আজকে আমি যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি তাহলো আমার ভাইয়াকে (মা’র বাবা) নিয়ে কিছু স্মরনীয় ঘটনা। আমার ভাইয়া হলেন ভাটি এলাকার নিবেদিত কন্ঠস্বর। তিনি হলেন শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামের কৃতিসন্তান,আপাদমস্তক মানুষ, কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও আদর্শে একজন রাজনৈতিক নেতা এবং দেশের স্বাধীনতাকামী আপোষহীন সৈনিক। শুধু তাই নয় তিনি একজন গণসংগীত শিল্পীযোদ্ধা ও সংগীত প্রশিক্ষক ছিলেন (শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়,শাল্লা)। ভাইয়া নিজে যেমন লিখেছেন অনেক গনসংগীত আবার অনেক সময় নিজের গাণ সহ কবি দিলওয়ার, প্রতিতযশা অ্যাডভোকেট কানন পালের মতো ব্যক্তিদেরও অনেক গানে সুরারোপ করেছেন। নাম কমরেড শ্রীকান্ত দাশ।
যাই হউক খুব কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে ভাইয়া যখন পরলোক গমন করেন তখন আমি ছোট ছিলাম।
বলে রাখা ভাল আমার জীবনের স্বার্থকময় কথাহলো আমার জন্মও হয়েছে আমার ভাইয়ার বাড়িতে(শাল্লা)। আমার মা হলেন ভাইয়ার তৃতীয়তম সন্তান। মাকে ভাইয়া খুব আদর করতেন এমনকি আমাদের গ্রামটাও নাকি ভাইয়ার খুব ভাল লাগত। যার জন্য সময় পেলেই যখন খুশি তখন চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমার ঠাকুমা শ্রীযুক্তা মুক্তেশ্বরী সরকারও ভাইয়াকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। ভাইয়ার আসা মানেই আমাদের ঘরে এলাকার সকল মুরব্বিদের(শিষ্য) এক জমজমা কীর্তন(আড্ডা)। আজ এবেলা এসে বুঝি ভাইয়ার রাজনৈতিক নেটওয়ার্কটা কতো জুড়ালো ছিল। কেনো যে মানুষ এতো শ্রদ্ধা করতো।
১৪১৪ সালের ১৯শে চৈত্র। মাঠ ফাটা রোদ হলেও শেষ বিকেলে ঝিরঝিরি মিষ্ট বাতাস। সারা হাওর জুড়ে কড়া-সবুজের ধান ক্ষেত ঝিরঝিরি বাতাসে নাচছে। আমি বন্ধুদের নিয়ে শেষ বিকেলের খেলায় মত্ত্ব হলেও কোন এক বন্ধুর ডাকে কানে আওয়াজ আসলো- ক্লিন্টন তোর ভাইয়া আইছে (আসছে)? আমিতো শুনেই খেলা ফেলে দৌড়! দৌড়ে বাড়িতে এসে দেখি সত্যিই ভাইয়া। ভাইয়া কি আনছিলেন কি খেয়েছি তা মনে নেই তবে ভাইয়াকে দেখে মনে যে আত্মতৃপ্তি আসছিল তা হৃদয় থেকে তোলা খুব কষ্ট সাধ্য যা আমার মতো সাধারনের লিখেও ভাব প্রকাশ করা কঠিন। যা আমাকে প্রতিনিয়তর মতো আজও লিখতে সেই বেলার সাড়া দিচ্ছে।
সন্ধ্যা গতে রাত। মাথায় আসে পরের দিনের মাছ মারা ও স্নানের ফন্দি। ভাইয়ার আসাটা চৈত্র মাস হওয়ায় অতি খরা ও অনাবৃষ্টি,সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে আমাদের গ্রামের পুকুরের পানি নষ্ট হওয়ায় ভাইয়াকে নিয়ে একটা বাড়তি সুযোগ নিলাম। বললাম ভাইয়া আমাকে তো একা একা মা-বাবা ঠাকুরমা কেউ হাওরের মাঝে “নীল-পানির কাঁঠালজান নদীতে যাওয়ার জন্য দিবে না। তুমি(আপনি) বললে কেউ না-ও করবে না; এখানে পুকুরের পানি ভাল না, নদীতে ইচ্ছে মাফিক হাউতরাইয়া-টাউতরাইয়া(সাঁতার)আওয়া