1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

বন্যপ্রাণীরা পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখছে।। পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২, ১.০৭ পিএম
  • ৩১১ বার পড়া হয়েছে

‘সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের টিকে থাকা’ এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বখানি
অধিকাংশরাই না জেনে, আংশিক জেনে, অস্পষ্ট জেনে বা না বোঝে হরহামেশা ব্যবহার
করেন। কৃষিজমিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান এমন অনেক মানুষের সাথে কথা হয়েছে
যাদের অনেকের ধারণা নেই এই তত্ত্বখানি মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচন, প্রাণজগতের
বিবর্তন এবং বা¯‘তন্ত্রের জটিল সম্পর্কের সাথে জড়িত। এমনকি তাদের অধিকাংশই
ডারউইনের মূল লেখা বা তাঁর কোনো বইও কোনোদিন ঘেঁেট দেখার দায় অনুভব
করেননি। অধিকাংশরাই অন্যের কাছে এটি শুনেছেন, অনেকটাই বানর থেকে মানুষ
এসেছে এমন ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ গোছের। এভাবেই কানকথা হতে হতে একটা লম্বা
সময় জুড়ে এর মানে পাল্টেছে। কাল ও দেশের গন্ডিতে কেবল নয়, মনোজগতেও। আর তাই এই
বিশ্বনিখিলে প্রজাতি হিসেবে মানুষ ক্রমশই বা¯‘তন্ত্রে টিকে থাকার বিজ্ঞান থেকে
বি”িছন্ন হয়ে পড়ছে। গায়ের জোরে এই বৈজ্ঞানিক সত্য পাল্টে দিতে চাইছে। কিš‘
এই ‘সামজিক গায়ের জোর’ কোনোভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভেতর টিকে
থাকার কোনো ‘যোগ্যতা’ নয়। এই যোগ্যতা সকল প্রাণপ্রজাতিতে ধীরলয়ে বিকশিত
হয় প্রাকৃতিকভাবে এবং প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে এর বৈশিষ্ট্য বাহিত হয়। আবার
প্রকৃতির কোনো ব্যাকরণে ছন্দপতনের সাথে টিকে থাকবার লড়াই শুরু হয়। আবার
পরিবর্তন, রূপান্তর ও বিকাশ ঘটে। এভাবেই এককোষী থেকে বহুকোষী আর
প্রাণপ্রজাতির বহুমুখী বিস্তার বৈচিত্র্য আমরা দেখে চলেছি কাল থেকে কালে। হয়তো এর
ভেতর বহুল অংশটাই মানুষ হিসেবে আমাদের অজানা রয়ে গেছে, হয়তোবা মানুষের সাথে
সাক্ষাত ঘটেনি বহু প্রাণপ্রজাতির। চলতি আলাপখানি ডারউইনের কোনো তত্ত্ব নিয়ে
নয়, দেশের বন্যপ্রাণীর নিদারুণ দশা ও সুরক্ষা বিষয়ে চলমান লেখালেখির একটা অংশমাত্র। ৩
মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসে বন্যপ্রাণী সুরক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়াও এর
উদ্দেশ্য। আ”ছা তাহলে আলাপের শুরুতেই কেন ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে
টেনে আনা হলো? টেনে আনার কারণ হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের বৈজ্ঞানিক
নির্যাস থেকে আমরা যতবেশি শরীর ও মনে দূরে সরে যাব, তত বেশি বন্যপ্রাণী থেকে
বি”িছন্ন হয়ে পড়বো। এখন যেমন একক প্রজাতি হিসেবে মানুষ তার বাহাদুরি
প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। ভোগবিলাস আর বেহিসাবী জীবনের জন্য লুন্ঠন আর বৈষম্য চাঙ্গা
রেখেছে। নিষ্ঠুরভাবে প্রতিদিন খুন করছে বন্যপ্রাণী, দূষিত করছে বা¯‘তন্ত্র। অথচ এই
গ্রহে মানুষই একমাত্র প্রজাতি, বেঁচে থাকার জন্য যাকে সকল প্রাণপ্রজাতির ওপর
নির্ভর করতে হয়। শ্বাস নেয়া থেকে অন্ন, বস্ত্র, বাস¯’ান, বিনোদন, চিকিৎসা
সবকিছুই চলে বন্যপ্রাণী আর উদ্ভিদের দয়ায়। কিš‘ মানুষ প্রকৃতির এই অবদান
একটিবারও মনে রাখে না। প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতা করে বন্যপ্রাণীর সাথে।
বন্যপ্রাণীর আবাস, খাদ্য, পরিবার দখল ও ছিনতাই করে। কিš‘ এভাবে খুব বেশি সময়
প্রকৃতি অন্যায় আর রক্তপাত সহ্য করে না। চলমান করোনা মহামারীতে এটি আবারো
প্রবলভাবে আমরা টের পেয়েছি। করোনা ভাইরাস মূলত একটি জুনোটিক বা
প্রাণিবাহিত জীবাণু। বন্যপ্রাণীর আবাস চুরমার করার কারণেই এই মহামারী আমাদের
দেখতে হলো। এর আগেও এমন ঘটেছে বহুবার। বা¯‘তন্ত্রের এই ব্যাকরণ থেকে একমাত্র
মানুষই কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। তাই ভোগান্তি আর যন্ত্রণা প্রজাতি হিসেবে
মানুষের সমাজেই বাড়ছে বেশি। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রজাতি হিসেবে
লড়াই একটা মৌমাছিও করে, মানুষও করে। কিš‘ মৌমাছিরা নিজের খাবার ফলানোর নামে
মানুষদের বিষ দিয়ে হত্যা করে না, কিংবা হাতিরা মানুষদের গ্রাম দখল করে উ”েছদ করে না।
মানুষ ছাড়া মৌমাছি কী হাতি বাঁচতে পারবে। কিš‘ কোনো নির্ভরতা ছাড়া
মানুষতো বাঁচবে না। মৌমাছি না থাকলে পরাগায়ণ ও উদ্ভিদে বংশবিস্তার রুদ্ধ হবে,


হাতি না থাকলে খাদ্যশেকল ভেঙে পড়বে। কিš‘ মানুষ ছাড়া পৃথিবী হয়তো টিকবে
বহুকাল। তো মানুষ এমন প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ করছে কেন? কেন নির্বিচারে বিনাশ
করছে প্রাণজগত? কারণ মানুষ নিজেকে ‘ক্ষমতাধর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
অন্যকে ‘দুর্বল’ আর নিজেকে ‘সবল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অন্যায় রাজনীতি
জিইয়ে রাখে। নিষ্ঠুরভাবে প্রশ্নহীন আঘাত চাঙ্গা রেখে ‘যোগ্যতমের টিকে থাকার’
বানোয়াট মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রকৃতিতে কেউ এভাবে টিকে থাকার
যোগ্যতা অর্জন করে না।
২.
