বেঁচে থাকা ও বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো খাদ্য। তা পতঙ্গ, পাখি কী মানুষ হোক সবার খাদ্য দরকার। তো এই খাদ্য কে জোগায়? মূলত প্রকৃতি। মাটি, পানি, সূর্যকিরণ আর প্রাণ-প্রজাতি ঘিরে জটিলসব বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিবেচনায় খাদ্য জোগায় কৃষক আর আহরণজীবী মানুষ। মৌমাছি সমাজে কী হয়? একটা চাকের মৌমাছিদের কর্মবিভাজন থাকে। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের রেণু ও পরাগ সংগ্রহ করে। চাকের সবাই মিলে খায়। কিংবা একটা ভোঁদড়, বনরুই বা পাখির সমাজেও সবাই মিলেই খাবার সংগ্রহ ও ভাগ করে খায়। ছিনিয়ে নেয়া, ভাগ বসানো হয়তো ঘটে কখনো। কিন্তু খাদ্য বন্টনের ঐতিহাসিক বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রজাতি হিসেবে কেবল মানুষের সমাজেই বিদ্যমান। আর এই খাদ্য বিনিময় কী বন্টন নিয়ে বহু তর্ক, বহু প্রশ্ন, বহু নীতি বহুকাল ধরেই চলছে। খাদ্য তাই নিদারুণভাবে হয়ে ওঠেছে এক অব্যর্থ মারণাস্ত্র। খাদ্য আজ কেবল উৎপাদন, বন্টন, বিনিময়ের বিষয় নয়; খাদ্য আজ বহুজাতিক বাণিজ্যের একরফা মুনাফা ও নিয়ন্ত্রণের অংশ। তো এই খাদ্য কিংবা খাদ্যব্যবস্থা আজ কার নিয়ন্ত্রণে? কৃষক না বহুজাতিক কোম্পানির? মনস্যান্টো, সিনজেন্টা, বায়ার, বিএসএএফ, কারগিলের মতো বহুজাতিকেরা আজ নিয়ন্ত্রণ করছে কৃষি। শিশুখাদ্যের বড় অংশই নেসলের নিয়ন্ত্রণে। ম্যাকডোনাল্ড, পিৎজাহাট, কেএফসিরা নিয়ন্ত্রণ করছে প্রজন্মের খাদ্যসংস্কৃতি। পাশাপাশি কমছে কৃষিজমি, অরণ্য, জলাভূমি কী প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র। নিরুদ্দেশ হচ্ছে অগণিত প্রাণ-প্রজাতি ও নানা সমাজের লোকায়ত জ্ঞানভান্ড। থামছে না যুদ্ধ, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণ হ্রাসে এগিয়ে আসছে না ধনী দেশ। জলবায়ু সংকটের পাশাপাশি দুই বছর ধরে দুনিয়া বিপর্যস্ত করোনা মহামারিতে। এত ঝঞ্চা ও নির্দয় চাপের ভেতর তবুও বিস্ময়করভাবে খাদ্য এসেছে মানুষের থালায়। কিন্তু তারপরেও অনেকের থালা এখনো শুণ্য রয়েছে। আজ দুনিয়া ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করেছে, মঙ্গলগ্রহে বসবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে মানুষ। নিদারুণভাবে এই পৃথিবীতে এখনো অনেক শিশু না খেয়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। কারণ তাদের খাদ্য নেই। এমন কিন্তু নয়, খাদ্য ফলছে কম বা জোগান নেই। তাহলে দুনিয়ার সকলে খাদ্য পাবে এমন নিশ্চয়তা একটি নীতিগত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত প্রশ্ন। এটি কেবল একক পরিবার, গ্রাম-শহর বা একক রাষ্ট্রের বিষয় নয়। খাদ্য সুরক্ষা নীতি ও জিজ্ঞাসা বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত, অংশগ্রহণ্ ও মোকাবেলার বিষয়। বলা হয়, জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)’ বৈশ্বিকভাবে খাদ্যনীতি ও সুরক্ষা বিষয়ে কাজ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশ এফএওতে যুক্ত হয়। তবে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এফএও’র আঞ্চলিক সম্মেলন হচ্ছে। ৮-১১ মার্চ ২০২২ ঢাকায় আয়োজিত হয়েছে এফএও’র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৬ তম সম্মেলন। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উদ্বোধনী আয়োজনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কৃষিখাতে অর্থায়ন ও সহায়তায় বিশেষ তহবিল গঠন, প্রযুক্তি বিনিময় ও গবেষণা বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেছেন।
