1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন

হাওরাঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ : রোধকল্পে কিছু প্রস্তাব ।। দুলাল মিয়া

  • আপডেট টাইম :: সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮.৩১ এএম
  • ৪৫৭ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ। হাওর বাওরের জেলা হিসেবে এর কদর রয়েছে সর্বত্র। বলা হয়ে থাকে ‘মৎস্য- পাথর- ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ। এ জনপদের হাওর বাওরের প্রকৃতির উদারতা আর জল জোছনার ছায়া-মায়ায় মানুষজন হয়ে ওঠেছে সরল উদাসীন। যা বাইরের মানুষকে সহজে পুলকিত করে। এ জেলার যেমন রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা; তেমনি সংকটেরও শেষ নেই। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ও পশ্চাদপদ জেলা সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের শিক্ষার হার ৩৫% (সূত্র: সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়ন)। এ জেলার শিক্ষার হার এতো কম থাকার অনেক কারণই রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া। তাই এ জেলার শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী তা রোধকল্পে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
২০১৬ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় সুনামগঞ্জ জেলায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৬০০২৪ জন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৫৬০৯৫ জন। অনুপস্থিত ছিল ৩৯২৯ জন। (সূত্র: দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর, ২০ নভেম্বর/২০১৬)। ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার্থী ছিল মোট ৫৯৭৮৭ জন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৫৫৫৮ জন। অনুপস্থিত ছিল ৪২০৫ জন। (সূত্র: হাওর ২৪.নেট, ১৯ নভেম্বর/২০১৭)। ২০১৮ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার্থী ছিল ৬১৩৯৩ জন। অংশ নিয়েছিল ৫৬৪১০ জন। অনুপস্থিত ছিল ৪৯৮৩ জন। (সূত্র: দৈনিক সুনামকন্ঠ, ১৯ নভেম্বর/২০১৮)। ২০১৯ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার্থী ছিল ৫১১৭১ জন। অংশগ্রহণ করে ৪৭২২২ জন। অনুপস্থিতি ছিল ৩৯৪৯ জন। (সূত্র: জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, সুনামগঞ্জ)। সুনামগঞ্জ জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে খোঁজ নিলে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার তথ্য তাঁদের অফিসে নেই।
করোনা মহামারি হাওরাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের জন্য যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। মহামারির কারণে প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগের মতো শিক্ষার্থী যাচ্ছে না। স্কুল খোলার ১২Ñ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫দিন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে দুর্গম এলাকার কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ ও দরিদ্রতার কারণে এমনিতেই হাওর এলাকায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি এর মধ্যে করোনার জন্যে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে হাওর এলাকায় প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে (সূত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)।
কারণ সমূহ:
১। দরিদ্রতা : হাওর জনপদ সুনামগঞ্জে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ দরিদ্রতা। হাওর এলাকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। দরিদ্রতার কারণে মা-বাবা তাদের সন্তানদের পড়ালেখা ছাড়িয়ে উপার্জনের কাজে লাগাচ্ছেন। তাই দরিদ্রতার চাবুকের কষাঘাতে জীবন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে অভিভাবকদের আর্থিক অস্বচ্চলতার কারণে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলের পথ ভুলতে থাকে।
২। অভিভাবকদের অসেচতনতা : অভিভাবকের সচেতনতার অভাবে ঝরে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। ছেলে মেয়েদের নির্ধারিত বয়সে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে এ বিষয়টিই অনেকের জানা নেই। আবার অনেকেই ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়ার পরেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় মনে করেন। তাদের এ দায়িত্বহীনতার সুযোগে শিক্ষার্থীরা দিন দিন পড়ালেখায় অমনোযোগী হতে হতে একদিন শিক্ষার সোনালি জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।