ডারউইন তাহলে যোগ্যতমের টিকে থাকাকে কীভাবে ব্যাখা করেছেন? প্রকৃতিবিদ
চার্লস ডারউইন মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাখা করতে গিয়ে এই তত্ত্ব হাজির
করেছিলেন। ডারউইনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ পুস্তকে এটি
বিবৃত হয়। ১৮৫৯ সনের ২৪ নভেম্বর বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকৃতিতে নিরন্তর নানামুখী
সংকট তৈরি হয়। এই সংকটে টিকে থাকার জন্য প্রাণ-প্রজাতিতে বিশেষকোনো
যোগ্যতা তৈরি হতে থাকে। এই যোগ্যতা প্রজাতিটিকে রূপান্তরিত করে। এটি
একসময় নতুন পরিবেশ ও বা¯‘তন্ত্রে প্রজাতির টিকে থাকার বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপ পায়।
আর এভাবেই প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য কোনো প্রাণপ্রজাতি যোগ্যতম হয়ে
ওঠে। এখানে খাদ্য, বাস¯’ান, জলবায়ু ও বা¯‘তন্ত্রের সাথে খাপখাওয়ানো ও
প্রতিযোগিতার মতো নানামুখী বিষয় জড়িত থাকে। তবে এই প্রতিযোগিতা ওপর
থেকে চাপিয়ে দেয়া বা মানবসৃষ্ট বিশেষ কোনো কৃৎকৌশল নয়। প্রকৃতির চলমান
বিকাশ ও রূপান্তরের অংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নিয়মিত জনশুমারী করে। জনশুমারি
অনুযায়ী দেখা যায় দেশে মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিš‘ মানুষ বাদে অন্যান্য
বন্যপ্রাণীর সঠিক কোনো শুমারী আমাদের হাতে নেই। বিশেষ করে ভোঁদড়, বনবিড়াল,
গয়াল, কাঠবিড়ালি, সজারু, গন্ধগোকূল, মৌমাছি, বনরুই কী অজগরের কোনো
শুমারি আদৌ হয়েছে কীনা আমাদের জানা নেই। বি”িছন্নভাবে আমরা পাখিশুমারি,
বাঘশুমারি, ডলফিন শুমারি, শকুন গণনা, হাতি গণনা বা ক”ছপ গণনার কথা শুনি। এইসব
শুমারি নির্দেশ করে দেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে। দেখা যায়, আবাস¯’ল ক্রমাগত দখল,
খাদ্যসংকট, বাণিজ্যিক চোরাচালান এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি চরম অবহেলা কারণে আজ
দেশব্যাপি বন্যপ্রাণী বিপদাপন্ন। মানুষ আজ হাতির বিচরণ¯’ল দখল করেছে, পাহাড়ে
হাতির খাবার নেই। মানুষ নির্দয়ভাবে একের পর এক হাতি মারছে। গরুছাগলের জন্য
ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করে আমরা শকুনের সংখ্যা নিশ্চিহ্ন করেছি। কৃষিতে
বহুজাতিক রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের মাধ্যমে জলজ প্রাণবৈচিত্র্যকে বিপন্ন করেছি।
দেশে বাঘের টিকে থাকার সর্বশেষ আশ্রয়¯’ল বাঘের আবাসভূমি সুন্দরবনকেও
উন্নয়নের নামে ক্ষতবিক্ষত করা হ”েছ। তাহলে বন্যপ্রাণী টিকে থাকবে কোন
যোগ্যতায়? এখানে টিকে থাকবার জন্য কোনো প্রাকৃতিক প্রতিযোগিতাতো
মানুষের সাথে হ”েছ না। মানুষের বাননো এই কৃত্রিম বাস্তবতায় বন্যপ্রাণীর টিকে
থাকবার জন্য নিজের ভেতর বিশেষ কোনো যোগ্যতম বৈশিষ্ট্য কি এভাবে তৈরি হতে পারে?
পারে না। তাই চোখের সামনে অকাতরে মরছে বন্যপ্রাণী। ফসলের জমিতে বিষ দিয়ে একের
পর এক আমরা পাখিদের হত্যা করি। সিলেটের হরিপুরের মতো হোটেলে পাখির লাশ খেয়ে
ফেসবুকে উন্মাতাল পোস্ট দেই। হরিণের চামড়া বিছিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করি বা
করপোরেট বিজ্ঞাপনে টিয়াপাখি বন্দি করে রাখি। এই যে মানুষ হিসেবে বন্যপ্রাণীর ওপর
আমরা নির্বিচার বাহাদুরি করছি, এটিও কিš‘ প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে
থাকবার জন্য কোনো বিশেষ অর্জিত প্রাকৃতিক যোগ্যতা নয়।
৩.