যাইবো(আসা যাইবো)। আর একটা ফেলুন(মাছ ধরার জালি)নিলে তো আর কোন মাথ-ই নাই। এই নদীতে তো শুধু মাছ আর মাছ”। ভাইয়াকে রাজি করালাম। বললেন ঠিক আছে; আগে রাত শেষ হউক। ঘুম থেকে উঠে চা-নাস্তার ফাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম ভাইয়া রাতের কথা মনে আছে তো ? মুচকি হেসে বললেন ঠিক আছে ! আমার তো অপেক্ষার পালা; দুপুর তো আসছেনা! অন্যদিনের ন্যায় আজকের দুপুর তো দেরীতে আসছে। যাইহোক কিছুক্ষন পর চা-নাস্তার পর আরেক বার চা-খেয়েই দেখি ভাইয়ার কন্ঠে আওয়াজ উঠছে “ক্লিন্টন কোথায়,নদীতে যেতে হবে স্নান করতে,রেড়ী হও” আমিতো এক ফালে রেডী। মা-এরা ভাইয়ার সুরে না বোধক সুর না দেয়ার আগেই আমি বলে ফেললাম ভাইয়া ফেলুনটা নিলে তো !! বলতে না বলতেই ভাইয়া বলে উঠলেন লও লও। দেখি মা,বাবা এমনকি ঠাকুরমা একজন আরেকজনের চোখা-চোখি করছেন। আমি উনাদের এসব ভাব দেখে না দেখে লুঙ্গি,গামছা,ডেগ-ডেস্কি ফেলুন নিয়ে ভাইয়াকে সাথে করে ছুটলাম মধ্য হাওরের ‘কাঁঠালজান’ নদীতে। আর মনে মনে নিজেকে একজন নেতৃত্বদানকারী হিসাবে ভাবলাম। এই ক্ষনিকের সময়টা নিজেকে কতোবড় নেতৃত্ব হিসাবে ভাবছিলাম তাও বর্ননাতীত। ঘর থেকে বাহির হয়ে হাওরের এলোমেলো পথে পা রাখতেই শুরু হলো গল্প। গল্প শেষ হতে না হতে পৌঁছালাম নির্দিষ্ট গন্তব্যের কাঙ্খিত নদীর পাড়ে। শুরু করলাম মাছ মারা(ধরা)। অনেক সময় ধরার পর দেখা গেলো অনেক মাছ হয়েগেছে। মাছগুলো ছিলো পাঁচমিশালী যেমন- পুঁটি,টেংরা,বাইম,গুতুম, বাইল্যাকড়া,চিংড়ি(ইঁছা) ইত্যাদি। তারপর স্নান শেষ করে আমি আর ভাইয়া বেশ খুশিতে বাড়ি ফিরলাম। ঘরে গিয়ে মা’কে বললাম মা দেখো কি সুন্দর মাছ। মা ঠাকুরমাকে নিয়ে ভীষন খুশিতে মাছ কাটতে বসলে আমি ও ভাইয়া দুজনেই ওদের কাছে বসে মাছ কাটা দেখতেছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ঐ দিন পুঁটি মাছ ছিল একটা। ভাইয়া বলেছেন ক্লিন্টন দেখো ‘পুঁটি’মাছটা কি সুন্দর! মাত্র একটা পুঁটি মাছ।আমি বললাম হ্যা। আমাকে বললেন এটা তুমি খাবে। রান্না শেষে খাবারের পর;চৈত্রের সন্ধ্যায় উঠান ভরা মানুষের মাঝে কোন এক গল্পের মাঝে আমি বলে উঠলাম ভাইয়া দুপুরে মাছ কাটার সময় নির্দিষ্ট করে পুঁটি মাছটিকে দেখিয়ে বিশেষ করে আমাকে খাওয়াতে খাওয়ানোর কারন কি ? এমনিতেই বলা মাত্র হাতে থাকা চায়ের পেয়ালা রেখে বললেন, শুন! “ তোমরা কি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানো? আমি বললাম শুনেছি মা হতে, মা বলেছে তুমিও(আপনি) নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে? বললেন হ্যা, করেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি এবং আমার সঙ্গী সাথী আট-নয় জনের একটি গ্রুপ একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম(ভাইয়া বলছিলেন,জায়গার নাম ঠিক মনে পড়ছে না খুব সম্ভবত কুঁড়ি জগন্নাথপুর,কুর্ধনপুর,বুলনপুর, আলীপুর এদিকের কোন এক বাড়ি)। রাতে