৩। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও সুনামগঞ্জের বাও’। প্রচলিত এই কথা থেকে সুনামগঞ্জের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল ভৌগোলিকভাবে নিঃসঙ্গ। জনপদগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ দুরাবস্থার কারণে পায়ে হেঁটে অনেক দূর বিদ্যালয়ে যাতায়াতে শিক্ষার্থীরা অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। আর বর্ষাকালে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। হাওরের প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকার সাধারণ চলাচল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এমনকি প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই আতঙ্কিত অবস্থায় অভিভাবকগণ এত কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে না পাঠানোই পছন্দ করেন। প্রাণহানি বা বিপদের ভয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দেয়।
৪। পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব : শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আরেক উল্লেখযোগ্য কারণ পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব। এখানে জনগণের তুলনায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতার কারণে এ দারিদ্র্য জনপদের অনেকের পক্ষেই দূরে গিয়ে পড়া লেখা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যার ফলে দেখা যায়, এই দুরবস্থার শিকার হয়ে আগ্রহ থাকার পরেও অনেক শিক্ষার্থী স্বপ্নীল জীবন থেকে ঝরে পড়ে।
৫। বাল্যবিবাহ : বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে এখানকার মানুষজন সচেতন নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েরা সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পরই অনেক অভিভাবকেরা তাদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান। যার ফলে পড়া লেখার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করে।
৬। বিদেশ গমনের প্রবণতা : বৃহত্তর সিলেট তথা সুনামগঞ্জের মানুষের মাঝে অপরিণত বয়সে বিদেশ গমনের এক অশুভ প্রবণতা রয়েছে। এ প্রবনতার কারণে অনেক সময় নবম-দশম শ্রেণিতে পড়–য়া শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পাড়ি দেয়।
৭। শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকের মধ্যে দুরত্ব : শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্কের অবণতি ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকগণ অতি দূর থেকে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ফলে ক্লাসের বাইরে ছাত্র অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগের কোনো সময় থাকে না। ফলে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক তাদের সমস্যা ও অভিযোগ একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারে না। যার কারণে অনেক অভিভাবকদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়।
৮। স্কুল ভীতি : স্কুল ভীতি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। পড়ার অতিরিক্ত চাপ সইতে না পেরে এবং শিক্ষকদের শাসন দৃষ্টির ফলে তাদের মধ্যে একধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তারা ঝরে পড়ে।
৯। শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ : শিক্ষা সেবার পরিবর্তে যতোই বাণিজ্যিক রূপ নিচ্ছে ততোই এর কুপ্রভাব শিক্ষার্থীর ওপর পড়ছে। অনেক গরিব অভিভাবকই শিক্ষার অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে না পেরে ছেলে- মেয়েদের পড়া লেখা ছাড়িয়ে রোজগারের কাজে লাগিয়ে দেন।
১০। দুর্বল অবকাঠামো : হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয়ের দুর্বল অবকাঠামোও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। অনেক বিদ্যালয়েই পর্যাপ্ত শ্রেণিক্ষ, সীমানা প্রাচীর নেই। অবকাঠামোগত নানাবিধ সংকটের কারণে বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু কার্য ক্রম ব্যাহত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।
১১। শিক্ষক স্বল্পতা : শিক্ষক স্বল্পতা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয়। বাহিরে শিক্ষকগণ প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে চাকরি করতে খুবই অনাগ্রহী। অনেক বিদ্যালয়ে দেখা যায় ৫/১০ জন শিক্ষকের স্থলে ২/৩ জন শিক্ষক রয়েছেন। আবার এমনও দেখা যায় কোনো বিদ্যালয়ে একজন মাত্র শিক্ষকই বিদ্যালয়ের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছেন। এই ১/২/৩ জন শিক্ষকের দ্বারা পাঠদান দূরের কথা তাদের পক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাই সম্ভব হয় না। অনেক জায়গায় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ক্লাস পরিচালনায় অপারগতা ও বিশৃঙ্খলার ফলে আস্তে আস্তে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ভেঙ্গে পড়ে আর এই ফাঁকেই অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
১২। সামাজিক কুসংস্কার : হাওর জনপদের সহজ সরল মানুষের মাঝে অনেক সামাজিক কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। তাদের অনেকের ধারণা বিশেষতো মেয়েদের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। অল্প বয়সেই তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের এই কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও গোড়ামির শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্র্র্থী ঝরে পড়ে।