করোনা মহামারি, জলবায়ু সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা অমীমাংসিত কাঠামোগত বৈষম্য সবকিছু জিইয়ে থাকা একটা সময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সম্মেলন হয়তোবা এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য কোনো বিশেষ বার্তা দিবে। করোনা মহামারির কারণে বদলে যাওয়া এবং বদলাতে থাকা পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদনের রূপ ও রূপান্তর, জলবায়ু সংকট মোকাবেলা, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার নয়া মেরূকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, বাজার, লোকায়ত জ্ঞান ও প্রাকৃতিক কৃষি, পরিবেশপ্রশ্ন, নিরাপদখাদ্য কিংবা তরুণপ্রজন্মের অংশগ্রহণ এরকম বহুবিষয় আশা করছি এই সম্মেলন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আনবে।
এফএওর ৩৬ তম সম্মেলন
১৯৪৫ সনের ১৬ অক্টোবর কানাডার কুইবেকে গঠিত হয় এফএও। যদিও এর সদরদপ্তর ইতালিতে। জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত রাষ্ট্রসমূহ এখানে খাদ্য সম্পর্কিত নীতিমালা, কর্মকৌশল, পরিকল্পনা নিয়ে বহুমুখী সিদ্ধান্ত নেয়। ৩৬তম সম্মেলনের পূর্বে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী বিস্তারিতভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময় এই সম্মেলন আয়োজন বাংলাদেশের জন্য গর্বের ও সম্মানের। এই সম্মেলন আয়োজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ভারত, চিন, ভূটান, ইরান, তিমুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়া সরাসরি সমর্থন জানায় এবং অন্যান্য সদস্য দেশ সম্মতি দেয়। কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, এই সম্মেলনের মাধ্যমে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর অর্জন, সাফল্য, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিষয়ে মতবিনিময় ও পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। ৪৬টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের প্রধান আলোচনার বিষয় গুলোর ভেতর আছে, কোভিড-১৯ মহামারি বিবেচনায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য ও কৃষির অবস্থা বোঝা, উল্লিখিত অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা প্রসারের উদ্যোগ, কৃষি ভ্যালুচেইন ও ডিজিটালকরণ (ডিজিটালাইজেশন), উল্লিখিত অঞ্চলে ‘সর্বজনের স্বাস্থ্য (ওয়ান হেলথ)’ অগ্রাধিকার নিরূপণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশের প্রান্তজনের খাদ্যসংস্কৃতি ও সংগ্রামের জমিন থেকে কিছু পরিবেশ-জিজ্ঞাসা এফএওর ৩৬তম সম্মেলনের কাছে তুলে ধরছে চলতি আলাপ।
কোভিড-১৯ মহামারি ও খাদ্যপ্রশ্ন
সব মহামারি শরীর, মন, সমাজ ও সভ্যতায় দাগ রেখে যায়। এই দাগ কখনো করুণ, কখনো আশাময় দ্যুতি, কখনো নি:স্ব আবার কখনো পাল্টে যাওয়ার মোচড়। কোভিড-১৯ মহামারিকালেও আমরা দেখেছি এমন কত আশা-নিরাশার গল্প। কাজ হারানো নিরন্ন মানুষের লম্বা সারি, আবার নিজের খাবার ভাগ করে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সাহসী তরুণদল। করোনা মহামারির শুরুতে বিশ্বব্যাপি গরিব মানুষের ক্ষেত্রে এই খাদ্য না পাওয়ার বঞ্চনা প্রবল হয়েছে। নগরের স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা নি¤œমধ্যবিত্তর খাদ্য টানাটানি জটিল রূপ নিয়েছে। মহামারির কারণে অনেক ধরণের পেশা ও উৎপাদনের ধরণ ও চাহিদা বদলে গেছে। যারা এই দুম করে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে পারেননি পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মেটাতে তাদের নিদারুণ শংকায় কেটেছে সময়। মহামারি সবসময় মানুষের সমাজের জন্য খাদ্যসংকট তৈরি করে। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর কী প্লেগ সব মহামারিকালেই মানুষ খাদ্যের জন্য কষ্ট করেছেন। সেই সংকট টানা কয়েকবছর আবার কারো জীবনের দীর্ঘসময় বহাল ছিল। তবে কোভিড মহামারিকালে আমরা নতুনভাবে শহর এলাকার কুকুর, বিড়াল, পোষাপ্রাণী কিংবা চিড়িয়াখানার প্রাণীদেরও খাদ্যসংকটে লড়তে দেখেছি। খাদ্যপ্রশ্নে কোভিড মহামারি কিছু বিষয় আবারো প্রমাণ হাজির করেছে। মহামারির মতো সংকটে সকল ধরণের শিল্প-কারখানা ও উৎপাদন বন্ধ হলেও একমাত্র কৃষিউৎপাদনই চালু থাকে। দীর্ঘসময় লকডাউন থাকায় গ্রামীণ জনপদে বীজ, ফসল, উপকরণ কী কারিগরি জ্ঞান সবই বিনিময় করেছেন গ্রামীণ নারীরাই। পরিমাণ ও সংখ্যায় হয়তো কম কিন্তু এই উদাহরণ কর্পোরেট দখলমুক্ত হয়ে স্বনির্ভর কৃষির সম্ভাবনা তৈরি করে। কাজ হারানো গ্রামে ফেরা বহু মানুষকে কিছুটা হলেও কাজ দিতে পেরেছে এই ভঙ্গুর কৃষি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকায় বহুমানুষ বিশেষ করে তরুণদের একটা অংশ পারিবারিক কৃষিতে অংশ নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ উদ্যোক্তা হিসেবে নিরাপদ ও বিশেষ খাদ্য-ফসল বিক্রির মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে অনলাইন মাধ্যমকে ব্যবহার শুরু করেছে। বিষমুক্ত নিরাপদ খাবারের প্রতি দারুণভাবে ক্রেতা-ভোক্তা সমাজে এক পাবলিক সাড়া ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কৃষিজমি হ্রাস, শ্রমিক সংকট, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, ফসলের জাতীয় মূল্য কমিশন না থাকা, জলবায়ু দুর্যোগ, অস্থির বাজার, অনিরাপদ খাদ্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অপুষ্টি কিংবা কাঠামোগত বৈষম্য কিন্তু করোনা মহামারিকালে কমেনি। বহাল থেকেছে। তাই খাদ্যপ্রশ্নকে কেবলমাত্র কোভিড সংকটের ময়দান থেকে এককভাবে বোঝা যাবে না, এমনকি এককভাবে কোনো নীতি বা পরিকল্পনাও গ্রহণ করা যাবে না।
জলবায়ু সহনশীল কৃষি
কৃষক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অবদান আছে। বেগুনের আদি জন্মভূমি। ১৮৮৪ সনে জামালপুরের চৈতন্য নার্সারীতে প্রাতিষ্ঠানিক বেগুন গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ গভীর পানির ধানের আঁতুরঘর। ১৯৩৪ সনে হবিগঞ্জে গভীর পানির ধান গবেষণা শুরু হয়। বিশ হাজার জাতের ধান থেকে শুরু করে অজ¯্র প্রাণপ্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যর গর্বিত অঞ্চল এই ছোট্ট বদ্বীপ। খনার বচন থেকে শুরু করে কৃষিকারিগরি, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজনে গ্রামীণ জনপদে বহু লোকায়ত জ্ঞান-চর্চার নজির আছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি মূলত গড়ে ওঠেছে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র, দেশি জাতবৈচিত্র্য, লোকায়ত জ্ঞান আর প্রতিনিয়ত জলবায়ুপাঠের অভিজ্ঞতায়। হরিপদ কপালীর হরিধান, ফকুমার ত্রিপুরার ফকুমার ধান, নুয়াজ আলী ফকিরের চুরাক ধান কিংবা দিলীপ তরফদারের চারুলতা ধান এখনো এই স্বাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশের ভাসমান ধাপচাষ বা গাউতা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘প্রাকৃতিক কৃষি ঐতিহ্য’। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষির ব্যাকরণ আপন ছন্দ ও গতিতে বিকশিত হয়নি। বিশেষ করে সবুজ বিপ্লবের ধাক্কায় কৃষিবাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, বৈচিত্র্য ও স্বাস্থ্য এক প্রশ্নহীন বিপদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি কৃষিজীবনকে প্রতিনিয়ত বিপদ, আপদ, দুর্যোগ সামাল দিতে হয়। এমনকি বাংলাদেশের সকল অঞ্চল ও জনজীবনে চলমান জলবায়ু সংকটের প্রভাব ও মাত্রার ধরণ একরকম নয়। অনাবৃষ্টি, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, পাহাড়ি ঢল, শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র তাপদাহ, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য কিংবা কুয়াশার তারতম্য দেশের কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলসমূহে নানামুখী সংকট তৈরি করছে। কৃষি ও জুম আবাদসহ সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকি ও বিশৃংখলা। জলবায়ু সহনশীল কৃষির বিকাশে দেশের কৃষিজীবনের লোকায়ত জ্ঞান চর্চা, আদি দেশি জাত এবং গ্রামীণ অভিযোজন কৌশলগুলোর সুরক্ষা, মর্যাদা ও স্বীকৃতি জরুরি। জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি গড়ে তুলেতে অর্থায়ন ও বহুমুখী নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে যেখানে প্রান্তিক কৃষক ও খাদ্যউৎপাদনকারীর সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। জলবায়ুজনিত কারণে ঝুঁকি ও সংকটে থাকা কৃষিজীবনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামগ্রিক ‘ক্ষয়-ক্ষতির’ মূল্যায়ণ করা জরুরি। কার্বন নির্গন নীতিকে স্পষ্টকরণের ভেতর দিয়ে জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের খাদ্যউৎপাদন খাতকে সক্রিয়করণে বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল জোরদার করা জরুরি।
কৃষির ডিজিটালকরণ
কৃষি ভ্যালু চেইনে অর্ন্তভূক্তিমূলক ডিজিটালকরণ বা ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কৃষিখাতের বিকাশে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগানোর আলোচনা শুরু হয়েছে আজকের ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাস্তবতায়। কৃষকদের একত্র করে সমিতি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা প্রদান, ডিভাইস সহযোগিতা এবং কৃষকদের বিভিন্ন উপযোগী অ্যাপ ব্যবহারকরণের ভেতর দিয়ে কৃষিকাজে একটা ভিন্ন মূল্য সংযোজনের কাজ করছেন অনেকেই। এফএও ডিজিটাল ক্লাব এবং ডিজিটাল গ্রাম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্যই প্রযুক্তি ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের আওতায় সকলের সমান অভিগম্যতা জরুরি। কিন্তু এই ধরণের কর্মসূচি যদি কোনো প্রযুক্তিগত বৈষম্য তৈরি করে বা তথ্যের ভিন্ন ব্যবহার খাদ্য উৎপাদনকে বিঘিœত করে সেই বিষয়ে সজাগ থাকা জরুরি। পাশাপাশি লোকায়ত