খাওয়ার সময় তাঁরা আমাদেরকে পুঁটি মাছের চরচরি,ভাজি তরকারি দিয়ে খেতে দিয়েছিল। মাছ কাটার সময় এই পুঁটি মাছ দেখে আমার মনেপড়ে গেলো সেই দিনটার কথা। আমি তো অনেক পুঁটি মাছ খেয়েছি, খেয়ে সাহস যুগিয়েছি, দেশের জন্য সাহসিকতার কাজ করতে পেরেছি তাই আজকের পুঁটি মাছটি তোমার জন্য বরাদ্ধ করলাম তোমাকে সাহস যুগানোর জন্য। আমিতো ভাইয়ার এমন গল্প শুনে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আর এ ভাবেই ভাইয়াকে কাছে পেয়ে সময় কাটাতাম। প্রতি বছরের ন্যায় ২৫শে চৈত্র ভাটি অঞ্চলের হাওয়র বেষ্টিত খালিয়াজুড়ীর জন্য একটি বিশেষ দিন। এই দিনটিতে উপজেলা খালিয়াজুড়ীতে মেলা হয়। চৈত্র মাসের প্রথম রবি ও সোমবার শাল্লার সোমেশ্বরী মেলা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হলেও ২৫শে চৈত্রের ঘটে যাওয়া মেলাটি খালিয়াজুড়ী অঞ্চলের লোকাল মানুষের কাছে বেশ সমাদৃত। সেই হিসাবে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ন হলেও বক্তিগতভাবে দিনটি আমার কাছে বেশ স্মরনীয়। কারন আমার বয়সানুপাতে ঐ দিনটাতে পেয়েছিলাম একটি বড় টাকার নোট সহ অনেক টাকা।
মেলাতে যাওয়ার জন্য আমার কাছে আসছিল অনেক সহপার্টি বন্ধু বান্ধবরা।এর আগে আমাদের সিদ্ধান্ত স্থির ছিল সবাই এক সাথে যাবো। ভাইয়া আমাদের এখানে থাকায় আমি আনন্দিত মনে আসলাম ভাইয়ার কাছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া আপনি কি মেলায় যাবেন আমাদের সাথে? ভাইয়া আমাকে বললো কিসের মেলা ? বললাম খালিয়াজুড়ীর মেলা এবং আমার সংঙ্গী সাথীরা সবাই যাবে আপনিও চলেন আমাদের সাথে; আমরা সবাই এক সাথে মেলাতে যাই। ভাইয়া বললেন না আমি যাবো না তুমি যাও। ঠিক আছে বলে আমি মন:স্থ করলাম মা’র কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে,মাকে বলে চলে যাবো মেলায়। আমি ভাইয়ার কাছ থেকে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ ভাইয়া বলে উঠলেন ক্লিন্টন দাঁড়াও ? তখন আমি ভাইয়ার কাছে ফিরে আসলাম এবং বললাম কি? তুমি যে মেলায় যাবে তোমার কাছে কি টাকা আছে? বললাম না তবে মার কাছে আছে। বললেন তুমি কি আমার কাছ থেকে টাকা নিবে না ? আমি খুব খুশি হয়ে বললাম দেন। তখন ভাইয়া গায়ে পড়া পাঞ্জাবির পকেট হতে রুমালের ভাঁজ খোলে একটা পাঁচশত টাকার নোট দিলেন। তখন আমি এমন খুশি হলাম যে আমার জীবনে এখন পর্যন্ত এই ধরনের আর এতো খুশি হইনি। এর আগে মা-বাবা থেকে কোন আপনজন-ই এতো বড় টাকার নোট আমাকে দেয়নি। আমি তো প্রথম কিছুটা অন্য রকম হয়ে গিয়েছিলাম যে ভাইয়া কি সত্যিই আমাকে এই পাঁচশত টাকার নোটটি দিচ্ছেন না পরীক্ষা করছেন। তবে টাকা হাতে দিয়ে বলছেন যতটুকু লাগে ততটুকু খরচ করো অঝতা নষ্ট করো না। তারপর টাকাটা হাতে নিয়ে ভাইয়াকে প্রণাম করে,খুশিতে আত্মহারা হয়ে মায়ের কাছে না গিয়ে চলে গেলাম প্রতিবেশী সহপার্টীদের কাছে। তাদের সবাইকে একে একে ভাইয়ার দেওয়া পাঁচশত টাকার নোটটা দেখালাম। খুশিতে হাসতে হাসতে তাদেরকে বললাম তোরা দেখ,আমার ভাইয়া আমাকে মেলায় যাওয়ার জন্য পাঁচশত টাকা দিয়েছেন। ওরা আমার হাতে পাঁচশত টাকার নোট দেখে একজনে আরেকজনকে বলতে শুরু করে বেটা তোর একটা ভাগ্য! তখন আমি এমন খুশি হয়েছি,মনেহয় আমার চেয়ে বেশী খুশি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমি হাসতে হাসতে এবার গেলাম আমার মায়ের কাছে,গিয়ে বললাম মা দেখো ভাইয়া আমাকে পাঁচশত(৫০০) টাকা দিয়েছেন। বললেন কেনো ? বললাম মেলার জন্য। পরে বললো এতো টাকা দিয়ে তুমি কি করবে,হারিয়ে নি ফেলো ? আমি বললাম না মা হাড়াবো না। বললো ঠিক আছে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরো। যাওয়ার পথে সব বন্ধু-বান্ধব সহপার্টিরা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা শুরু করলো ক্লিন্টন তুই মেলায় কি কিনবে ? বললাম যা পছন্দ হয় তাই কিনবো। তখন আমার আরেক বন্ধু বললো ক্লিন্টনকে কতো টাকা দিয়েছে তার ভাইয়া দেখেছিস ? তাদের মাঝে দেখি বলতে শুরু হয়েছে ক্লিন্টনের ভাইয়া কি ভালরে ! ক্লিন্টনকে তার ভাইয়া কি ভালা(ভাল) পায়! কি বিশ্বাস করে। তাদের এসব কথাশুনে তখন অজানা এক খুশিতে মনটা আরো উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। মেলাতে আমি সত্তোর(৭০) টাকা দিয়ে একটি বন্ধুক কিনলাম। ত্রিশ টাকা দিয়ে সবাইকে নিয়ে ঝাল চানাচুর সহ আইসক্রীম খেলাম এর মধ্য থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে গ্যাসভর্তি একটা বেলুন আনলাম। আর বাকী চারশত টাকা ফেরত নিয়ে মা’র কাছে জমা দিয়ে দিলাম। তখন দেখি ভাইয়া ঘরে নাই। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাইয়া কোথায় ? বললেন পাশের বাড়িতে বেড়াইতে গিয়েছেন। মা জানতে চাইলেন তোমার ভাইয়া এতো টাকা দিয়েছেন তুমি তোমার ভাইয়ার জন্য কি এনেছো ? আমার হাতের গ্যাস ভর্তি বেলুন মাকে দেখিয়ে বললাম আমি তো ভাইয়ার জন্য এটা এনেছি। বেলুনটি ভাইয়াকে নিয়ে ভাইয়ার নিজ হাতে আকাশে উড়িয়ে দেবো। আর বাকী টাকাতো রয়ে-ই গেল। মা বললো এই টাকা দিয়ে তুমি কি করবে এবং বেলুন দেখে কিছুটা হাস্যরসে আমাকে ধমক সুরে বললেন আরে ব্যায়াক্কল পুলা(ছেলে) আমার! তোমার ভাইয়া শিশু নাকি যে বেলুন দিয়ে খেলবেন? তোমাকে বাবা টাকা দিলেন তুমি নিজে বন্ধু-বান্ধব মিলে খেয়ে আসলে তুমিতো একটা চকলেটও খাওয়ার জন্য আনতে পারতে। মা’কে বললাম মা আমি আসলে ভাইয়াকে নিয়ে এই ভাবে চিন্তা করি নাই। মা’কে বললাম ভাইয়া যেহেতু ঘরে নাই, এই সময়ের ভিতরে,দোকান থেকে ভাইয়ার কোন একটি প্রিয় জিনিস নিয়ে আসবো? মা বললেন ঠিক আছে। মা’কে বললাম কি আনা যায়? মা বললেন এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসো। আমি এক দৌড়ে গ্রামের দোকান থেকে ভাইয়া ঘরে আসার আগে সিগারেট নিয়ে মার কাছে রাখলাম। আমি বন্ধুদের নিয়ে খেলতে খেলতেই ভাইয়া ঘরে এসে ডাকলেন