বারসিকনিউজ ডেস্ক
কৃষিতে যুবদের আগ্রহী করে তোলার জন্য কৃষিকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভবে মর্যাদা দিতে হবে এবং কৃষিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক কৃষি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে বারসিক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র যৌথ উদ্যোগে আজ ১১ আগস্টে অনুষ্ঠিত ‘খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর ও তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা’ শীর্ষক এক অনলাইন নাগরিক সংলাপে উপরোক্ত দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।
অনলাইন নাগরিক সংলাপে প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ‘কৃষিতে তরুণদের আগ্রহ তৈরির জন্য কৃষিকে প্রথমেই পারিবারিকভাবে মর্যাদা দিতে হবে। কৃষিকে আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদা দিই না। কৃষক পরিবারের সন্তানরা কখনও চান না তার সন্তান কৃষক হোক। তাই কৃষিকে মর্যাদা দেওয়ার কাজ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের সবার কল্যাণে কৃষির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তরুণদের কাছে তুলে ধরতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তরে যুবদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য কৃষিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও মর্যাদা দিতে হবে এবং কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। কৃষি খাতকে যদি পরিবারিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে তরুণরাও কৃষিতে আগ্রহী হবে। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সার তৈরি থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত তরুণরা যদি সম্পৃক্ত থাকে তাহলে এ খাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তারা ভূমিকা রাখতে পারে। এই খাতে যুবদের আগ্রহী তোলার ক্ষেত্রে সরকারকে ভাবতে হবে, স্বল্পসুদে ঋণ দিতে পারে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে প্রণোদনা দিতে হবে এবং কৃষিপণ্যের ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।’ আব্দুস সোবহান বলেন, ‘শুধু চাকুরির পিছনে না ঘুরে যুবকদেরকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশে এক তৃতীয়াংশ হচ্ছে যুব সমাজ। তারা সবাই কর্মক্ষম। তাদের কাজে লাগাতে। তাদেরেক আমরা যদি কাজ লাগাতে পারি তাহলে অবশ্যই আমরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারবো এবং খাদ্য রূপান্তরে তারা ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে।’
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘কৃষিতে যুবকদের সম্পৃক্ত বাড়াতে হবে। কৃষিকে লাভজনক পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে কৃষকের জন্য পেনশন স্কিম চালু করতে হবে যাতে তরুণরা এই খাতকে সন্মান করে। এছাড়া শুধু খাদ্য উৎপাদনের দিকে নয় বরং কীভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা যায় সেদিকেও নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণরা এগিয়ে আসতে পারে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য তাদেরকে নানানভাবে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে।’
শরীফুল হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনীতি প্রবাসী আয়, কৃষি এবং পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ তিনটি খাত না থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অচল হবে। এ তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কৃষিখাতের উৎপাদন যদি ঊহৃ হয় তাহলে টাকা থাকলেও আমরা খাবার পাব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ উর্বর দেশ। এখানে সার বিষ ছাড়াও ফসল উৎপাদন করা যায়। লেবাননসহ অন্যান্য দেশে খাদ্যের দাম অনেক বেশি অথচ আমাদের দেশে আমরা এখনও সুলভমূল্যে খাদ্য পাচ্ছি। তাই কৃষি ও কৃষকদের মর্যাদা দিতে হবে। মর্যাদা দিলে তরুণরাও কৃষিতে আগ্রহী হবে। কৃষি ছাড়া এই রাষ্ট্রের বিকল্প কিছু নেই। তাই কৃষি ও কৃষককে সন্মান করতে হবে।’
বারসিক’র পরিচালক পাভেল পার্থ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% এবং শহরের ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার আছে। রাষ্ট্র এখনো কৃষিকে দেখে খাদ্য উৎপাদনের মূলখাত হিসেবে। সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ‘ভিশন ২০২১’ গ্রহণ করে। তবে কৃষি কেবলমাত্র এককভাবে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নয়; দেশের মানুষের আয় এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি প্রতিটি বাস্তুসংস্থানের অপরাপর জীবিত প্রাণসত্তার বেঁচে থাকাকে সহায়তা করে। জাতীয় খাদ্য নীতির মূল লক্ষ্য সকল নাগরিকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর করোনা মহামারীকালে যুব দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরে তরুণ সমাজের সৃজনশীল ভূমিকার প্রসঙ্গ। তরুণদের এই সক্রিয় সৃজনশীল ভূমিকাই মানুষ ও পৃথিবীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বৈচিত্র্যময় খাদ্যব্যবস্থা সবার জন্য উপহার দিতে পারে। এখনো বাংলাদেশের শহর-গ্রামে কৃষি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ নানামুখী সামাজিক কাজের সাথে যুবরাই নানাভাবে জড়িত। গ্রামে যুবরা যেমন কৃষি উৎপাদনে জড়িত আবার নতুনভাবে শহরে নানাভাবে নিরাপদ প্রাকৃতিক খাদ্যনির্ভর যুবদের উদ্যোগ গড়ে ওঠেছে। তবে সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থায় উৎপাদক, ক্রেতা, বিক্রেতা, ভোক্তা, গবেষক, নীতিনির্ধারক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, কৃষক সকলের এক যৌথ সমন্বয় জরুরি।’