জ্ঞান, কৃষিকারিগরি, অভিযোজন কৌশল এবং প্রাণসম্পদের তথ্য ডিজিটালকরণের ক্ষেত্রে এসব জ্ঞান ও তথ্যের জনমালিকানা ও জনঅভিগম্যতাকে নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তি, ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই), মেধাস্বত্ত্ব বিতর্ক, উদ্ভিদজাত সংরক্ষণ আইন কিংবা আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদসহ (সিবিডি ১৯৯২) গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকারকে বিবেচনায় রেখে একটা অংশগ্রহণমূলক নীতি ও কাঠামো এক্ষেত্রে গড়ে তেলা জরুরি। এক্ষেত্রে তথ্যের গোপনীয়তা বা তথ্যের পাবলিককরণ সবকিছুই সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিন্যাসের মর্যাদা সুরক্ষা করে করতে হবে ডিজিটালকরণের নামে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকেন্দ্রিক কোনো থথ্য বা জ্ঞান বা প্রাণসম্পদ যেন কোনোভাবেই কোনো করপোরেট কোম্পানি কর্তৃক প্রাণডাকাতি, পেটেন্ট বা একতরফা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতে না পারে সেই বিষয়টিতে সকলের ঐক্য জরুরি। । কারণ সবুজ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের করুণ, যেখানে আমরা বহু জাত ও প্রাণসম্পদের তথ্যের জনমালিকানা হারিয়েছি।প্রতিদিন যেখানে কৃষি থেকে তরুণ প্রজন্ম দূরে সরে যাচ্ছে, সেখানে এই ডিজিটালকরণের প্রক্রিয়ায় তরুণ প্রন্মকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যুক্ত করে এক সক্রিয় খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
সর্বজনের স্বাস্থ্য
দুনিয়ার সবকিছুই সবকিছুর সাথে যুক্ত। কেবলমাত্র মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে জমিনে বিষ ঢালতে গিয়ে পতঙ্গ, কেঁচো, মৌমাছি মরে যায়। মরে যায় ব্যাঙ, সাপ ও পাখির খাদ্য। মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটলেও বাড়ে বন্যপ্রাণীর খাদ্যসংকট। একইভাবে কেবল মানুষ এককভাবে এই দুনিয়ায় সুস্থ থাকতে পারে না। যদি মাটি বা নদী অসুস্থ থাকে, যদি অরণ্য না থাকে বা যদি মানুষ বন্যপ্রাণীর আবাস দখল করে তবে সকলের ভেতরই ছড়িয়ে পড়ে নিত্য নতুন অসুখ। মানুষের সীমাহীন ভোগবিলাস আর লাগাতার চাহিদা ঘুমিয়ে থাকা জীবাণুদের প্রতিদিন জাগিয়ে তুলছে। কোভিড মহামারি তার চলমান প্রমাণ। বুনো প্রকৃতি থেকে এই ভাইরাস মানুষ নিজেই টেনে এনেছে নিজের সমাজে, আর আজ মহামারিতে ভুগছে পুরো দুনিয়া। প্রায় প্রতিটি মহামারি জুনোটিক বা প্রাণিবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে হয়েছে। আমাদের সতর্কতার দরকার আছে। কেবল চাহিদামাফিক মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন নয়, এই পৃথিবীর সকল জীবিত প্রাণসত্তার খাদ্য নিশ্চিত থাকে এমন খাদ্যব্যবস্থাই আজ মানুষকে বেছে নিতে হবে। দূষিত, অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর, ভেজাল ও বিপদজনক খাদ্য স্বাস্থ্যহানি ঘটায় এবং সমাজের রূপান্তরকে বাধাগ্রস্থ করে। আশা করি এফএও’র ৩৬ তম সম্মেলন সর্বজনের স্বাস্থ্যর কথা বিবেচনায় রেখে এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষসহ সকল প্রাণসত্তার জন্য নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে এক পরিবেশবান্ধব সমন্বিত নীতি গ্রহণ করবে।
………………………………………………………………………..
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com