অমোঘ মৃত্যুকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে/আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে’। নিঃস্বীম আকাশতারা চটজলদি জীবন শুরুর আগেই এক তরুণকে কেন এভাবে ডেকে নিয়ে যাবে? অসময়ে কেন ঝরবে ভোরের বকুল? পরিণত বয়সে মৃত্যুকে জীবনের অপর নাম আখ্যা দিয়ে বিশ্বকবি অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্নীয়রূপে দেখেছিলেন। যারা ভালোভাবে মহাপৃথিবীর স্বাদ, রূপ, রস গন্ধ উপভোগ করতে পারেনি তাদেরকে চিরায়ত মৃত্যু অবেলায় ডাকবে কেন? কিন্তু অতিমারি করোনা আমাদের সব ভাবনা-চিন্তাকে উল্টে দিয়ে প্রতিদিনই প্রিয়জনদের কেড়ে নিচ্ছে। আমরা থম মেরে থ হয়ে কেবল দেখছি যাওয়ার মিছিল। আর চোখে অশ্রুগঙা বইয়ে স্মরণ করছি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। মায়ার মানুষরা দেখবেনা তাদের তরে আমাদের নিষ্ফল মায়াকান্না!
যাপিত জীবনে চলনে-বলনে কনিজ রেহনুমা রব্বানী ভাষা ছিল তার সজ্জন বাবা জননেতা গোলাম রব্বানীর অবিকল। তার কথার ঢঙ বা স্টাইল ছিল তার গুণি বাবার মতোই। আমাদের সময়ের বহুমুখি মেধার এক প্রোজ্জ্বল চরিত্র ছিল ভাষা। ভাষার মতোই গতিশীল ও প্রাণসঞ্চারি ছিল সে। প্রাণখোলা-স্বতস্ফুর্ত এক মানবিক চরিত্রের সম্ভাবনাময় তরুণ। হঠাৎ এভাবে সে চলে যাবে ভাবনাতে আনতেও বাধে। জীবনের চরম সত্য মৃত্যু-ছিনিয়ে নিলো ভাষাকে। অতিমারি করোনা বিভিন্ন বয়সের পরিচিতজনদের এভাবেই ছো মেরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এক ভয়াবহ ব্যাধিকাল পার করছি আমরা। কে কোন সময় নাই হয়ে যাব বলতে পারছেনা কেউ। ভাষাহীন নির্বাক আমি সজল চোখে ভাষার হাসি হাসি মুখ কল্পনা করছি। ভেতরের রক্তক্ষরণ উগ্রে দিচ্ছে বিভিন্ন সময়ের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি। জলে ঝাপসা চোখ স্মৃতিকে আরো ঝাপসা করে তোলছে।
বুধবার ফেইসবুকে সাতসকালে ভাষা রেহনুমার মৃত্যুর সচিত্র খবর পরিচিত অনেকজনের টাইমলাইনে ভাসতে দেখি। মহাসাগরে যেন বেদনার বার্তা বইছিল যেন। বেদনার ঢেউ ছুয়ে যাচ্ছিল হৃদয় গহন। এই খবরে আমার রক্তমাংস হিম হয়ে যায়। আমার শারিরিক-মানসিক স্পন্দন উধাও হয়ে যায় মুহুর্তের জন্য। বিশ্বাস হচ্ছিলনা কিছুতেই। কিন্তু একাধিক বিশ্বস্থ মানুষের টাইমলাইনে দেখে বিশ্বাস করতে হয় চরম সত্যকে–আমাদের ভাষা আর নেই, মেনে নিতে হয়।
একটি বইয়ের প্রকাশনার কাজে গত ১১ জুলাই সিলেট গিয়েছিলাম। প্রকাশক বন্ধু কবি রাজীব চৌধুরী জানিয়েছিল ভাষা করোনা পজেটিভ। একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে আছে। তার বয়স বিবেচনায় আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম ভাষা ফিরে আসবে। ওই দিন সন্ধ্যায়ই সিলেটে প্রথম আলো অফিসে গেলে অফিস প্রধান উজ্জ্বল মেহেদী ভাইও আবার ভাষার করোনা পজেটিভের কথা জানান। ভাষাকে নিয়ে তখন তিনি নানা সময়ের স্মৃতিচারণ করেন। তার উচ্ছ্বলতা, স্বতস্ফুর্ততা নিয়ে কথা বলেন। আমিও এই গল্পের জেরে ভাষার প্রাণবন্ত ছবিটাই কল্পনা করেছিলাম। ভাষা আমাদের মাঝে শিগ্রই ফিরে আসবে কায়মনে সেটাই চেয়েছিলাম।
তিন বছর আগে দৈনিক সুনামকণ্ঠে তার মা সংরক্ষিত আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য শামসুন্নাহার শাহানা আপাকে নিয়ে এসেছিল ভাষা। আমাদের অফিস রুমে জম্পেস আড্ডা হয়। নানা কথায় মাতিয়ে রাখে ভাষা। কারো কোন কিছু প্রয়োজন থাকলে অকপটে বলার অনুরোধ জানিয়ে তার সংসদ সদস্য মায়ের মাধ্যমে পূর্ণ করার কথাও জানায়। যাবার সময় বাইরে এসে আমাকে তার পাশে দাড়িয়ে শাহানা আপাসহ অফিসের কয়েকজনকে নিয়ে তার মোবাইলে একটি সেল্ফি তুলে। কিছুক্ষণ পরে সেল্ফির ছবিটি পোস্ট করে আমাকেও ট্যাগ করে। এরপর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে ফেইসবুকে ম্যাসেঞ্জারে মাঝে-মধ্যে অল্পস্বল্প কথা হতো। ফেইসবুকে প্রায়ই সে তার হাস্যজোজ্বল ও প্রাণবন্ত ছবি দিয়ে সুখ পেতো। আমি ছবিগুলোতে কমেন্ট লাইক করতাম। মাঝে-মধ্যে ফোনেও কথা হতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতো। তার মান অভিমান লক্ষ্য করতাম।
২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল ‘কিশোরীর বেতগোটা চোখে সন্ধ্যার বিষন্নতা’ নামে ২০০৫ সনে একটি লিটলম্যাগে প্রকাশিত আমার একটি কবিতা ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে তুমুল প্রশংসা করে ভাষা। টানা দীর্ঘ গদ্য কবিতাটির প্রথমাংশ ও শেষাংস তার খুবই পছন্দ হয়েছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। আমি কেন নিয়মিত কবিতা চর্চা করছিনা আক্ষেপ প্রকাশ করে নিয়মিত লেখার তাড়া দেয়। সে যে নন্দন ভুবনের বাসিন্দা ও কবিতা ও সাহিত্যের সমঝদার ওই দিন ঠের পাই।
ভাষা অকালে চলে গিয়ে আমাদের ভাষাহীন নির্বাক করে গেছে। তার আত্নার শান্তি কামনা করি। শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
shamsshamim1@gmail.com