কইরে “ক্লিন্টন”। আমি এক দৌড়ে ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম ভাইয়া আমি মেলা থেকে একটি বন্দুক এনেছি। জিজ্ঞাসা করলেন তুমি বন্দুক দিয়ে কি করবে? আমি বললাম তোমাদের (আপনার)মতো যুদ্ধ করবো যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছিলেন। ভাইয়া মুচকি হাসলেন;বুঝলাম খুব খুশি হলেন। আমি বললাম ভাইয়া আপনার জন্যও কিছু এনেছি; ভাইয়া বললেন আমার জন্য;আবার কি জিনিস? আমি বললাম আছে মা’র কাছে দাঁড়ান আমি এখনই মা’র কাছ থেকে নিয়ে আসছি। মা আমাদের কথোপকথন পাকের ঘর থেকে শুনে এগিয়ে আসলে আমাকে দেখিয়ে বললেন এখানে রাখা আছে তোমার আনা তোমার ভাইয়ার জিনিস এবং আলনার কোনে বেঁধে রাখা বেলুন। আমি ভাইয়ার জিনিস(সিগারেট) ভাইয়ার এক হাতে দিলাম আর অন্য হাতে দিলাম সূঁতায় বাঁধা বেলুনটি। বললাম ভাইয়া আমি না-বলা পর্যন্ত বেলুনের সূঁতা ছাড়া যাবেনা, ছাড়লেই উড়ে যাবে। আমার কথাবার্তা শুনে ভাইয়া কিছুটা অন্যরকম হলেও বাবা তো একেবারে হতবম্ভ হয়ে উঠলেন! অত:পর ঠাকুরমা,বাবা মা সবাইকে নিয়ে উঠান থেকে আমার পাঁচটাকা দামের বেলুনটি ভাইয়ার হাতে উড়িয়ে দিলাম। সবাই আঁচমকা চেহারায় নিশ্চুপ ! বললাম ভাইয়া পুঁটি মাছ দেখে আপনার যে অনুভুতির কথা মনেপড়েছিল ঠিক একই ভাবে মেলাতে গিয়ে গ্যাসভর্তি বেলুন দেখে আমার মাথায়ও প্রশ্ন ঘুরছিল এই বেলুনটি আপনার হাতে আকাশে ছাড়বো। কারন একাত্তরে যুদ্ধ করে আপনারা আমাদের জন্য দেশ স্বাধীন করেছেন,শান্তি এনেছেন। মেলা থেকে আমি বন্দুক এনেছি,শান্তির কবুতর পাখি তো আর আনিনি,আমি বয়সেও ছোট মানুষ তাই ভাবলাম এই বেলুনটি আপনাকে দিয়ে আকাশে উড়ালে স্বাধীনতার হাস্যোউজ্জল আনন্দটি নীল আকাশে উড়বে আমরাও শান্তির আনন্দটি উপভোগ করলাম। এমনিতেই ভাইয়া আমাকে আইনজামাইরা(জড়াইয়া) কূলে তুললেন,দেখলাম ভাইয়ার দুচোখের কোনায় কিছুটা অশ্রুসিক্ত। আর এমতাবস্থায় এই বেলুন যে সাধারন বেলুন নয় মা হয়তো বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জা(বেলুন নিয়ে কথোপকথন) অনুভব করে সড়ে পরেন।
তৎক্ষনাত সময়ে ভাইয়াও কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে শুনালেন আরেক মেলার কাহিনী। বললেন শুনো- আমি তোমার সাথে তোমাদের এই খালিয়াজুড়ী মেলাতে যাইনাই এটা সত্যি কিন্তু অনেক আগে এই নেত্রকোনা জেলার আরেকটি উপজেলা পূর্বধলাতে গিয়েছি। নাম মনিসিং মেলা। এই মনিসিংহ ছিলেন রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ; মুজিব সাহেবও দাদা হিসাবে নমস্য করতেন। যিনি স্বাধীনতাত্তোর সময়ে মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এই ব্যক্তির নামে যে মেলা হয় তা আমি পূর্বে কখনো শুনিনি। এভাবে শুধু মেলা নিয়ে কাহিনী নয় ; কাহিনী একটার পর আরেকটা শেষ হতে না হতে চলে আসে ভাইয়া আঙ্গারুয়াতে ফেরত যাওয়ার পালা। দুদিন পর চলেও গেলেন। আমি আবার যেই-সেই, একা হয়ে পরলাম। দুই/তিন