বিশেষ প্রতিনিধি::
কালো শ্যুট ও প্যান্ট পড়নে। শাদা ক্যাডস পায়ে। রঙিন পেপারে মোড়ানো একটি বই হাতে। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন হাওরঘেরা সুনামগঞ্জ কারাগারকে ছেয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। এই সময় হাসি হাসি মুখে বের হন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার অপরাধে কারাবন্দি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের যুবক ঝুমন দাস আপন। তার মা নিভা রাণী দাস এগিয়ে যান। ঝুমন দাড়ানো থেকে হাটু গেড়ে বসে মায়ের পায়ে ধরে কদমবুসি করেন। মা জড়িয়ে ধরেন। চুমো খান কপালে। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত লোকজন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ঝুমন দাস প্রায় ২০০ দিন পরে কারামুক্তি হয়ে সাংবাদিকসহ যারা তার মুক্তির জন্য কাজ করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তার মা নিভা রাণী দাস এসময় মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি ও নিরাত্তার দাবি জানান। ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পান ঝুমন।
ফেইসবুকে হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬ মাসের অধিক সুনামগঞ্জ কারাগারে কারাবন্ধি ছিলেন ঝুমন দাস আপন। গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সমাবেশ করেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক। ওই সমাবেশে সাম্প্রদায়িক ও ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দেন তিনিসহ অন্যান্য হেফাজত নেতৃবৃন্দ। এ কারণে শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস আপন ফেইসবুকে মামুনুল হকের সমালোচনা করে একটি স্টেটাস দেন বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে মামুনুল হক অনুসারীরা বিক্ষোভ করলে ১৬ মার্চ রাতে ঝুমন কে আটক করে পুলিশ। পরদিন ১৭ মার্চ দিরাই ও শাল্লার ৬টি গ্রামের হেফাজত অনুসারীরা মসজিদের মাইকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়। তারা ৮৮টি বাড়িঘর ও ৫টি মন্দির ভাংচুরসহ লুটপাটও করে। এ ঘটনায় দেশ বিদেশে তুমুল সমালোচনা হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রামের নজর দেয় এবং পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে। ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন র্যাবের মহাপরিচালকসহ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নোওয়াগাও গ্রামে এসে গ্রামবাসীর প্রতি সংহতি জানিয়ে হামলাকারীদের বিচারের দাবি জানায়। গ্রামে হামলার ঘটনায় তিনটি পৃথক মামলা হয়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত ঝুমন দাস আপনকে এক বছরের জন্য শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেন। জামিনের কাগজপত্র মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসে সুনামগঞ্জ কারাগারে পৌছলে সন্ধ্যা পোনে ৭টায় তার মুক্তি হয়। এসময় কারা ফটকে তাকে বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।
কারা ফটকে ঝুমন দাশ আপন বলেন, আমি অসুস্থ। এই মামলা সম্পর্কে পরে কথা বলব। তবে যারা আমার মুক্তির জন্য কাজ করেছেন এই দুঃসময়ে আমার পরিবারের পাশে দাড়িয়েছেন তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
তার মা নিভা রাণী দাস বলেন, আমার ছেলে জেলে যাবার পর এবং গ্রামে হামলার পর থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আজ আমার ছেলে মুক্তি পেয়েছে তাতে আমি আনন্দিত। তবে আমি তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিতও। আমি এই মামলা থেকে আমার ছেলের নিঃশর্ত মুক্তি চাই এবং তার নিরাপত্তা চাই।
এসময় কারা ফটকে ঝুমন দাসকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। ঝুমন দাসের গলায় মালা পড়িয়ে দেন আরেকটি প্রগতিশীল সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ঝুমন ও তার মা নিভা রাণী তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানান।
ঝুমনের আইনজীবী এডভোকেট দেবাংশু শেখর দাস বলেন, আমরা আদালতে দুপুরে উচ্চ আদালতের জামিনের কাগজপত্র দাখিল করে আবেদন করি। বিকেলে কারাগারে পৌছে। সন্ধ্যায় ঝুমন কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
সুনামগঞ্জের জেলার মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, কাগজপত্র কারাগারে এসে পৌছতে বিলম্ব হওয়ায় ঝুমন সন্ধ্যায় মুক্তি লাভ করেন। তার পরিবারের লোকজন তাকে কারা ফটক থেকে নিয়ে যান।