1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

নিষ্ঠুর সেজান জুস।। পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১, ৫.৪৮ পিএম
  • ২৪৩ বার পড়া হয়েছে

‘আসল’ শব্দের বিপরীত শব্দ কী? কোনো দৃশ্যমান উপাদান বা এমনকি কোনো ঘটনা হলেও আসলের বিপরীতে আমরা ব্যবহার করি ‘নকল’। কিন্তু খাবারের বেলায় ‘আসল’ বিশেষণটির কোনো দরকার আছে কী। খাবার মানেই খাবার। নিরাপদ, পুষ্টিকর, ন্যায্য এবং ভাল। মা যখন শিশুকে ভাত খাওয়ায় তখন বলে কী, এটি আসল ভাত। গ্রামীণ জনপদে কেউ কী বলে এটি আসল ভাপা পিঠা বা আসল মধু বা আসল আখের গুড়। কারণ পিঠা, মধু কী গুড় তো পিঠা, মধু বা গুড়ই। বিপদজনক রাসায়নিক কী বর্জ্য দিয়ে পিঠা, মধু কী গুড়ের মতো দেখতে ‘নকল জিনিস’ বানানো যেতে পারে কিন্তু সেসব তো আর পিঠা বা মধু কী গুড় নয়। সেগুলো নকল ভেজাল ভিন্ন পণ্য। মিথ্যা নাম আর প্রতারণার ঝলক দিলেই কোনোকিছু আসল হয়ে যায় না। আসল খাবারকে বলতে হয় না সে ‘আসল’। মুক্তাগাছার আদি মন্ডা কারিগর কখনোই বলেনি এটি ‘আসল মন্ডা’। কুমিল্লার রসমালাই, বগুড়ার দই, জামতলার রসগোল্লা কী কালিয়াকৈরের ধনীর চিড়ার আদি কারিগর কখনোই ‘আসল’ নামের কোনো বিজ্ঞাপন ক্রেতা-ভোক্তার সামনে আননেনি। আনতে হয়নি। ‘আসলের’ মিথ্যা ছবক তাদেরই লাগাতে হয়, যার বিক্রিত পণ্যটি আদতেই মিথ্যায় ভরপুর, বিপদজনক এবং বেআইনী। নয়াউদারবাদী করপোরেট বাজারে তাই ‘আসলের’ মিথ্যা প্রলোভন। বিশেষ করে দেশে উৎপাদিত নানা কোম্পানির ‘ফলের জুস’ গুলোকে অন্যায়ভাবে ভোক্তার কাছে ‘আসল’ বলে বিক্রি করা হয়। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাস্তার বিলবোর্ড সয়লাব হয়ে যায় এসব কোম্পানির মিথ্যা বিজ্ঞাপনে। এর সাথে জনস্বাস্থ্য, খাদ্যরুচি, পুষ্টি, দেশীয় অর্থনীতির বিকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। জড়িয়ে আছে শ্রেণি ক্ষমতার রাজনৈতিক বলয় আর নির্দয় মুনাফার ময়দান। প্রশ্নহীনভাবে তাই ‘সেজান জুস’ একটি ‘আসল জুস’ হিসেবে নিজের বিজ্ঞাপন দেয়ার বাহাদুরি দেখায়। আসলেই কী সেজান জুস আসল জুস? কিংবা দেশে উৎপাদিত ও বিক্রিত অন্যান্য সকল কোম্পানির জুস? রাষ্ট্রের ভ্রাম্যমাণ আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কী গণমাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এই ‘আসল জুসের’ মিথ্যাচার। তারপরও বহাল তবিয়তে চলছে সেজান জুসের ‘আসল’ বাজার। এর ভেতর এই জুস কারখানায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ৫৩ জন তাজা প্রাণ। দমকল বাহিনী ও গণমাধ্যম পুড়ে যাওয়া কারখানায় জুড়ে প্লাস্টিক, পলিথিন আর বহু রাসায়নিক বোঝাই দেখতে পেয়েছেন। একটি ‘আসল জুসের’ কারখানায় এতো রাসায়নিক কেন? এমনকি কারখানাটিকে বহু শিশুশ্রমিকের কাজের হদিশ মিলছে। শিশুশ্রম বহাল রেখে একটি কারখানা কিভাবে ‘আসল’ জুস উৎপাদন করে? এমনকি অগ্নিকান্ডের পর কারখানা কর্তৃপক্ষ গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। নারায়নগঞ্জে অবস্থিত এই জুস কারখানার কাঁচামাল আসে বাইরে থেকে, সেই কাঁচামালও পঁচা ও বিপদজনক বলে প্রমাণ করেছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাহলে পঁচা ও ভেজাল কাঁচামাল, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক বোঝাই কারখানা আর শ্রমিকের প্রতি অবিচার নিয়ে কীভাবে একটি জুস রাষ্ট্রে ‘আসল জুস’ হিসেবে ব্যবসা করে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি আর এটি কেবল একটি জুসের মিথ্যাচারের বিষয় নয়, সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডে অঙ্গার হওয়া শ্রমিকের ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে করপোরটে এজেন্সির ক্ষমতা বনাম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অঙ্গীকার। সেজান জুসের কারখানায় পুড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আজ হিসাব করা যাচ্ছে, কিন্তু এসব কোম্পানির প্রশ্নহীন বিপদজনক খাদ্যপণ্য খেয়ে দেশের কত অগণিত প্রাণ প্রতিদিন মরছে তার হিসাব করবে কে? জনস্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা এবং পরিবেশপ্রশ্নকে আমলে না নিয়ে আর কতদিন কতভাবে সেজান জুসেরা ‘আসল’ জুসের মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করবে? আমরা দৃঢ়ভাবে চাই সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। নিহত, আহত সকল শ্রমিকের পরিবারের আজীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হোক সজীব গ্রুপ। একটি খাদ্যপণ্যের কারখানা কেন রাসায়নিক ও প্লাস্টিকে ভরপুর, কেন এখানে শিশুশ্রম এসব প্রশ্নের নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। কোম্পানির প্রতিটি খাদ্যপণ্যের কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ. মজুতকরণ কী বাজারজাত সবকিছুই কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক।
সেজান জুসের পাল্প ও জরিমানা
সেজান জুস সজীব গ্রুপের একটি বহুল বিক্রিত পণ্য। ৭ জুলাই ২০২১ রাতে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত এই জুসের ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানি’ নামের কারখানাটিতে আগুন লাগে এখানে জুসের কাঁচামাল ‘আমের পাল্প’ তৈরি হয় না। এই পাল্প তৈরি হয় আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চব্বিশনগর গ্রামে। বরেন্দ্র এলাকার ঐতিহাসিক ঢেউখেলানো কৃষিজমির রূপ পরিবর্তন করে ২০১২ সনে প্রায় ১২ বিঘা জমির উপর সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘হাসেম এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড’ একটি কারখানা তৈরি করে। এখানেই তৈরি হয় সেজান জুসের কথিত আমের পাল্প বা মন্ড। এছাড়াও এখানে ‘সজীব টমেটো ক্যাচাপ’ ও ‘সজীব কুলসুন সেমাই’ তৈরি হয়। গ্রামবাসীর অভিযোগ পঁচা আম দিয়ে এখানে পাল্প তৈরি হয়, আশেপাশের গ্রামবাসী তাই তাদের বাচ্চাকে কখনো এই সেজান জুস কিনে দেন না (সূত্র: বাংলানিউজ২৪ডটকম, ২৪/৭/২০১৬)। ২০১৬ সনের ২১ জুলাই গোদাগাড়ীর সারেংপুরে বিপুল পরিমাণ পঁচা আমের চালান আটক করে পুলিশ। পরবর্তীতে সেজান জুসের কথিত এই পাল্প তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েও বিপুল পরিমাণ পঁচা আম উদ্ধার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই তারিখে পঁচা আম দিয়ে জুস তৈরির অভিযোগে সেজান জুসের এই পাল্প তৈরির কারখানাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আচ্ছা পঁচা আম দিয়ে না হয় পাল্প বানানো হলো তারপর কী হয়? কী আছে এই ‘আসল জুসে’?
