপর জেলে, এরপর ছাদে-মাঠে খেলারত শিশু। ঘরের মধ্যে থাকার কথা থাকলেও অসচেতনতার কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গেল বছর ৪ জুনে অন্তত ২১ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে।”
সংস্থাটির মতে, ২০১৯ সালে মে-জুনে বজ্রপাতে মারা গেছে অন্তত ১২৬ জন, ২০২০ সালে জানুয়ারি- এপ্রিল অন্তত ৮১ জন আর এ বছর এখন পযন্ত শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা রয়েছে।
বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বিদ্যুৎস্পর্শের সম্ভাবনা বেশি থাকে। বজ্রপাতের সময় পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে এবং উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। এ সময় জানালা থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলা, টিভি-ফ্রিজ না ধরা, গাড়ির ভেতর অবস্থান না করা এবং খালি পায়ে না থাকারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ৮টি অঞ্চলে স্থানে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র (ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, পঞ্চগড়, নওগাঁ, খুলনা পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর) রয়েছে।
বজ্রপাতের সময় ছাদে, মাঠে, ঘাটে, খোলা জায়গায় যাওয়া বারণ এবং সচেতনতামূলক নির্দেশনা মানারও পরামর্শ দেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।