১৩। প্রযুক্তির অপব্যবহার : বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহারে সমাজে নানা রকম অশ্লীলতা বিরাজ করছে। অশ্লীল ক্রিয়া-কলাপের কারণে অধিকাংশ কিশোর কিশোরীরা ইচঁড়ে পাকা হয়ে ধাবিত হচ্ছে কুৎসিত অনন্দের দিকে। এই বিভীষিকার ধোয়ার ম্লান হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেক কিশোর- কিশোরীই শিক্ষা জীবনের সোনালি পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।
১৪। পর্যাপ্ত চিত্ত বিনোদনের অভাব : শিক্ষার্থীদের বিদ্যাশিক্ষাকে চিত্তাকর করতে এবং পাঠ্য বিষয়ের প্রচন্ড চাপ লাঘব করতে শিক্ষার সাথে সাথে খেলা ধুলার বিকল্প নেই। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে চিত্তবিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ না থাকায় পড়া লেখাকে প্রচন্ড বোঝা মনে করে শিক্ষার্থীরা অনেকেই বিদ্যালয় মুখী হতে চায় না।
১৫। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব: প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবকে এ হাওর অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে নেয়া যায়। শিক্ষকের মানগত ও আচরণগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এ অঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা সবল দুর্বল সকল শিক্ষার্থীদের উপযোগী পাঠদানে ব্যর্থ হওয়ায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের মাঝে একধরনের ভীতির জন্ম হয়ে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করে।
১৬। প্রাকৃতিক দুর্যোগ : হাওরাঞ্চলে শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগাম বন্যা, বজ্রপাত, বিরামহীন ঝড়-বৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতে পারে না। হাওর এলাকায় বন্যার সময় বিদ্যালয়গুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হয়। যার কারণে
১৭। বজ্রপাত: হাওরবাসীর নিকট সম্প্রতি এক চরম আতঙ্কের নাম বজ্রপাত। ২০১৭ সালে নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। এখন মেঘলা আকাশ দেখলেই হাওরবাসীর দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। গত ৬/৭ বছরে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৫০ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছে আরও শতাদিক বজ্রপাতে মারা যাওয়া হাওর এলাকার শ্রমিক, কৃষক, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পথচারী অন্যতম। বজ্রপাতের সময় শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমন ঝূঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কমতে থাকে।
উপর্যুক্ত কারণ গুলো ছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে যেগুলো বৃহৎ পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে।
প্রস্তাবসমূহ:
১। ক. ছাত্র ছাত্রী নির্বিশেষে সবাইকে উপবৃত্তির আওতায় আনতে হবে।
খ. বিনামূল্যে শুধু বই পুস্তকই নয়, খাতা-কলম, স্কুলড্রেসসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবে।
গ. প্রতিটি বিদ্যালয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে স্কুল মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
ঘ. শিশুশ্রম বন্ধে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
২। ক. অভিভাবকদের শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা চালাতে হবে।
খ. শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের নিয়ে মত বিনিময় করতে হবে।
গ. প্রয়োজনে উদাসীন অভিভাবকদের আইনের আওতায় এনে তাদের ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য করতে হবে।
৩। ক. বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীদের যোগাযোগের জন্য ওয়াটার বাস বা স্পেশাল নৌসার্ভিস চালুসহ নির্বিঘেœ বিদ্যালয়ে যাতায়াতের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
খ. সম্ভাব্য স্থানে রাস্তা নির্মাণ, পুরাতন রাস্তাগুলো সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে।
গ. হাওর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য ভাসমান বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। ক. হাওর জনপদের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
খ. জনস্যংখার কথা বিবেচনায় এনে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
৫। ক. বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
খ. বিদ্যালয়গামী কোনো শিক্ষার্থী যাতে বাল্য বিবাহের শিকার না হয় এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
৬। ক. বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা রোধ করতে হবে।