সেজান জুস ও বুয়েটের পরীক্ষা
বাংলাদেশে পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই পণ্যের মানতালিকা তৈরি করে। এই মান অনুযায়ী জুসের ক্ষেত্রে বোতলে ৮০-১০০ ভাগ পাল্প বা আসল ফলের রস থাকা দরকার। আর ড্রিংক হলে কমপক্ষে ১০ ভাগ আসল ফলের রস থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো এই ‘আসল সেজান জুসে’ কতটুকু ফলের রস আছে? ২০১৭ সনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশে তৈরি এএসটি লিমিটেড কোম্পানির ‘ম্যাংগো কিং’, প্রাণ কোম্পারি ‘ফ্রুটিক্স’, সজীব গ্রুপের ‘সেজান ম্যাংগো জুস’ এবং আকিজ গ্রুপের ‘আফি’ এই চারটি জুস তাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে। ১২/১০/২০১৭ সনে প্রকাশিত বুয়েটের সেই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় উল্লিখিত চারটি জুসেই মাত্র ৪ থেকে ৬ ভাগ পাল্প আছে, যা বিএসটিআই এর মানমাত্রা থেকে অনেক কম। ‘আসল জুস’ হিসেবে মিথ্যাচার করা সেজান জুসে পাল্প পাওয়া গেছে মাত্র ৫.৪ ভাগ। গড়ে ৫ শতাংশ পাল্প থাকার কারণে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিল তখন সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
দাহ্য রাসায়নিক ও অঙ্গার জীবন
এখন দেখা যাক কারখানাটিতে কী ঘটে, কারখানার পরিবেশ কেমন? সাম্প্রতিক এই নিদারুণ অগ্নিকান্ডের মাধ্যমেই সেজান জুসের কারখানার নানা মিথ্যাচার সামনে চলে এলো। গণমাধ্যম জানায় ছয়তালা কারখানাটির নিচতালায় বিভিন্ন পণ্যের কার্টন রাখা হতো। এক পাশে মেকারনি ও নুডলস তৈরির সেকশন। দ্বিতীয় তলায় টোস্ট, বিস্কুটসহ বেকারিপণ্য তৈরি হতো। তৃতীয় তলায় লাচ্ছা সেমাই ও জুস তৈরির মেশিন। চতুর্থ তলায় চকলেট, ললিপপ ও চকোচকো তৈরির মেশিন। পাঁচ তলায় চানাচুর ও ছয় তলায় গুদাম এবং ছাদেও ছিল গুদাম। আগুন লাগার পর শ্রমিকদের বের হতে দেয়া হয়নি, গেটে তালা লাগিয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠেছে। আশেপাশের মানুষ অঙ্গার হতে থাকা শিশুশ্রমিকদের বাঁচানোর আর্তি শুনেছেন। কিছু শ্রমিক তালা ভেঙে ছাদে গিয়ে বাঁচতে পেরেছে। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট জানবাজি রেখে কাজ করলেও পুরো আগুন নেভাতে অনেক সময় লেগেছে। কেন এত সময় লাগলো? কারণ এই খাদ্য কারখানা বোঝাই ছিল দাহ্য প্লাস্টিক ও রাসায়নিক। ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আটজনকে আটক করেছে পুলিশ। আশা করবো ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
তাজরীন গার্মেন্টস কী নিমতলীতে অঙ্গার হওয়া জীবনের মতোই এক ‘অগ্নি দূর্ঘটনা’ হিসেবে আমরা একসময় কী এটি ভুলে যাব? আবার সকাল হবে, আমরা দোকানে গিয়ে সজীবের আটা-ময়দা কিনে আনবো, বিকেলে বাসায় সজীব নুডলস দিয়ে বন্ধুকে আপ্যায়ন করবো আর প্রিয় শিশুর হাতে তুলে দিব ‘আসল’ সেজান জুস। অঙ্গার হওয়া শিশুশ্রমিকের পোড়া রক্তের ঝাঁঝ ‘আসল’ সেজান জুসে হয়তো টের পাবে না আমাদের শিশুরা, হয়তো কোম্পানি তাতে মিশিয়ে দেবে আরো বিপদজনক কোনো কৃত্রিম গন্ধ। বদলে ফেলবে মোড়ক, তৈরি করবে নতুন বিজ্ঞাপন। কিন্তু মিথ্যাচার স্থায়ী হয় না, সত্য প্রমাণিত হয়ে ওঠে। পঁচা আম থেকে শুরু করে বিপদজনক রাসায়নিক কিংবা কারখানায় শিশুশ্রমিক কী আগুন লাগার পরও গেটে তালা শ্রমিক পুড়িয়ে মারা সবই একইসূত্রে গাঁথা। এই বাহাদুরি নয়াউদারবাদী করপোরেট মুনাফার বাহাদুরি। রাষ্ট্রকে এই বাহাদুরি প্রশ্ন করতে হবে। অঙ্গার হওয়া জীবনের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, শ্রমিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশপ্রশ্নে ‘আসল’ সেজান জুসসহ সকল খাদ্যপণ্য কোম্পানিকে জনজবাবদিহিতার ময়দানে দাঁড় করাতে হবে। তাহলেই পঁচা আমের পাল্প দিয়ে জুস বা কারখানায় শ্রমিক পুড়িয়ে অঙ্গার নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে।
………………………………………………………………..
গবেষক ও লেখক। animistbangla@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!