রাজশাহীর তরুণ শেখ তাসনিম জামাল বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণরা নানাভাবে জড়িত। পতিত জমি ও ছাদে তারা কৃষিকাজ করেন। তবে কৃষিতে কৃষকের স্বীকৃতি না থাকায় তরুণ কৃষিতে আগ্রহী হয় না। এছাড়া কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না থাকার কারণেও তরুণরা কৃষিতে আগ্রহী হয় না। তাই কৃষিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক কৃষিশিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।’
প্রাকৃতিক কৃষির দেলোয়ার জাহান বলেন, ‘তরুণরা বেশির ভাগই শহরমূখী হতে চায়। গ্রামের বাড়ির যে সম্পদ রয়েছে সেটা ব্যবহার করতে জানে না তারা। অন্যদিকে িিকছু তরুণ আছে তারা তাদের এলাকার পরিবেশ, প্রকৃতি, ভূমি বিবেচনা না করেই কৃষিতে যুক্ত হয়। তাই সেই কৃষিতে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কারণ এসব কৃষির উপকরণ তাদেরকে বাইরে থেকে কিনতে হয় বলে। প্রাকৃতিক কৃষির চর্চা করলে যে পণ্য উৎপাদিত হয় সেটি নিরাপদ এবং কৃষিও নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
অনলাইন নাগরিক সংলাপে আরও আলোচনা করেন পরিবেশ বার্তার সম্পাদক নেত্রকোনার যুবক ইফতিখার আলম ও নেত্রী দিপালী আক্তার, রাজশাহী আদিবাসী নেত্রী সাবিত্রী হেমব্রম ও তরুণ রুবেল হোসেন, সাতক্ষীরার তরুণ নারী উদ্যোক্তা শিরীন সীমা, অনলাইন নিরাপদ খাদ্য সংগঠক মিনার ক্ষেত’র তাহমিনা আহমেদ প্রমুখ।
সংলাপে পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং পবার সম্পাদক মেসবাহ সুমনের সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান, ব্যাক’র মাইগ্রেশন’র প্রোগ্রাম হেড ও সাংবাদিক শরীফুল হাসান, অভিনয় শিল্পী সুমনা সোমা, পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, প্রাকৃতিক কৃষির দেলোয়ার জাহান, অর্গানিক বাংলার হুমায়ুন কবির, নেত্রকোনার অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের সভাপতি দিপালী আক্তার, মানিকগঞ্জের কনকলতা কিশোরী ক্লাবের সভাপতি তানিয় আক্তার, সাতক্ষীরার সিডিও নারী উদোক্তা কেন্দ্রের শিরিন সীমা এবং আদিবাসী ছাত্র পরিষদেও সহ-সভাপতি সাবিত্রী হেম্ব্রম। সংলাপে বারসিক পরিচালক পাভেল পার্থ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনলাইন এই নাগরিক সংলাপে বাংলাদেশের নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৭৫ জন তরুণ, তরুণী, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী এবং বারসিক’র বিভিন্ন এলাকার কর্মী অংশগ্রহণ করেন।
সুপারিশসমূহ:
১. আমাদের সমাজে কৃষি পেশাকে এখনো সম্মানের চোখে দেখা না, তাই ু তরুণ কৃষি পেশায় যেতে অনাগ্রহ দেখায়। তরুণদের কৃষি পেশাকে বিশেষ সুবিধা ও মর্যাদা দিতে তরুণদের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি পদক এর ব্যবস্থা করতে হবে।
২. নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও তৈরীতে যেসকল উপকরণ দরকার যেমন ভার্মী কম্পোস্ট, জৈব বালাইনাসক , জৈবসার তৈরী ইত্যাদিতে তরুণদের কারিগড়ি জ্ঞান দক্ষতা বাড়াতে তাদের সহযোগীতা বাড়াতে হবে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং কৃষি উৎপাদনের জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋনের সুবিধা আর্থিক সুবিধার ব্যববস্থা করতে হবে।
।
৩. উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্য বাজারজাতকরণ ও পরিবেশন ও পরিবহনে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট স্থান/দোকানের ব্যবস্থা রাখা। ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্য সংরক্ষাণাগার তৈরী করতে হবে।
৪. জাতীয় বাজেটে যুবদের কৃষি কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আলাদা ভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে।
৫. নিরাপদ খাদ্য আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি বাড়িকে পুষ্টিাবাড়ি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কৃষিপণ্যের অনিশ্চিত ন্যায্যবাজার রুখতে হবে।
৬. ২০১৮ সনের জাতীয় কৃষিনীতিতে‘‘কৃষিতে যুবশক্তি’’ শিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় (ধারা-১৪) যুক্ত করা হয়েছে । যা বাস্তবায়নে সরকারী সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজনে অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয় তরুণ কৃষি নীতি চালু করতে হবে।
৭. গ্রাম ও শহরের যুবদের জন্য বিদ্যমান নাগরিক সুবিধার যে বিরাট বৈষম্য রয়েছে তা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।