বীর মুুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরের সঙ্গে মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির সূত্র ধরেই পরিচয়। তার সঙ্গে ঘনিষ্টতা দেড় দশকের। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। তাঁকে নিয়ে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে একাধিক ফিচার ও সচিত্র প্রতিবেদন করেছি। ২০২০ সনে কালের কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেছিলেন। তিনি খুশি হয়েছিলেন। সম্পর্ক ঘনিষ্টতা থেকে আন্তরিকতায় পৌঁছানোয় পারিবারিক নানা বিষয়ও শেয়ার করতেন। এমন কিছু ঘটনাও আছে যা অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার না করে তিনি আমার কাছে শেয়ার করতেন। কিভাবে তার এতটা বিশ্বস্থ হয়েছিলাম জানিনা। এই বিশ্বাস মৃত্যুর আগ পর্যন্তই অটুট ছিল। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে পাশে ডাকা থেকেই হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। আমৃত্যু তিনি অনন্তলোকে মঙ্গলালোক জ্বালিয়ে রেখে আমাদের পথ দেখাবেন।
২০১৩ সনে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক হিসেবে তাঁকে আরো কাছে পাই। বাচ্চু রাজাকারের ফাসির দাবিতে আমরা যখন বারুদে স্লোগান নিয়ে রাজপথে মুখর তখন তিনি আমাদের সাহস ও অভয় দেন পাশে থেকে। মিছিলে, প্রতিবাদ সভায় সহযোগিতা করেন অগ্রপথিক হিসেবে। বীর স্পার্টাকাস মালেক পীরের নির্লোভ-আপসহীন চরিত্র ও সততা আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মাথা নত না করে সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমৃত্যু লড়াকু ছিলেন। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিঃস্ব ছিলেন। ঘর বাড়ি ছিলনা। ভাইয়ের ভাঙ্গা ঘরে থাকতেন। অভাব অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করলেও লোভ তাকে কাবু করতে পারেনি। অভাব অনটনের মধ্যেও মাথা উচু রেখে সটান সিনায় জীবন শেষ করেছেন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখা হয় পুরাতন বাসস্টেশনের হিউম্যান ল্যাবের নিচে। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে আতকে ওঠি। শরির ভেঙ্গে গেছে। পেট ফোলা। সুনামগঞ্জের খবরের অফিসে বসে একসঙ্গে চা পান করি। সুস্থ হয়ে ওঠবেন আশার কথা বলছিলেন। দুএকদিন পরে ফোন করে জানালেন তার ‘ও পজেটিভ রক্ত’ দরকার। আমরা তাঁকে দুই ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দেই। শেষ দিন রক্ত দেবার পর তিনি জানালেন সিলেট ওসমানীতে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। যাবার আগে ফোনে বলে গেলেন। সেখানে যাবার পর আমি বারবার ফোন দেই রিসিভ হয়না। একবার বন্ধ পাই। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ ভাইকে বিষয়টি অবগত করি। ওসমানীতে নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা করে চিকিৎসকরা জানান তার লিভার সিরোসিস। লাস্ট স্টেইজে আছেন। চিকিৎসকের কথা শুনে স্বজনদের বাড়ি নিয়ে আসার অনুরোধ করলে তারা বাড়ি নিয়ে আসেন। তিনি নিজের শহরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান।
ওসমানী থেকে ফিরে আসার দু’দিন পরেই খবর পাই তিনি বাড়ি চলে এসেছেন। সহকর্মী আসাদ মনিকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এর মধ্যেই তিনি ফোন দেন। কণ্ঠ ভাঙ্গা ভাঙ্গা। সব কথা বুঝা যায়না। ঘন নিঃশ্বাসের কারণে হারিয়ে যাচ্ছিল কথা। কথার পিঠে কথা লেগে যাচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। আমি ফোন কেটে জানাই এখনই আসছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আর আসাদ পৌঁছে যাই তেঘরিয়া পীর বাড়ি এলাকায়। গিয়ে দেখি বীর যোদ্ধা মালেক হোসেন পীর উত্তর-দক্ষিণ মুখো করে শুয়ে আছেন। বুকের উপরে একটি ছোট ফ্যান। ভাঙ্গা একটি খাট ছাড়া বসার কোন ব্যবস্থা নেই। দরোজা জানালাও ভাঙ্গা। একটি প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে যায় তার ছেলে। কুশল বিনিময় করে অভয় দিলাম। আমি লক্ষ্য করি তার সজল চোখ। সেই তীর্যক চোখ আমার ভিতরে প্রবেশ করে কী যেন অনুসন্ধান করছে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। খুব কষ্টে কথা বলছিলেন। শ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বললেন, ভাই আমার দিন শেষ। তুমি কাগজীরে (কবি ইকবাল কাগজীকে) একটা ফোন লাগাও। আমি ফোন লাগিয়ে দিলাম। তাঁর বন্ধু কবি ও গবেষক ইকবাল কাগজীকে বললেন, ‘কাগজী তুই আমার পা-ুলিপিটা শামীমের খাছে দেলাইছ। হে পারলে কোনদিন আমার একটা বই বার করবনে।’ এটাই ছিল তার জীবনের শেষ ইচ্ছের কথা। তিনি তার সৃষ্টি দেখে যেতে পারবেননা সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। তাই আমাকে এ কথা বলার জন্যই ডেকে নিয়েছিলেন বলে আমি মনে করি।
