বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের একটি ভোট কেন্দ্রে সিলমোহর মারা তিনটি খামে তিন বান্ডেল সিলমারা ব্যালট পেপার উদ্ধার করা হয়েছে। প্রকাশ্যে এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সামনে উদ্ধারকৃত ওই ব্যালট পেপার গুণে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোট বেশি। তাছাড়া উদ্ধারকৃত ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকের উপর একাধিক সিল মারাও দেখা গেছে। নির্বাচনে ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোকাররম হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিম রাজা চৌধুরী থেকে ৫৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তবে রবিবার দুপুরে উদ্ধারকৃত ব্যালট পেপার গুণে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নৌকা প্রতীকে ১৩৭ ভোট বেশি। এই হিসেবে তিনি ৮৪ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ বিলকিস তার স্ত্রীর বড়ো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেনকে চশমা প্রতীকে প্রভাব দেখিয়ে বিজয়ী করান বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই কেন্দ্রটি বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রভাবিত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি। নৌকার পরাজিত প্রার্থী সেলিম রেজা চৌধুরী ও তার সমর্থকরা জানিয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের একটি চক্র তার বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে তার ভোট ছিনতাই করে বিজয়ী হয়েছে। তিনি ব্যালট পেপার উদ্ধার ও জব্দ করতে প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে এ ঘটনায় আজ সোমবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে যাবেন বলে জানিয়েছেন। প্রশাসনেও এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে গত ৫ জানুয়ারি ধর্মপাশা উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ঘুলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাল ভোট কেন্দ্রে ভোটার ছিল ৯৮২ জন। এর মধ্যে কাস্ট হয় ৮২৭ ভোট। ওই ভোট কেন্দ্র আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মোকারম হোসেনের প্রভাবিত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রশাসনকে প্রভাবিত করে তার পক্ষের প্রিসাইডিং অফিসারকে ওই স্কুলে দ্বায়িত্ব নিয়ে আনেন বলে অভিযোগ আছে। ওই দিন ভোট গণণায় মোকারম হোসেনের চশমা প্রতীকে ৪৮৬ ভোট এবং নৌকা প্রতীকে ২৬৪ ভোট দেখান ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বাদশাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তপন কান্তি তালুকদার। রবিবার বিদ্যালয় থেকে সিল মারা যে বেলট পেপার উদ্ধার করা হয়েছে সেই পেপার দেখে স্থানীয় জনতা সন্দিহান হন। তারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির হাসান ঘটনাস্থলে ছুটে যান। জনতার দাবির প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর উদ্ধারকৃত বেলট পেপার গুণার দাবি ওঠলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই উদ্ধারকৃত ব্যালট পেপার গুলো গণণা করেন খোদ প্রিসাইডিং অফিসার। সেই গণনায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোকারম হোসেনের চশমা প্রতীকের ৫টি বান্ডিল খুলে দেখা গেছে চারটিতে তার একশ করে ভোট। একটিতে ৮৬ ভোট। জনতার সামনে ভোট গণণার সময় দেখা যায় বাতিল ভোট বাদ দিলে চশমার ভোট ৩৪৯টি। আরো ১৩৭টি বাতিল ভোট সঠিক দেখিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তপন কান্তি তালুকদার চশমার ভোট বেশি দেখান। তবে উদ্ধারকৃত ব্যালট পুনগণনায় দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর চেয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিম রাজা চৌধুরী ৮৬ ভোট বেশি। কিন্তু ওইদিন গভীর রাতে ফলাফলে তাকে অপরাজিত দেখিয়ে চশমা প্রতীককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিদ্যালয়ের প্রিসাইংডিং কমকর্তা তড়িগড়ি করে বিদ্যালয় ছেড়ে আসেন বলে জানান এলাকাবাসী।
আওয়াম লীগ প্রার্থী সেলিম রাজা চৌধুরী বলেন, আমাকে ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে। আজকের বেলট পেপার উদ্ধার ও জনতার সামনে পুন গণনায় আমার ভোট বেশি থেকেই সেটা প্রমাণ হচ্ছে। আমি প্রশাসনসহ আদালতের দ্বারস্থ হবো।
ওই ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইংডিং কর্মকর্তা তপন কান্তি তালুকদার বলেন, ভুল করে সিলমারা বেলট পেপার রেখে এসেছিলাম। তবে বাতিলকৃত ভোট বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে সঠিক দেখালেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি তিনি জবাব দেন ভুলে বেলট পেপার রেখে এসেছিলাম। পুনরায় রবিবার ভোট গণনা করে বৈধ ভোটের খামে বাতিল ১৩৭ ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি তিনি বলেন, কিভাবে কি হলো আমি জানিনা। সন্ধ্যায় তিনি প্রশাসনের চাপে থানায় জিডি করে বেলট পেপারগুলো থানায় রাখা হয়েছে বলে জানান। তবে জনতার সামনে রবিবার পুন গণনায় ভোটের প্রকৃত হিসাব তিনি স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্টদের কাছে দিয়েছেন যার ভিডিও ও ছবি এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুর রহমান বলেন, আমি বৃহস্পতিবার স্কুলে আসিনি। শনিবার এলেও খামগুলো খেয়াল করিনি। রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষ পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনটি খামের ভেতরে ব্যালট মারা পেপারগুলো নজরে আসে। ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে ইউএনও স্যারকে জানাই। দুপুরে এসব ব্যালট পেপার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে গণণা হয় এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে হস্থান্তর করা হয়। আমরা চশমার ভোটের বান্ডিলে একাধিক সিল মারা ব্যালট পেপারও পেয়েছি। গুণে দেখেছি প্রায় ১৩০টির উপরে এমন সিল মারা পেপার রয়েছে। এগুলো বাদ দিলে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার কথা বলে জানান তিনি।
সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মাহমুদ হাছান বলেন, ইউএনও স্যারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপার রেখে চলে এলে বিধি অনুযায়ী যাবতীয় দায় সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে নিতে হবে। আমরা এতে জড়িত নই। তবে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ব্যালট পেপার উদ্ধারের পর একটি জিডি করে ব্যালট পেপার থানার জিম্মায় রাখার কথা জানিয়েছেন। তিনি উদ্ধারকৃত ব্যালট পেপার থানায় জমা রেখেছেন বলে জানান।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির হাসান বলেন, বেলা পোনে দুইটার দিকে তিনটি খামের ভেতরে থাকা চেয়ারম্যান পদের সিলমারা ব্যালট পেপারগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। গণনাও করা হয়েছে। এ বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে অপারগতা জানান।
তবে অভিযুক্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিদ্রোহী প্রার্থীর স্ত্রীর বড়ো ভাই শামীম আহমদ বিলকিস বলেন, আমি কোন ষড়যন্ত্রে জড়িত নই। আমিও এই রহস্য উদঘাটনের দাবি জানাই।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রবিবার বিকেলে আমরা খবর পেয়েছি। দুর্গম এলাকা হিসেবে যেতে পারিনি। তাই আজ সোমবার (১০ জানুয়ারি) আমরা ঘটনাস্থলে যাব। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য এই ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী হন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর ও সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মহারাজ মিয়ার ছেলে সেলিম রাজা চৌধুরী। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফরে এসে রাজাপুরে মহারাজ মিয়া চৌধুরীর বাড়িতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্শুর স্মৃতিধন্য এই স্থানটি সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ বিশেষ উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট পরিবারকে ষড়যন্ত্র করে হারানোয় ক্ষুব্দ হয়ে ওঠছেন সাধারণ মানুষজন।
(উদ্ধারকৃত বেলট পেপার পুনগণনার ভিডিও আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে)