বিজয়া দশমীর প্রণাম আর শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখতে বসে দেখি, যা-ই লিখি না কেনো, তাতে আত্মপ্রবঞ্চনাই আরো খানিকটা প্রকট হবে। এবার মায়ের আগমন যেমন নিষ্কণ্ট ছিল না, বিদায়ের বেহাগও ঠিক সুরে বাজেনি— অবশ্য কোনো বছরই তেমন থাকে না। আগের বছরগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন উপাসনালয় ও প্রতিমা ভাঙচুরের সংবাদ আসে। সেগুলোর কোনো বিচার বা তদন্ত হয় না, পুজো শেষ হয়, আমরা ভুলে যাই; পরের বছর আবারও সংবাদগুলো প্রচারিত হলে আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠি। এবার পুজোর আগে তেমন কোনো সন্ত্রাসের খবর আমাদের চোখে পড়েনি বলে খানিকটা নিশ্চিন্তই ছিলাম; কিন্তু এটা যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পরিকল্পনারই অংশ— তা তো প্রমাণিত হচ্ছে।
পুজো আয়োজনের বিষয়ে বাধা-বিপত্তির আলোচনা শুরু হয়েছিল ঢাকার কলাবাগান ক্রীড়াচক্র মাঠে ধানমন্ডি সার্বজনীন পূজা কমিটি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাদানুবাদ দিয়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ডিএনসিসির ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় জনস্বার্থ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবতা বিবেচনায় তারা বিকল্প স্থানে পূজা উদযাপনের বিষয়ে পূজা কমিটির কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে অনুসারেই স্টাফ কোয়ার্টার মাঠে এখন পুজো চলছে। আমি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত কিন্তু এই ব্যাখ্যা বছরে একবার ১০ দিনের পুজো উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে যদি ঢাকা শহরের প্রতিদিনকার জীবনে প্রয়োগ করা যেতো, তবে অনেক বিড়ম্বনার এড়ানো সম্ভব হতো। ঢাকাবাসী যে কোনো মানুষই জানেন, প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাযের সময় বহুতল মসজিদের সামনে সড়ক আটকে কীভাবে নামায আদায় করেন মুসল্লিরা। তখন সে রাস্তা দিয়ে যান চলাচল সম্ভব হয় না। আমি একটি উদাহরণ দেই, হাতিরপুলের গোল্ডেন চিমনি রেস্টুরেন্টের উল্টোপাশের মসজিদটির কথাই ধরা যাক। কারওয়ান বাজারের দিকে যাবার এই অপ্রসারিত কিন্তু ব্যস্ততম সড়ক যখন শুক্রবার দিন আটকে রাখা হয়, তখনকার পরিস্থিতি ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। এমন আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির উল্টোপাশের সরু রাস্তাটি। কেবল শুক্রবার নয়, করোনার আগে প্রতি ওয়াক্ত নামাযের সময়ই রাস্তাটি আটকে মুসল্লিরা নামায আদায় করতেন। এ যেনো এক অলিখিত নিয়ম! এ বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের নজরে পড়া উচিত নয় কি?
সম্প্রতি কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, লামাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলো ঘটেছে তার ধরণ ও প্রকৃতি সেই আগের মতোই। এক উপাসনালয়ের সামনে দিয়ে আরেক ধর্মের মানুষদের প্রথা পালনে বাধা, সন্ত্রাস সৃষ্টিতে ধর্মগ্রন্থের ব্যবহার বা এ জাতীয় অপকর্মগুলো এ দেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোর পুরোনো কায়দা। হালে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফেসবুক। ধর্মকে তারা ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য। সন্ত্রাসের ধরণ যেমনই হোক, মূল লক্ষ্য থাকে রাজনীতি অথবা অর্থনীতি, কখনো বা দুটো একসঙ্গেই। পুরোনো ঢাকার শঙ্খনিধি মন্দিরে পূজা উদযাপন নিয়ে যে বাধা-বিঘ্ন তৈরি করা হলো, তার মূলে আছে মন্দিরের জমি দখলের পাঁয়তারা। সারাদেশের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলোর অন্যতম কারণই এটি। তার সঙ্গে আইনের নানা প্যাঁচ। সেই ১৯৬৫ সাল থেকে ঘোষিত শত্রু সম্পত্তি আইন বা স্বাধীন দেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন যুগিয়েছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্রম-প্রান্তিকায়নে ও নিঃস্বায়নে শক্তিশালী নিয়ামক হিশেবে কাজ করে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলোর বিচার না হবার ন্যাক্কারজনক নজির তো আছেই।