১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২১ টি দেশের
স্বাক্ষরদানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদপ্রজাতির
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সম্মেলন ১৯৭৩ (সাইটেস) সনদ’। এই সনদের
প্রধান উদ্দেশ্য আন্তজার্তিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদক’লের অতিমাত্রায়
ব্যবহার রোধ করা। বাংলাদেশ ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর এই সনদ অনুমোদন করে এবং ১৯৮২
সনের ১৮ ফেব্র“য়ারি থেকে এই সনদটি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়। ৩ মার্চ
‘সাইটেস সনদ’ স্বাক্ষরতি হয়েছিল, জাতিসংঘের ৫৮ তম সাধারণ সভায় ২০১৩ সনের
২০ ডিসেম্বর উক্ত দিনটিকে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সনের
বন্যপ্রাণী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘বা¯‘তন্ত্র পুনরুদ্ধারে কীস্টোন প্রজাতির
ভূমিকা’। জাতিসংঘ একইসাথে বিশ্লেষণ করেছে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা জাতিসংঘের
টেকসই লক্ষ্যমাত্রাসমূহও (এসডিজি) পূরণ হয়। বিশেষ করে ১, ২, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫ নং
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বন্যপ্রাণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিš‘ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ
বন্যপ্রাণী সুরক্ষা ও বন্যপ্রাণীর জীবন নিরাপদ করার ভেতর দিয়ে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে
এখনো কোনো দৃশ্যমান পাবলিক তৎপরতা শুরু করেনি। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা ও
নিরাপত্তা) আইন ২০১২’ বিদ্যমান থাকলেও দেশে সাফারিপার্ক, প্রাকৃতিক বন,
গ্রামীণ বন কী জলাভূমি কোথাও বন্যপ্রাণী নিরাপদ নয়। এবারের বন্যপ্রাণী দিবসের
কীস্টোন প্রজাতি বলতে আমরা কী বুঝি? ১৯৬৯ সনে প্রাণিবিজ্ঞানী রবার্ট টি
পেইন প্রথম কীস্টোন প্রজাতির ধারণা দেন। কীস্টোন প্রজাতি এমন এক প্রজাতি যা
কোনো বা¯‘তন্ত্রের সামগ্রিক গঠন ও প্রাকৃতিক শৃংখলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং যার প্রভাব পুরো প্রতিবেশের সামগ্রিক
জৈবসত্তার ওপর নির্ভর করে। প্রতিটি কীস্টোন প্রজাতি যার প্রাচুর্য যেমনই হোক না
কেন কিš‘ তার প্রভাব সেখানকার সকল প্রাণসত্তার সাথে সম্পর্কিত থাকে এবং এটি
সকলের জীবনকেই নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে একটি বা¯‘তন্ত্রের অপরাপর প্রাণ-
প্রজাতির সংখ্যা ও প্রকার নির্ধারণ ও ব্যব¯’াপনায় ভূমিকা রাখে। কীস্টোন প্রজাতি
ছাড়া কোনো একটি বা¯‘তন্ত্র মুহুর্তেই বদলে যেতে পারে কিংবা সকলের জন্যই বিপদ
তৈরি করতে পারে কিংবা প্রাকৃতিকভাবে বিকাশের ব্যাকরণ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। যেমন,
সুন্দরবনে বাঘ একটি কীস্টোন প্রজাতি। এই বাঘ বনের খাদ্যশৃংখলের সর্বো”চ স্তরের
খাদক এবং অন্যান্য স্তরের প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে
বা¯‘তন্ত্রে প্রাণ-প্রজাতির সংখ্যা ও প্রকারকে সমন্বয় করে। তো এই বাঘ ছাড়া
সুন্দরবনের মতো বা¯‘তন্ত্র বিকশিত হবে না, হতে পারে উপকূলে আরো ম্যানগ্রোভ
বা¯‘সং¯’ান গড়ে ওঠবে। কিš‘ সেটি সুন্দরবন হবে না। যদি সুন্দরবনে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়,
তবে প্রাকৃতিকভাবে এই বনটির বিকাশ রুদ্ধ হবে এবং এই বা¯‘তন্ত্র ভিন্নভাবে
পরিবর্তিত হবে। যেমন, বৃহৎ কোনো বট বা অশ্বত্থ গাছ হলো একটি বা¯‘তন্ত্রের
কীস্টোন প্রজাতি। কারণ পাখি, পতঙ্গ, লতাগুল্ম, লাইকেন, ছত্রাক, অর্কিড, মৌমাছি,
পরাশ্রয়ী, কাঠবিড়ালি, সাপ, পেঁচা এরকমের বহুপ্রাণি খাদ্য-আশ্রয় সবকিছুর জন্যই
বটগাছের ওপর নির্ভরশীল। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে প্রাচীন বনভূমি, চাবাগান ও খাসপুঞ্জি
এলাকায় বটসহ প্রাচীন গাছ গুলো কেটে ফেলার কারণে দেখা গেছে বহু বন্যপ্রাণীর
আবাস¯’ল বিলুপ্ত হয়েছে। বটবৃক্ষহীনতায় সেসব বা¯‘তন্ত্র বর্তমানে ভিন্ন চেহারা
নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪.