মালেক হোসেন পীরকে কয়েক বছর আগে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিরোধ যুদ্ধসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য তাড়া দিচ্ছিলাম। আমাদের সুনামকণ্ঠ পত্রিকার ব্রডশিট পৃষ্ঠায় পুরো এক পাতা একবার ছাপিয়েছি তার লেখা। তাঁকে নিয়ে স্পেশাল একাধিক প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।
সুনামকণ্ঠে ছাপা হওয়া বড়ো লেখাটির কিছু বিষয় ধরিয়ে দিয়ে আরো বড়ো করার জন্য অনুরোধ করি। তিনি কিছু লিখতে শুরু করলেন। হাতে লেখে একটি কম্পিউটারের দোকানে কম্পোজ করান। পরে পেনড্রাইভে এনে কপি ইকবাল কাগজীকে দেন প্রুপ ও সম্পাদনা করে দেওয়ার জন্য। এখন ওই পাণ্ডুলিপিটি কাগজী ভাইয়ের কাছেই আছে। সেটা তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করে বই প্রকাশের বিষয়ে কথা বলতেই আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন।
এর মধ্যে আমাকে আবারও অনুরোধ জানালেন জেলা প্রশাসককে ফোন দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবার জন্য। আমি তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মহোদয়ের মোবাইলে ফোন দেই। তিনি ফোন ধরেন। আমি মালেক ভাই কথা বলবেন বলে বলি। তিনি জুম মিটিংয়ে থেকেও মালেক হোসেন পীরের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে দেখে আসবেন বলে আশ্বস্থ করেন। আমি ওই সময়ই জেলা প্রশাসক মহোদয়কে কৌশলে মালেক ভাইর শারিরিক অবনতির অবস্থা অবগত করি। ওই দিন ফোনে মালেক ভাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানান। চিকিৎসায় যাবার আগে সহযোগিতা দানের জন্য। তিনি ক্ষমাও চান। জেলা প্রশাসক মহোদয় তাকে অভয় দেন। এভাবে কিছুক্ষণ পাশে থেকে চলে আসলাম। ওই দিনই বিকেলেই আমি কাগজী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে সু-সম্পাদিত পাণ্ডুলিপিটি দেবার কথা বলি। তিনি ভালো করে প্রুফ ও সম্পাদনা করে দিবেন বলে জানান। গত রবিবার রাতে আবারও সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাই। এই দেখা যে শেষ দেখা হবে কল্পনাতেও ছিলনা। সদর হাসপাতলের ৫ তলার একটি সাধারণ কক্ষে গিয়ে দেখি মালেক পীর ভাইর মুখে অক্সিজেনের নল লাগানো। তাঁর কিশোর ছেলে কানে কানে বললো আমার কথা। শুধু একনজর চাইলেন। কোন কথা নেই। বুক ওঠানামা করছে ক্রমাগত। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বীর মালেক পীরকে এই অবস্থায় দেখে কষ্ট হচ্ছিল। তাই বেশিক্ষণ থাকিনি।
সোমবার দুপুর ১২টায় আবার তাঁকে দেখার জন্য সদর হাসপাতালে যেতে ফোন করি বিজন সেন রায়কে। কারণ গত কয়েক বছরে মালেক হোসেন পীর ও সুনামকণ্ঠ এক অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠেছিল। করোনার আগ পর্যন্ত আমাদের অফিসে একবার ডু না মারলে তার পেটের ভাত যেন হজম হতোনা। তাই প্রায় প্রতিদিনই তিনি আসতেন। জেলার বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারি দফতরে করা মালেক ভাইর আবেদন থেকে প্রতিবেদনগুলো আমিই করতাম। আমাদের অফিসে আসলে বিজনদা তাঁকে খেপাতেন ‘আফনিতো আমার কাছেই আইছইন্ন্যা, ওই শামীম ভিতরে আছে যাইন’। মালেক ভাই মুছকি হাসতেন। ছাতাটা কোণায় রেখে আমার পাশের চেয়ারে বসে গল্প করে চলে যেতেন। আমি কাজে ডুবে থেকেই তার সঙ্গে কথা বলতাম। আজ বিজনদাকে ফোন দেবার পর তিনি জানালেন, ‘এইমাত্রা মালেক পীর মারা গেছেন’। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। মধ্যবিত্তের পাপ্পুর মুখটিও কালো হয়ে গেল। পুরনো স্মৃতিগুলো ভাসছিল দৃষ্টির চত্বরে।
আমি একজন আজীবন মুক্তিযোদ্ধা মালেক হোসেন পীরের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম এ আমার জীবনের বড়ো পাওয়া। তাঁর কাছ থেকে কিছু সাহস ও সততার রপ্ত করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। এই তল্লাটে রুটস কাহিনীর মতো পরম্পরায় তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণাময় অগ্নিনাম হয়েই বাঁচবেন যুগ যুগ। আমরা দ্রোহে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে তাকে মনে করব। হার না মানা লড়াকু যোদ্ধাকে স্মরণ করবো নত মস্তকে শ্রদ্ধায়। তার সততা, আপসহীনতা ও সাহসের কথা বলে যাব। বিদায় বলবনা মালেক ভাই, অনন্ত স্যালুট জানাই আপনাকে।