চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনীলচন্দ্র সমাজপতি। গতকাল ২৫/১/২০২২ খ্রি. তারিখ সন্ধ্যা ০৬-৩০ টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলাধীন বাজারকান্দি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদ সংগ্রামী এই মানুষটি মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৬৯ সালে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তৎসময়ে সুনামগঞ্জ সদর থানা হতে আইয়ূব খানের ছবি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ তালেব সহ অন্যান্যদের নিয়ে তিনি নামিয়ে ফেলেন! কাজটি কত ভয়ংকর দুঃসাহসীকতাপূর্ণ ছিল, ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ শহর, দিরাই – শাল্লা সহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করেন। ‘৭০ এর নির্বাচনে আব্দুস সামাদ আজাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় বঙ্গবন্ধু আসেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ধর্মপাশা, সাচনার কাছে নয়াগাঁও বাজার ও দিরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে সভা করা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন।
১৯৭১ এর ০৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণে যখন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বললেন তখন তিনি অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে গণসংযোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি শাল্লার আটগাঁও গ্রামের প্রফেসর নজরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে দিরাই গচিয়া গ্রামের সালেহ চৌধুরী ( প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি টেকেরঘাট সাব সেক্টরের অধীনে দিরাই- শাল্লায় বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন) সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করেন এবং করনীয় বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন। পরে তিনি ভারতের দেরাদুন ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট ( বিএলএফ) এর সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বৈশাখ মাসে সুনামগঞ্জ থেকে ০৭ টি রাইফেল থ্রি- নট- থ্রি যায় দিরাইয়ের কুদ্দুছ মিয়া সাহেবের কাছে যা দিরাইয়ের ব্রজেন্দ্র ডাক্তারের বাড়িতে রাখা হয় সেখান থেকে তিনি অস্ত্রগুলি আটগাঁওয়ের হারুন মিয়া, ফৌজদার মিয়া, মনোরঞ্জন ( বাজারকান্দি) তাদেরকে সাথে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এই অস্ত্রগুলি দিয়ে আটগাঁও গ্রামের মতিউর রহমান ( তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তান এয়ারফোর্সের অফিসার) তিনিসহ আটগাঁও – বাজারকান্দির অনেক যুবকদেরকে ৫/৭ দিন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করার জন্য কয়েকটি গ্রামে কয়েকজনের দায়িত্বে অস্ত্রগুলি রাখা হয় যেগুলি পরবর্তিতে তিনি দিরাইয়ের কুদ্দুছ মিয়া ও চাঁন মিয়ার কাছে তারা চাইলে ফেরৎ দিয়ে দেন।
দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ ঢাকার পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
স্বাধীনতার পরও তিনি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। সম্ভবত ১৯৮৩ সালের পর দিরাইয়ের শ্যামারচর কৃষিব্যাংকের কতিপয় কর্মচারীর দুর্নীতির প্রতিবাদে আর. সি হাইস্কুল মাঠে এক সভা হয় সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড অমরচাঁদ দাস, তৎকালীন চরনারচর ইউপি চেয়ারম্যান চিত্ত রঞ্জন রায় চৌধুরী সহ অন্যান্যদের সাথে তিনিও সক্রিয় ছিলেন।
প্রফেসর নজরুল ইসলাম যিনি মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর সার্বক্ষণিক সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য সুপারিশকারীদের মধ্যে সুনীল সমাজপতি একজন। সালেহ চৌধুরী তার সহযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেন, ‘ সহযোদ্ধা হিসেবে আটগাঁওয়ের নজরল ইসলামকে কাছে পাওয়া আমার জন্য ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। নজরুল ছিল ছাত্রলীগের কর্মী। আমার পরিচয় এককালে ছাত্র ইউনিয়ন করে তখন কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক। নজরুলের আমার সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল না। সে কিন্তু এই এলাকার যুদ্ধে আমাকে অপরিহার্য মনে করে আমাকে সাহায্যের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেয়। আমি বিশ্বাস করি, সে আমার সঙ্গে যুক্ত না থেকে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করলে অনেক বেশি খ্যাতি ও গৌরব অর্জন করতে পারত। নজরুল তার দক্ষতা আর নিষ্ঠা দিয়ে আমাকে টিকিয়ে রেখেছে।’
কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রফেসর নজরুল ইসলামের নাম এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি!
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনীল সমাজপতি দীর্ঘদিন যাবৎ অসূস্থ ছিলেন। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। কয়েকমাস পূর্বে সিনিয়র বিশিষ্ট আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী স্যার ও আমি উনার সুনামগঞ্জের বাসায় উনাকে দেখতে গিয়েছি। এরও বছর খানেক পূর্বে উনার একটা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিতে উনার বাসায় গিয়েছি। অনেক কথা হয়েছে।
আজ তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের জন্য রেখে গেছেন স্বাধীন একটি দেশ, বাংলাদেশ।
বিনম্র শ্রদ্ধা হে বীর।
[ সূত্র: সাক্ষাৎকার- সুনীল সমাজপতি
আলাপচারিতা: ১। কমরেড অমরচাঁদ দাস ২। প্রফেসর নজরুল ইসলাম
বই: ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার, সালেহ চৌধুরী ]