মাস পর আমি আমার মা,ভাই,বোন সবাইমিলে বেড়াতে গেলাম মামার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে ভাইয়ার সাথে বাজার-হাটে(ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজার)বেড়াতে যেতাম এমনকি ভাইয়ার সাথেই খেলাও করতাম। সত্যি বলতে কি মামার বাড়িতেও ভাইয়াই ছিল আমার একমাত্র খেলার বন্ধু বিশেষ করে দাবা খেলা। কিছুদিন পর আবার আমাদের চলে আসতে হয় আমাদের বাড়িতে। কারন তখন আমার বিদ্যালয়ে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। আসার সময় ভাইয়া আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলছিলেন আমি যদি পরীক্ষায় ভালো করতে পারি তবে ভাইয়া আমাদের বাড়িতে আসবেন এবং অনেক দিন থাকবেন।
ভাইয়ার এই কথা শুনে আমি এক বুক আশা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম। ভাবতে শুরু করলাম সামনে বার্ষিক পরীক্ষা,ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বেড়ে যায় আশার পাল্লা; ভাইয়া নিজে বলেছেন পরীক্ষায় ভালো রিজাল্ট মানে ভাইয়া আসা, ভাইয়া আসা মানে ‘কাঁঠালজানে’স্নানের অনুমতি পাওয়া, স্নান করা,মাছ মারা,আনলিমিটেড খেলাধুলা করা আর আর দু-চোখ খোলা থেকে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত গল্পে বিভোর থাকা। আর মা-বাবা ও ঠাকুরমা হতে অতি:দুসাশনের হাত থেকে রেহাই পাওয়া। সত্যি বলতে কি স্মৃতি যেমন আনন্দদায়ক আবার মাঝে মাঝে বেদনাদায়কও হয়ে দাঁড়ায়। আর আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রনে নিজেও হয়ে যাই আবেগ আপ্লুত। তখন কি বলব,কি করে বলব ভাষা হারিয়ে হতে হয় নিস্তব্ধ। হয়তো আনন্দের পরাজয় আর বেদনার জয়ে। তখন সলিল চোখও স্পর্শকাতর হৃদয়ের শোকাবহ অনুভুতিতে সিক্ত হয়ে ওঠে। আর এই শোকাবহের কিছু নির্দিষ্ট মুহুর্ত,নির্দিষ্ট সময় জীবনের কিছু নির্দিষ্ট দিন হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি আমার জীবনের একটি করুন শোকাবহ দিন হলো ২০০৯ সালের ১৯শে নভেম্বর। এই দিনে আশা আকাঙ্খা ভেঙ্গে আমার ছোটবেলার খেলার সাথী,প্রাণপ্রিয় বন্ধু,ভাইয়াকে ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেলেন অনেক দূরে। যেখান থেকে মানুষ আর কোন দিন ফিরে আসে না। সেনদিনটাকে আমি আমার জীবনের এক চরম বেদনাদায়ক দিন হিসাবে গন্য করি। আজও এই দিনটাকে আমি ভুলতে পারি না। এখনও ‘কাঁঠালজান’নদীর দিকে চেয়ে থেকে আমার ভিতরে যে কান্নার স্রোত বয়ে যায় সেই কান্না কেউ দেখে না। নদী তীরে মাছ ধরতে গেলে ‘খলই’ (ঝাপি) হাতে চোখে ভাসে ভাইয়ার প্রতীত ছবি বুক ফেটে আসে কান্না। যা দেখানো যায় না বুঝানোও যায় না। এমনকি খালিয়াজুড়ী মেলার সময় হলে,রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি,মনবলে যেনো ভাইয়া আসতেছেন কিন্তু যখন বাস্তবে ভাবি তখন আমি আর চোখের জল আটকে রাখতে পারি না।
লেখক – ক্লিনটন সরকার, স্নাতক অধ্যয়নরত,সিলেট।