দিনাজপুরের লটকমারী গ্রামের এক প্রান্তিক সাঁওতাল পরিবারের কৃষক নারী কাপরা হেমব্রম। মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি তার দুই সন্তান ইলিয়াস মার্ডী ও জোনাস যোহন মার্ডীকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধে পাঠান। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট জোরপূর্বক দখল নিয়েছিল পাকিস্থানী সৈন্যরা। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদীপুকুর ওঁরাও গ্রামের অন্যতম মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক বুদু লাকড়া ১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ তীর-ধনুক-বাউংকা-লাঠি-সোঁটা-বল্লম হাতে হাজার হাজার আদিবাসী ও বাঙালিদের নিয়ে রংপুর ক্যান্টনম্যান্ট আক্রমণ করেন। যুদ্ধ শেষ, আদিবাসী-বাঙালি নারী-পুরুষেরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিচ্ছেন। যুদ্ধশেষে অস্ত্র জমাদানের সময় হঠাৎ ফসকে যায় একটি স্থলমাইন। দিনাজপুরের ফাজিলপুরের সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল মার্ডী নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পঞ্চগড়ের বালাভীর গ্রাম থেকে নিজের ৪ মাস বয়সের নাতনী আর প্রয়োজনীয় রসদপত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে অন্যদের সাথে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ভারতের আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছান প্রবীণ সাঁওতাল কৃষক হারমা বেসরা। বৃদ্ধ বয়সে এতো ওজন ও ভাড় সইতে পারেনি তার ঘাড়। ঘাড় ভেঙ্গে আহত তিনি আর বেশীদিন বাঁচতে পারেননি। নিজের ছেলে বাড়কা বেসরাকেও মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। সুমি মুরমু ও লোথরো মার্ডী পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বালাভীর গ্রামের এক সাঁওতাল কৃষক দম্পতি। লোথরো মার্ডী মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশ নেন। সুমি মুরমুকে পাকিস্থানী সেনারা ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্মম অন্যায় নির্যাতন চালায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন অনেক দম্পতি যারা নিজের শরীর কি মগজ রক্তাক্ত করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। কেবল কাপরা হেমব্রম বা বুদু লাকড়া নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আড়াল হয়ে থাকা অস্বীকৃত আদিবাসী সমাজের লাখো নারী যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার পরিজন কী গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগী-বীজধান সামলে রেখেছেন। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিসেনাদের রাত বিরেতে রান্না করে খাইয়েছেন। যাদের শরীর ও মন থেকে ঝরেছে অবিরাম শংকা ও দ্রোহের রক্তধারা, যাদের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা অসমর্থ। মুক্তিযুদ্ধের এই গর্বিত সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমরা যদি নিরপেক্ষভাবে প্রশ্ন করি, প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে আদিবাসী মুক্তিসংগ্রামীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কীনা এর উত্তর কী হবে? চলতি আলাপখানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ণ ও স্বীকৃতির আহবান জানায়, বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থনের দাবি জানায়। চলতি আলাপে আমরা উত্তরবঙ্গের তিন জেলার তিনজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার প্রসঙ্গ টানবো।