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক জোট আইইউসিএন প্রকাশিত ‘লালতালিকা
বই’ অনুযায়ী দুনিয়ায় প্রায় ৮,৪০০ বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী চরমভাবে বিপদাপন্ন এবং প্রায়
৩০,০০০ প্রজাতি ঝুঁকিতে আছে। তো এই কীস্টোন প্রজাতি কেবলমাত্র
প্রাকৃতিকভাবেই নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্ব বহন করে। তো এই
‘সাংস্কৃতিক কীস্টোন’ প্রজাতির ধারণা ১৯৯৪ সনে প্রথম গ্যারি নাবহান ও জন কার


ব্যাখা করেন। যেসকল প্রাণপ্রজাতি মানুষের জীবন ও জনসংষ্কৃতিকে প্রভাবিত করে
এবং জনসংস্কৃতির নানা রূপকল্প হয়ে ওঠে সেসব প্রজাতিই ‘সাংষ্কৃতিকভাবে
কীস্টোন প্রজাতি’। যেমন, বাঘও সাংষ্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি। সুন্দরবন অঞ্চলে
বনবিবির কৃত্য থেকে শুরু করে সমগ্র অঞ্চলে বাঘ এক পবিত্র প্রাণসত্তা। এমনকি
পাবলিক পরিসরে শক্তিময়তার প্রতীক হিসেবে বাঘের রূপকল্প ব্যবহৃত হয়। জাতীয় ক্রিকেট
দলের প্রতীক বাংলা বাঘ। উত্তরাঞ্চলের বেদিয়া আদিবাসীদের গোত্রপ্রতীক হিসেবে মান্য
সকল বন্যপ্রাণীই তাদের কাছে ‘সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি’। যেমন, কছুয়া
গোত্রের গোত্রপ্রতীক ক”ছপ। চিড়রা গোত্রের কাঠবিড়ালি, বর গোত্রের বটগাছ, সুইয়া
গোত্রের সুইচোরা পাখি, মহুকল গোত্রের রাতচরা পাখি, কানুজ গোত্রের শিংমাছ, তেরওয়া
গোত্রের কবুতর, পেচা গোত্রের পেঁচা। সকল আদিবাসী সমাজেই গোত্রপ্রতীক হিসেবে
চিহ্নিত বন্যপ্রাণসমূহ পবিত্র এবং এদের বিন্দুমাত্র ক্ষতিসাধন সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ।
দেশজুড়ে হাতি, ক”ছপ, বনরুই, পাখি, সাপ, ময়ূর, পেঁচা, শূকর, বাঘ এবং হরেকরকম
বৃক্ষপ্রজাতি সাংস্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতি হিসেবে নানা সমাজে বিবেচিত।
কিš‘ আমরা বন, বন্যপ্রাণী কিংবা বা¯‘তন্ত্র সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি কিংবা
দৃষ্টিভঙ্গিতে নি¤œবর্গের এইসব লোকায়ত সুরক্ষাবিজ্ঞানকে কখনোই মূল্যায়ণ করিনি,
গুরুত্ব দেইনি। বরং উন্নয়নের নামে জোর করে ক্ষতিগ্র¯’ করেছি। আজ পৃথিবী
জনমানুষের লোকায়ত জ্ঞান ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সাংস্কৃতিক-সামাজিক চর্চার গুরুত্ব
নতুনভাবে অনুধাবন করছে। আশা করি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও বন্যপ্রাণ সম্পর্কিত
দেশের জনগণের লোকায়ত বিশ্বাস ও চর্চাকে সুরক্ষা কর্মসূচির ভিত্তি হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করবে।
৫.
