‘মেঘদল‘-এর একটি গান নিয়ে গত কয়েক দিনই তর্ক-বিতর্ক চোখে পড়ছিল। মাত্র গতকালই এক পরিচিতের কাছ থেকে জানলাম যে এই ব্যান্ড ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু গানটির লিরিকসের রচয়িতা আমাদের সবার পরিচিত, সজ্জন ও বহু গুণের অধিকারী শিবু কুমার শীল। যিনি জানালেন, তিনি অমায়িক হলেও ধর্মের প্রশ্নে নাজুক হয়ে পড়েছেন। যিনি খবর জানালেন এবং যার খবর জানালো হলো (যদি সত্যিই শিবু এই গানের লিরিকস রচয়িতা হয়ে থাকেন), দু‘জনেই আমার পরিচিত বলে কারো প্রতিই ‘বায়াসড‘ না হয়ে আমি বোধ করি সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। শিবুকে চেনা আছে আমার। সে এমনকি বাংলাদেশের একজন সংখ্যালঘু হিসেবে আওয়ামি লীগের প্রতি দূর্বলতা যেমন ভারতে কংগ্রেসের প্রতি থাকে মুসলিমদের বা পাকিস্তানে পিপিপির প্রতি সংখ্যালঘুদের- তেমন সব বিষয়েরও উর্দ্ধে। হুট করে তাঁর কথা-বার্তা শুনলে এমনকি তাকে ‘পলিটিক্যাল ইসলামিস্ট‘ না হোক, ‘লেফট ইসলামিস্ট‘ বলে মনে হতেই পারে। বেচারী শিবু বা শিবু না হোক…যারাই এই গানের লিরিকস লিখেছেন (আমি এখনো শুনিনি যদিও)…তারা ত‘ আন্ত:ধর্মীয় প্রেম বাড়াতেই এমন লিরিকস লিখেছেন। কিন্ত, দ্যাখেন…এটাই মুস্কিল। অষ্টমীর খিচুড়ির সাথে ঈদের সেমাই মেশাতে চাইছেন কেউ- ভাল কথা! কিন্ত যার বা যাদের সেমাই- তিনি বা তারা ভালবেসে ‘দাওয়াতে‘ ডেকে খাওয়ালে ত‘ খাওয়া হয়ই- কত খেয়েছি ঈদের সেমাই- না, ‘সিমুই‘ না- দয়া করে উচ্চারণগুলো ঠিক ভাবে করবেন আর কি ওপারের সংখ্যাগুরুরা…কিন্ত, তিনি বা তাঁরা যদি অষ্টমীর খিচুড়ির সাথে সেমাই মেশাতে না চান? তাদের সবাই উগ্রবাদী তা-ও বলব না। ধরা যাক, ১০০ জনের ভেতর ৪০ জন রাজি হয়ে গেল উভয় পক্ষেই যে মেশানো হবে সেমাই আর খিচুড়ি। বাকি ৬০ জন যদি না মানে? এমনকি ১ জনও যদি না মানে? সেক্ষেত্রে কারোর কিন্ত কোন অধিকার নেই সেমাই আর খিচুড়ি একসাথে মেশানোর- ঠিক আছে? এটা কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য নয়। আপনি আপনার ‘প্যাগান‘ স্পিরিট থেকে- আপনার দেবতাই তেত্রিশ কোটি…স্টেজে উঠে গানের লিরিকসে সব মেশাতে চাইলেন-বাকি তিন প্রবল সেমিটিক, মনোলিথিক ধর্মের খ্রিষ্টানরা তা-ও কিছু প্যাগান উপকরণ নিয়েছে তাদের ধর্মে- ইহুদি আর মুসলিমরা আরো শুদ্ধাচারী- সেখানে দরকার কি ভাই জোর করে এসব ‘উচ্চশিক্ষিত নাগরিক এলিটের ঢঙ্গের প্রগতি কুলাতে‘ যাবার? স্যরি- আমার এই ভাষায় কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্ত, আমি ‘মেঘদলে‘র সবার নিরাপত্তার কথা ভাবছি। এবং আতঙ্ক থেকেই মেজাজ চড়ছে। যে ধর্ম যেমন, সেভাবেই মেনে নিতে হবে, তাই না? আব্বাস যদি মনে করে যে ‘সেক্যুলারিজম‘ কুলাতে এক বিধর্মীর উচিত নয় তার