ঠাকুরগাঁওয়ের বড় বালিয়া সাঁওতাল আতোতে (গ্রাম) জন্মগ্রহণ করেন টেমকু মুরমু। আগে গ্রামটি সাঁওতালপ্রধান হলেও বর্তমানে বাঙালিদের দখলেই চলে গেছে পুরো গ্রাম। পাশাপাশি ভূট্টার বাণিজ্যিক চাষের ফলে এখন আর আদিবাসী কৃষির চর্চা তেমনভাবে আর দেখা যায় না আশেপাশেও। টেমকু মুরমুদের পরিবার ঐতিহাসিকভাবেই কৃষির উপরেই নির্ভরশীল। টেমকু মুরমুও কৃষিকাজ দেখভাল করেন। টেমকু মুরমু সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। ১৯৭১ সনে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন বাঙালিদের সাথে তাদের আশেপাশে আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে নিজেরাই স্বত:স্ফ’র্তভাবে অংশ নেয়। টেমকু মুরমু দু:খ করে বলেন মুক্তিযুদ্ধের মতো দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়েও অনেকেই আদিবাসীদের হেয় করেছে। আদিবাসীরা যে স্বেচ্ছায় নিজ উদ্যোগে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এরজন্য কেউ তাদের উদ্বুদ্ধ করা বা সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেনি। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের ইসলামপুর জেলার চোপড়া থানায় যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন । মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্মৃতিমন্থন কালে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন প্রতিরাত ছেলে মেয়ে সকলকে নিয়ে জীবন ভয়ে পালাচ্ছে মানুষ। জীবনবাজি রেখে মানুষ বোচকাবাচকিসহ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। তারা কেউ জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে কিভাবে যাচ্ছে। পথে না খেয়ে ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে এমনকি পাকপাহিনীর আক্রমণে কতজন জান দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসহায় মানুষের গৃহ ও দেশত্যাগের ঘটনাসমূহ এখনও তার মনে দাগ কেটে আছে। ভারতীয় সীমান্তের পাড়ে হাজার হাজার মানুষ সকলে আতংকিত এবং সীমানা পার হওয়ার জন্য ব্যস্ত । কেউ কারো খোঁজ নেবার সময় নেই এটা মনে হলে মুষড়ে পড়েন টেমকু মুরমু । জাতিতে সাঁওতাল টেমকু মুরমুর ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের ভেতর কেবলমাত্র হিন্দুরা সহায় সম্পদ হারালেও আদিবাসীদের প্রায় সকলেই তাদের ভূমি ও সম্পদ হারিয়েছে । ঠাকুরগাওয়ের বড়বালিয়া আগে বেশ স্বচ্ছল এক সাঁওতাল গ্রাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐ গ্রাম প্রায় পুরোটাই তছনছ হয়ে যায়। আদিবাসীরা পাকহানাদার বাহিনীর অত্যাচার এবং স্থানীয় বাঙালি মুসলিম রাজাকারদের অত্যাচারে গ্রাম ছেড়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। দেশ স্বাধীনের পর গ্রামে ফিরে এলেও নিজেদের সহায় সম্পত্তি ফিরে পাননি। অধিকাংশই বাঙালিরা দখল করে ফেলেছে। বড়বালিয়া গ্রামের সিধু মুরমুর ছেলে বড়কু মুরমু এবং কান্ডিরাম মুরমুর ছেলে বাড়কাইয়া মুরমুদের কোনো সহায় সম্পত্তি আর তারা ফিরে পাননি। টেমকু মুরমু বলেন, কি কারনে যে দেশ স্বাধীনের পর কোনো কোনো বাঙালি আদিবাসীদের সহায় সম্পত্তি দখলের জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠল তা আদিবাসীরা এখনও ভেবে পান না। টেমকু মুরমু এখনও সনাতন সাঁওতাল ধর্ম পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঁওতাল পরব গুলো বন্ধ ছিল। কারাম, বাহা ও সোহরাই উৎসব গুলো সেসময় করার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। দু:খ করে তিনি বলেন, এখনও এ উৎসব অনুষ্ঠান করার মতো কোনো পরিস্থিতি ও সামর্থ্য আদিবাসীদের নিজেদের নাই। মাইদি কিস্কুর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তাদের দুই ছেলে দুই মেয়ে । বড় ছেলে মানিক মুরমু দশম শ্রেনীতে এবং ছোট ছেলে বুদিন মুরমু নবম শ্রেণীতে পড়েছে। বড় মেয়ে ছানী মুরমু দশম শ্রেনীতে ও মনিকা মুরমু পঞ্চম শ্রেনীতে পড়েছে । সরকারী জমির উপর টেমকু মুরমুর বসত ভিটা এবং আবাদী জমি ৭৫ শতক আছে । একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আদিবাসীসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক নাম ও পরিচয় তালিকা দেশের সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য দাবি জানান। আদিবাসীদের জমি ও সহায় সম্পত্তি যা অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছে তা আইনগতভাবে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকার সচেষ্ট হবে এই তার প্রত্যাশা।