আমার ধারণা, সরকার-প্রশাসন-সংবাদমাধ্যমসহ আমরা যারা ক্রমাগত ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাঙলাদেশের কথা বলি, তারা সম্ভবত একটি বায়বীয় জায়গায় বাস করি। ব্যক্তির মানসিকতায় আমি প্রতিদিন যে সাম্প্রদায়িকতার চিত্র দেখি— টুকরো টুকরো ঘটনা, আড্ডায় বা ঠাট্টাচ্ছলে বলা নানা কথা কিংবা কোনো একজনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ঝাড়তে গিয়ে তার ধর্ম ধরে টান দেয়া— এগুলোই সমন্বিত হয়ে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীর চালানো নানা সন্ত্রাসের আগুনে ঘি ঢালে।
কথায় কথায় ৯০% মুসলিম বলে কলার ঝাঁকানো, মসজিদের শহর ঢাকা বলে ট্রাভেল ভিডিও বানানো, মন্দিরে আযানের সময় টাঙানো আছে বলে সম্প্রীতির ঢেঁকুর তোলা, কিছু বললেই ‘মুসলমানের দেশ’ বলে হুঙ্কার দেয়া… এগুলো যারা আওড়ান, তাদের লজ্জা লাগে না? ৯০% মুসলমানের দেশে ব্যাংকের টাকা চুরি করে কে? ধর্ষণ করে কে? পকেটে চাইনিজ ফোন, ফোনে জুকারবার্গের ফেসবুক, ধান্ধায় লোকের পয়সা মেরে খাওয়ার বাসনা কিন্তু প্যান্ট ঠিকই টাকনুর উপরে, পুলিশ ধরলে একটা নূরানী মার্কা লুক চাই, তাতে ধর্মের নামে সিমপ্যাথি আদায় করা যায়। আরে ভাই, আপনাদের লজ্জা লাগে না ভাবতে যে একটা শুক্রবার আসলে দেশের জাতীয় মসজিদের জুম্মার নামাযকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হয়। কারণ আপনার ধর্মগত স্বভাবের ইতিহাস তো ভালো না। মসজিদের মাইক ব্যবহার করে আপনি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়ান। মিথ্যা অভিযোগ তুলে পিটিয়ে মারেন খোদ নিজ ধর্মের মানুষকেই। জমি দখল করতে হলে আপনি চিকন বুদ্ধি খাটিয়ে সেখানে একটা মসজিদ খাড়া করেন। সারাজীবন দুর্নীতি করে পয়সা জমিয়ে এখন আপনি দাড়ি-টুপি-আলখাল্লা ধরছেন, মসজিদে এসি কিনে দেন, ধর্মের বয়ান ঝাড়েন। ব্যাংকের সুদও খান আবার সুদ খাওয়া হারাম বলে ওয়াজ-নসিহত করেন। এই কদিন আগে ফেসবুকে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে বিরাট মওলানাগিরি দেখা গেলো। হ্যাশট্যাগের বন্যায় নিউজফিড ভেসে গেলো। অথচ নিজের দেশে এই বাঙালি মুসলিমদের সিংহভাগই বছরের পর বছর ধরে প্রতিমা ভাংচুরের বিরুদ্ধে কথা তো বলেই না, মাঝে মাঝে উল্টো সুরে কাওয়ালি ধরে। উইঘুরে কিংবা ফিলিস্তিনিতে মুসলিম নির্যাতিত হলে ফ্রিডম অব রিলিজিয়নের তুবড়ি ছোটে কিন্তু লামা কিংবা চাঁদপুরে পূজামণ্ডপে হামলা হলে মেজোরিটি মুসলিমের তত্ত্ব খাড়া হয়। এদেশের মুসলিমরা সেকেন্ড হোম হিশেবে আরব বিশ্ব খোঁজে না, আফগানিস্তানও না, তখন ঠিকই ইউরোপ-আমেরিকার ভিসার লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়।
মন্দিরে আযানের সময় টাঙিয়ে রাখতে হয়, কারণ তাতে ‘সম্প্রীতি’ নামক শব্দটির ভালো মার্কেটিং হয়। এদেশে সম্প্রীতি শব্দটি হলো তাঁদেরই বাঁচার আশ্রয়— পুজোর সময় যাদের মন্দির লুট হয়, যাঁদের ঐতিহ্যবাহী বিহার ধ্বংস করে সিমেন্টের রাজনৈতিক ভর্তুকি দেয়া হয়— তাঁদেরকেই বক্তৃতা-বিবৃতিতে বারবার বলতে হয়, ‘আমাদের মুসলিম ভাই’, ‘আমাদের সম্প্রীতির দেশ’ ইত্যাদি। মাইলের পর মাইল মাইক লাগিয়ে ওয়াজ করার সময় খোঁজ নেয়া হয় কাছের কোনো মন্দিরে কোনো আচার পালিত হচ্ছে কি না? আজ কোনো এলাকার খুতবাতে কি বলা হয়েছে যে, পূজা মণ্ডপগুলোতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলো যারা ঘটিয়েছে, তারা ইসলামেরও শত্রু? এ কথা তারা কানেও তোলে না, কারণ ওই যে, গায়ের জোর— ‘আমি মুসলিম, আমি মেজোরিটি’। খালি ইউরোপ-আমেরিকা ইসলামি জঙ্গীবাদ নিয়ে কথা বললে আমার গলাটা একটু মিনমিনা হয়, সিটিজেনশিপটা যদি না পাই! ভিসার মেয়াদ যদি না বাড়ায়! তখন আবার লিবারেলিজমের থিসিস লিখতে বসি।
আসছে বছর আবার হবে… কিন্তু কী হবে? আবারও প্রতিমা ভাঙচুরের খবরে আসবে আশ্বিনের শারদ সকাল? আবারও উৎকণ্ঠা, ভয় আর অনিশ্চয়তা নিয়েই কাটবে আমাদের ষষ্ঠী থেকে দশমী? কতোগুলো সাম্প্রদায়িক শুয়োরের বাচ্চা ফিকে করে দিয়ে যাবে আমাদের উৎসবের রঙ? আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম।
(লেখাটি লেখকের ফেইসবুক থেকে নেওয়া)