খ. শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। ক. প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ছাত্র ও অভিভাবকদের দুরুত্ব দূর করার লক্ষ্যে নিয়মিত তাদের মধ্যে সমাবেশের আয়োজন করতে হবে।
খ. বিদ্যালয়ের পাশে ছাত্র শিক্ষক উভয়ের জন্য আবাসিক হোস্টেল নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। ক. পড়া লেখার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ প্রদান করতে হবে।
খ. রূঢ়তা নয়, শিক্ষার্থীদের প্রতি ¯েœহ! বন্ধু সুলভ আচরণ করতে হবে।
গ. কোনো বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে জটিল না করে সহজ সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৯। ক. শিক্ষা সেবার নামে যেসব প্রতিষ্ঠানে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে কোচিং ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়, তা বন্ধ করতে হবে।
খ. অতিরিক্ত ভর্তি ফি, মাসিক বেতন ফি, পরীক্ষা ফিসহ সকল ধরনের ফি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। এবং আর্থিক অনিয়ম কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।
১০। ক. বিদ্যা লয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরীর জন্য ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।
খ. বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাব দিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. প্রশাসনিক তদারকী জোরদার করতে হবে।
১১। ক. বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
খ. শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য অঞ্চল শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. প্রয়োজনে হাওরাঞ্চলের প্রতিটি বিদ্যালয়ে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ. হাওর অধ্যুষিত প্রতিটি উপজেলায় শিক্ষক-কর্মচারিদের জন্য হাওর ভাতা চালু করতে হবে।
১২। ক. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার অভিমান চালাতে হবে।
খ. হাওর জনপদের সহজ সরল মানুষের মাঝে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য শিক্ষা মেলার আয়োজন করতে হবে।
১৩। ক. প্রযুক্তির অপব্যবহারের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।
খ. কিশোর কিশোরীরা যাতে ইচঁরে পাকা না হয়, এজন্য অভিভাবকদেরকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
১৪। ক. শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বিষয়ের চাপ লাঘবের কথা মাথায় রেখে বিদ্যালয় গুলোতে পর্যাপ্ত চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
খ. শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি দূরকরার জন্য পাঠ দানের পাশাপাশি আনন্দ দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫। ক. শিক্ষকদের মানগত ও আচরণগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
খ. প্রশিক্ষিত শিক্ষকগণ তাঁদের অর্জিত দক্ষতা শিক্ষার্থীদের মাঝে সঠিকভাবে যাতে প্রয়োগ করেন তা নিশ্চিত করণে কর্তৃপক্ষের তদারকী জোরদার করা প্রয়োজন।
১৬। ক. প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে শিক্ষার্থীরা বাড়ি বসে যাতে পড়ালেখা নিয়মিত করতে পারে সেজন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করতে হবে।
খ. মোবাইল ফোন বা আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যে কোনো সহজ ডিভাইস ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সাথে কন্টিনিউ যোগাযোগ রাখতে হবে।
১৭। ক. বজ্রপাতের সময় যেকোনো ধরনের খেলাধুলা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হবে। ঘরের ভেতরে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
খ. বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাদের নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
গ. খালি জায়গায় উঁচু গাছ-পালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ারের কাছাকাছি থাকাবে না। তাৎক্ষণিক বজ্রপাত পরিস্থিতিতে খোলা মাঠে বা খালি জায়গায় পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে/শুয়ে পড়তে হবে।
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জে শিক্ষাক্ষেত্রে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। শিক্ষার উন্নয়নে সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত করা অসম্ভব কিছু নয়। পশ্চাদপদ হাওর জনপদকে শিক্ষার মূল ধারায় আনতে সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সামাজিক শিক্ষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরতে হবে। সরকারি, বেসরকারি ও সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধকরা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
লেখক: দুলাল মিয়া, প্রভাষক (বাংলা বিভাগ), জাউয়া বাজার ডিগ্রি কলেজ।
dulal4261@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!