মুক্তিযোদ্ধা সুপল সরেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জের রণগাও গ্রামের এক সাঁওতাল কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সনাতন সাঁওতাল ধর্মাবলম্বী সুপল সরেন বর্তমানে পঞ্চগড়ের জয়নন্দ গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন । তিনি আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী । লোকমুখে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে পারেন প্রথমে। পরে যখন তাদের এলাকায় পাকহানাদার বাহিনী চলে আসে এবং গোলাগুলি ও বোমাহামলা শুরু করে তখন বুঝতে পারেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সুপল সরেনের ভাষ্যমতে, আদিবাসী বাঙালিদের ভেতর তখন সুসম্পর্ক থাকলেও বাঙালিরা কেউ তাকে স্পষ্ট করতে পারেনি কেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণ এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিষয়টি তিনি যখন কথা বলে বলে বুঝতে পারেন তারপর তিনি স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বলে জানান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নিজের চোখের সামনে পাঞ্জাবি সৈন্যরা নারীদের ধর্ষণ করছে নির্যাতন করছে, শিশুদের আছাড় দিয়ে মেরে ফেলছে যখন তখন এসব দৃশ্য তিনি এখনও ভুলতে পারেন না। পাকবাহিনীরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা না দেখলে বোঝানো যাবে না বলে ক্ষোভের সাথে জানান সুপল সরেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল থাকলেও দেশ স্বাধীনের পর বাঙালি মুসলিমরাই আদিবাসীদের জমিজমা সবচে বেশী দখল করেছে। তাদের এলাকায় অনেক বাঙালি মুসলিম পুরুষ পাকসেনাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছিল যারা এখনও বেশ স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সাগরাম মাঝি বা কোনো আদিবাসী নেতার নাম শোনেননি বলে জানান। আদিবাসী পরিবার গুলি ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেও তাদের প্রতিটি দিন শংকা আর ভয়ে কেটেছে। কারন চোখের সামনে এতো মৃত্যু ও ধ্বংস এর আগে কেউ দেখেনি। তাদের গ্রামের মাঝি হাড়াম বা মুরুব্বীরা কেউ যুদ্ধে যোগদানের জন্য তাদের কাউকে বাধ্য করেননি। তার মতে, উত্তরবঙ্গে আদিবাসীদের ভেতর সাঁওতালরাই সবচে’ বেশী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আদিবাসী নারী ও শিশুরা মুক্তিযুদ্ধে তেমনভাবে অংশ নেননি বলে জানান সুপল সরেন। যুদ্ধ শেষে আদিবাসীরা দেশে ফিরে এসে তাদের ফেলে রেখে যাওয়া সহায় সম্পদের অধিকাংশই আর ফেরত পাননি। ১৯৬৫ সালে সুপল সরেন মঙ্গলী মুরমু’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ৩ জন ছেলে মেয়ে। মেয়ে লক্ষী সরেন (৩৫ ) কৃষি মজুর। মেলচা সরেন কৃষি মজুর। সীতা সরেন দিনাজপুরে থাকে। লক্ষী ও মেলচা সরেন বাবার বাড়ীতেই থাকেন । সুপল সরেনের বসতভিটা এবং চাষের কোন জমি নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি কোনোধরনের সরকারী ভাতা বা সুবিধা পাননি। তার কোনো তথ্য বা ছবি কোনো পত্রিকা বা বইতে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তিনি জানেন না।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বালাভীর এক ঐতিহাসিক সাঁওতাল জনপদ। চলতি সময়ে বালাভীর আর সাঁওতাল গ্রাম হিসেবে টিকে নেই প্রভাবশালী বাঙলিদের দ্বারা দখল হয়েছে। বালাভীর গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাড়কা বেসরা। জাতিতে সাঁওতাল বাড়কা বেসরা সনাতন সাঁওতাল ধর্ম পালন করতেন। চতুর্থ শ্রেণীর পর আর পড়াশুনা করতে পারেননি বাড়কা। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি একত্রিশ বছরের। কৃষিকাজ করেন আর সংসার দেখাশোনা করেন। প্রায় হঠাৎ করেই তারা কিছুই আগে থেকে জানতেন না, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হামলে পড়ল গ্রামে গঞ্জে। গোলাবারুদ আর বোমা বিস্ফোরনে নিশ্চিহ্ন করে দিল সব। চোখের সামনে নির্বিচার ধর্ষণ ও হত্যা করল। বারুদের পোড়া গন্ধ আর লাশের পোড়া গন্ধ দম আটকে আসতো। কেউ কোথাও বেরুতে পারতো না। গ্রামের লোকজন সহ মানঝিদের বৈঠক হয়। কারা কিভাবে দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিবে এগুলো আলোচনা হল। জন্মমাটি আর সহায় সম্বল সব ফেলে মানুষ চলল নিরুদ্দেশে। কেউ জানতো না কে কোথায় যাচ্ছে। জানতো না যেখানে যাওয়া হচ্ছে সেই জায়গাখানি নিরাপদ কিনা। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বর্ণনা দিলেন বাড়কা বেসরা। বাড়কা বেসরা চার দিকের অবস্থার কথা চিন্তা করে নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ভারতের দাড়িভিটা ইসলামপুর থেকে ৭ দিন অবস্থান করে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন । একজন ভারতীয় নাগরিকের নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধ করেন। যার নাম তিনি স্মরণ করতে পারেননি। পাকসেনারা দিনাজপুরের বীরগঞ্জের গন্ডুলাপগঞ্জে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংস তান্ডবলীলা চালায়। সেই সময় মুক্তিসেনাদের সাথে লড়াইয়ে এক সময় পাক সেনারা পিছু হটতে থাকে। তিনি মুক্তিসেনাদের সাথে সেইসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একবার পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে তিনি বলরামপুর এলাকায় একজন খানসেনাকে জীবিত ধরে ফেলেন। বাড়কা বলেন, তারপর তীর বিদ্ধ করে সেই শত্র“কে মেরে ফেলি । তারপর হতে আর থাকতে পারিনা তাদের অত্যাচারে। পরিজন পরিবারকে ভারতে পাঠিয়ে দিই। বাড়কা বেসরার মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসে। কিন্তু অনেকেই চিরদিনের মত হারিয়ে যায়। তারা ছোটসময়ের অনেক বন্ধু ও স্বজনদের এভাবেই হারিয়েছেন। হারিয়েছেন সহায় সম্পদ ও ভূমি। বাড়কা বেসরার মতে আদিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধের পরেই জায়গা জমি হারায় সবচে’ বেশী। তাদের এলাকায় অনেক বাঙালি মুসলিম পাকসেনাদের সহায়তা করতো। যুদ্ধের পর তাদের কোনো বিচার হয়নি, তারা সমাজে বেশ প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়েই আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে করুণ এক দু:খের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যুদ্ধকালীন সময় তার বৃদ্ধ পিতা তাদের ৪-৫ মাস বয়সের ছোট কন্যা এবং রসদপত্র ঘাড়ে করে ভারত নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে তার বাবার ঘাড় ভেঙ্গে তিনি অসুস্থ হয়ে যান। তারপর দেশের জন্য যুদ্ধ করে নিজের মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি। তিনি আরও বলেন তার এক ভাতিজিকে খানসেনারা ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষন করার পর তাকে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। সে এখন বিবাহিত এবং ভারতে অবস্থান করছেন। বাড়কা বেসরা তার ভাতিজির রক্তাক্ত শরীর ও মনের স্মৃতি আর কখনোই মনে আনতে চান না বলে জানান। মঙ্গলী সরেন এর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তাদের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে । তাদের দুই ছেলেই দিনমজুরির কাজ করেন এবং মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে তাদের সাথেই থাকেন। বাড়কা বেসরার ক্রয়সূত্রে ০.২২ শতক বসত ভিটা আছে এবং আবাদী কোন জমি নেই ।
দেশের নানাপ্রান্তে, নানা আদিবাসী সমাজে এখনো বহু আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাননি। ভূমিদখল আর নিপীড়নের ভেতর চলছে ক্ষয়িষ্ণু জীবন। আশা করি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধার সমমর্যাদার বয়ানেই বিকশিত করবো গৌরবের বিজয় আখ্যান।
গবেষক ও লেখক। ই-মেইল: : animistbangla@gmail.com