২৬ এপ্রিল ২০১২ তারিখে বাংলাদেশের যশোরের বেনাপোল সীমান্তে ভারত থেকে ফলের
কার্টনে পাচার হয়ে আসা ১৫৫টি ক”ছপ আটক করে বনবিভাগ ও বর্ডার গার্ড-
বাংলাদেশ। ১৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে দিবাগত রাত তিনটায় বিমানবন্দর থেকে ৩০০টি
তারকা ক”ছপ, ৯০টি শিলা ক”ছপ এবং ২৫টি কড়ি কাইট্ট্যা আটক করা হয় । ২০১০ সনের
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ১১৪০টি ক”ছপের চালান আটক করে থাইল্যান্ডের
সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর। সিলেটের লালেং বা পাত্র জনগোষ্ঠীর কাছে অকুংলারাম ও
নাফাংলারাম ছিল বন্যপ্রাণীকেন্দ্রিক আদিকৃত্য। পাহাড়-জলাবনের প্রবীণ মাছ ও
কাছিম ছিল এসব কৃত্যের শক্তি। নিদারুণভাবে লালেং গ্রামে বিগত ত্রিশ বছর ধরে এসব
কৃত্য পালিত হয় না। কারণ কাছিম, মাছসহ বন্যপ্রাণের সকল আবাস¯’ল আজ দখল
হয়েছে হোটেল ও রিসোর্ট কারবারে। নতুন প্রজন্মের লালেং শিশুও হারিয়েছে
সাংষ্কৃতিক কীস্টোন প্রজাতির সাথে তার প্রথাগত সম্পর্কের ব্যাকরণ। এই ব্যাকরণ
পাঠে একজন আদিবাসী শিশু শৈশবেই তার আশেপাশের প্রতিবেশের প্রতিটি উদ্ভিদ ও
প্রাণীর গুরুত্ব ও অবদান সম্পর্কে জানতে পারে। পরবর্তীতে ধারাবাহিক চর্চার ভেতর
দিয়ে বন্যপ্রাণীর অবদানের প্রতি নিজেদের দায়িত্বশীল সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে
ওঠে। এই সংস্কৃতি বন্যপ্রাণীর প্রতি মানুষকে নতজানু হতে শেখায়, বন্যপ্রাণীর
প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার সম্পর্ক বিন্যস্ত করে। এভাবেই দেশের সমতল কী পাহাড়ে,
গ্রামজনপদে এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে বন্যপ্রাণীরা এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে
রাখছে। আর তাই বন্যপ্রাণীর সাথে মিলেমিশে একটা বৃহৎ সংসারের সদস্য হিসেবে
মানুষকে বেঁচে থাকার অভ্যাস অর্জন করতে হবে। জবরদস্তি, লুন্ঠন, দখল বা বাণিজ্য নয়;
প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিজ্ঞানসূত্রকে সমুন্নত রাখার ভেতর দিয়েই বন্যপ্রাণ কী
মানুষ সকলের ভেতরেই টিকে থাকার যোগ্যতা বিকশিত হোক নিরন্তর।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ই-মেইল : animistbangla@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!