তমাল পোদ্দার, ছাতকঃ
বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র কংক্রিট স্লিপার কারখানাটি ৩ মাস ধরে বন্ধ। কাঁচামাল প্রাপ্তির সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তার পরও রহস্যজনক কারনে বন্ধ রয়েছে সুনামগঞ্জের ছাতকে রেলওয়ের একমাত্র কংক্রিট স্লিপার কারখানাটি। এ করুণ দশার মূল কারন দুর্নীতি। ঠিকাদার থেকে শুরু করে অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী সবাই দুর্নীতিতে জড়িত। অতীতে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব দুর্নীতির তদন্ত হলেও অদৃশ্য কারনে চাপা পড়ে যায়। দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারনে প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরে বারবার বন্ধ হয়েছে এটি। ওই কারনে কারখানার ২২ জন কর্মচারী এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন। শুধু কর্মচারী নয় এলাকার শতাধিক শ্রমিকও বেকার হয়ে পড়েছেন। এসব শ্রমিক কারখানা চালু থাকলে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে। স্লিপার কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্রে জানা যায়, কংক্রিট স্লিপার তৈরীর অন্যতম উপাদান হচ্ছে সিমেন্ট, পাথর ও বালু। ছাতকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় সিমেন্ট কারখানা অবস্থিত। এছাড়া এখানের উন্নতমানের পাথর ও বালুর জন্য রয়েছে সুনাম। সব কাঁচামাল এখানে পাওয়া গেলেও কংক্রিট স্লিপার তৈরীর হাইটেনশন স্টিল রড ও এমসিআই স্টিল পাত ভারত থেকে আমদানী করতে হয়। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার ভারতীয় প্রযুক্তিতে ১৯৮৮ সালে মিটারগেজ রেল লাইনের কংক্রিট স্লিপার কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। কারখানা চালু থাকলে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার স্লিপার তৈরী হয়। আর উৎপাদিত স্লিপার সারা দেশের মিটারগেজ রেললাইনে সরবরাহ করা হয়। এখানেই ব্রডগেজ কংক্রিট স্লিপার তৈরী সম্ভব বলে বিভিন্ন সময়ে আসা রেলওয়ের প্রকৌশলীরা মতামত দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজ করতে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তারা পরামর্শ দেন। জানা গেছে, কারখানায় পাথর সরবরাহ থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে রয়েছে দুর্নীতি। তবে স্থানীয়রা মনে করেন, কর্তৃপক্ষ নজর রাখলে কারখানাটি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব। দেশে ব্যক্তিমালিকানায় কিছু স্লিপার কারখানা গড়ে উঠেছে। এ কারনে ছাতকের ওই কারখানা থেকে স্লিপার নেওয়া কমে গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানের দিকে কর্তৃপক্ষের নজরও কমে গেছে। রেলওয়ের কিছু সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা ওইসব ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাদের যোগসাজশে ওইসব কারখানা থেকে স্লিপার সংগ্রহ করা হয়। এ কারনে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা। এসব প্রতিষ্ঠানের স্লিপারের দাম কম হলেও গুণগত মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানার মূল ফটক বন্ধ। ভিতরে তেমন লোকজন নেই। কয়েকস্থানে যত্রতত্র বোল্ডার পাথর রয়েছে। কারখানার ভিতরে ঝোঁপঝাড়ে যেন বাসা বেধেছে। এদিকে কর্তৃপক্ষের কোন নজর নেই। অরক্ষিত রয়েছে যন্ত্রপাতি ও স্টকইয়ার্ডে থাকা মালামাল। কারখানার গোদামে কয়েকবার চুরিও সংঘটিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিএসপি) দায়িত্বে থাকা মাহবুব আলমের প্রতি। আড়াই বছর ধরে এখানে চাকুরী করলেও বছরের বেশীরভাগ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। আর কর্মস্থলে থাকলে ব্যবহার করেন রেলওয়ের অফিসার্স রেস্ট হাউস। সেখানেই তিনি খাবার ও রাত্রীযাপন করেন। এদিকে ঢাকার শাহজানপুর রেলওয়ে কোয়াটার ছাড়তে কর্তৃপক্ষ তাকে একাধিকবার নোটিশ দিলেও তিনি এখনো বাসা ছাড়েননি। দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবার ঢাকায় রেল কোয়াটারে বসবাস করছে। আর তিনি ছাতকে প্রতিমাসে নামমাত্র হাজিরা দিয়ে মাসের পর মাস ঢাকায় অবস্থান করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদবীর কর্মচারী এভাবে অফিসার্স রেস্ট হাউসে দিনের পর দিন থাকার বিধান নেই। কিন্তু মাহবুবুল আলম দাপট দেখিয়ে সেটি ব্যবহার করছেন। স্লিপার তৈরীর কাঁচামাল গ্রহণে ঠিকাদারের সাথে রয়েছে তার সখ্যতা। কংক্রিট স্লিপার কারখানার ট্রাভাসার অপারেটর এসকান্দার আলী সরদার জানান, প্রাইভেট একটি কারখানায় উৎপাদিত স্লিপার টেষ্টিংয়ের জন্য একবার এখানে পাঠানো হয়েছিলো। সেটির গুনগতমান এখানের উৎপাদিত স্লিপারের সমপর্যায় নয়। কারখানার ল্যাব সহকারী ইফতেখার আহমদ চৌধুরী বলেন, প্রাইভেট কারখানায় নিম্নমানের রড, সিমেন্ট, লাল পাথর ও মাটিযুক্ত বালু দিয়ে উৎপাদিত স্লিপার দীর্ঘস্থায়ী টেকসই হয় না। উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম ঢাকার রেল কোয়াটারের বাসা ছাড়ার জন্য কর্তৃপক্ষের চিঠি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও অফিসার্স রেস্ট হাউসে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তিনি নিয়মিত অফিস করেন। ছাতক বাজার রেলওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজ জিন্নাত কারখানায় দুর্নীতির বিষয়টি এড়িয়ে জানান, পাথর সংকটের কারনে কারখানাটি এখন বন্ধ রয়েছে।