ধর্মীয় এলাকায় ঢোকা- ঢুকবেন না। শিবুর খবর যিনি জানালেন তিনি উগ্রবাদী না। তিনি যে কোন সংখ্যালঘু পরিচিত মানুষের শুভাকাঙ্খী। কিন্ত সেই তিনি ‘কনফিউজড‘ হয়ে পড়ছেন। গানের লিরিকসে কেন আয়াত ব্যবহার করতে হলো? তাহলে? আপনার প্যাগান ধর্মে ধর্ম নিয়ে ৫,০০০ রকমের সৃজনশীলতা করা যায় ভাল কথা। অন্যের ধর্ম নিয়ে করতে যাবেন কেন? আপনার ঘর আপনি ইচ্ছা মতো সাজাবেন- অন্যের ঘরের গৃহসজ্জা কেমন হবে সেটা নিয়ে আপনি বলতে যাবার কে? বলতে গেলে মাইন্ড ত‘ করতেই পারে। আর এইসব সো কলড টিপিক্যাল নাগরিক প্রগতিবাদ- যেন মুসলিম বন্ধু পর্ক খেলেই নন-কম্যুনাল বা তুমি বীফ খেলেই নন-কম্যুনাল! কেন? পারলে আরবি-ফার্সি শিখে দু‘টো আরবি বা ফার্সি গল্প অনুবাদ করো বা সংস্কৃত শিখে আবৃত্তি করে দেখাও কেমন সেক্যুলার। সেক্যুলার শুধু ‘খাওয়া-খাওয়ি‘ করে কুলাবার/দেখাবার জিনিষ না।
আরো কিছু বিতর্ক চোখে পড়লো অন্তর্জালে। নারী হিসেবে মেয়েরা সব ধর্মেই শাঁখা-সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র বা বোরখা-হিজাব যারা পরেন, তারা পুরুষতন্ত্রের এবং পুরুষকে তোল্লাই দিতেই এই চিহ্নগুলো ধারণ করেন। কিন্ত তারপরও আমার-আপনার কথায় কিছু যাবে আসবে না। আজো সমাজের ৭০ ভাগ নারী শাঁখা-সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র পরেন বা বহু নারীই বোরখা-হিজাব পরেন। হ্যাঁ, এই নারীদের ৯০ ভাগই বিবাহিতা এবং বিবাহিতারা চার্চের নান নয়। তারা মা হন, সন্তান পৃথিবীতে আনেন। ঠিক আছে। কিন্ত তারপরও হুট করে হাজার বছর যা দেখে চোখে অভ্যাস, তার বিপরীতে একদম অন্তর্বাসে এক নারীর (তিনি স্থূল না শ্যামাঙ্গী এসব বিচারে যাবই না) স্তন বিভাজিকায় মঙ্গল সূত্র…বহু দিনের চোখের দেখায় যে অভ্যাস সেখানে ধাক্কা দিলেই রেভল্যুশন- একদম বীফ-পর্ক খাওয়ার ফালতু রেভল্যুশন! হ্যাঁ- এত যে বকবক করছি- এই আমি হোয়াইট গায়ক-গায়িকাদের গলায় ঝোলানো রূপোলী ক্রুশ মুগ্ধ চোখে দেখি। উপনিবেশের ফলাফল? হতে পারে। তবু মনে রেখেন: ইউরোপেও মিকেলেঞ্জেলোর আগে কয়েক শতাব্দী মাতা মেরীকে সমতল বক্ষা দেখানো হতো। এখন মাতা মেরীকে স্বাভাবিক নারীর দেহ বিন্যাসে দেখানো হলেও অবশ্যই তাঁর পোশাক মার্জিত থাকে। আর মিকেলেঞ্জেলো ত‘ পিয়েতা আর যীশুকে একই রকম তরুণ হিসেবে নির্মাণ করায় সমালোচকরা প্রশ্ন করলে বলেছিলেন যে পিয়েতা আজীবন সেলিব্যাসি পালন করেছেন বলে তাঁর বয়স বাড়ে নি। তাঁর পুত্রের মতই সজীব তিনি দেখতে।
তারপর আমি সমকাম বিরোধী না। কিন্ত এক পুরুষ আর এক পুরুষের জন্য মঙ্গলসূত্র পরছেন- বাবা, একটু রয়ে-সয়ে রেভল্যুশনটা করলে হয় না?
দূর- জরুরি সব কাজ ফেলে আগড়ম-বাগড়ম বকছি। যাহোক, সব ধরণের দেখানেপনা ‘প্রগতি‘র আমি বিরোধী!
(লেখকের ফেইসবুক থেকে নেওয়া)