সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার সনাতন ধর্মের হাজারও নারী-পুরুষ হাওর-ভাটির লৌকিক দেবী সোমেশ্বরীর পূজা-অর্চনা সম্পন্ন করেছেন। জেলার দুর্গম শাল্লা উপজেলার বাহারা এলাকায় চৈত্র মাসের প্রথম সোমবার উপজেরার বাহারা গ্রামের দাড়াইন নদী তীরে সোমেশ্বরী মন্দিরে পুজা অর্চনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রায় ৫শত বছর ধরে। হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা লোকায়ত দেবীর উদ্দেশ্যে নানা আচারাদি পালন করেন। এ উপলক্ষে দুদিনব্যাপী মেলা বসে। প্রথম দিনের মেলাটি ‘বেল-কুইশ্যার (ইক্ষু) মেলা হিসেবে পরিচিত। ঐতিহ্য হিসেবে মেলার আগের দিন চৈত্রের প্রথম রবিবার বেল, আখ ও লাঠির মেলা বসে নদীতীরে। পরদিন একই স্থানে বসে সোমেশ্বরীর মেলা। সোমেশ্বরী মন্দিরে আসা লোকজন মেলা থেকে ঐতিহ্য ও পূণ্যবস্তু হিসেবে আখ, বেল ও লাঠি নিয়ে বাড়ি ফিরেন। সোমেশ্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে মহিষ বলির পর মহিষের রক্ত মিশ্রিত মাটি রোগ বালাই দমনের জন্য গায়ে মাখতে ‘চরণামৃত’ নিয়ে যান। তাছাড়া দেবীর উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা দুধঘি ¯œাত মাটি হাওরের ফসলের বাম্পার উৎপাদনের প্রত্যাশা ও ফসল রক্ষার জন্য জমিতে ছিটিয়ে দিয়েছেন।
সোমেশ্বরী দেবী ভক্ত ও সোমেশ্বরী সংগঠনের সদস্য বাহাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (৭৫) জানান, ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন তার দাদু-দিদা, মা-বাবাসহ স্বজনরা সোমেশ্বরী দেবীকে এসে পুজা দিতেন। তিনিও তাদের পথ ধরে প্রতি বছর পূজা দেন। এ উপলক্ষে দেবীর মন্দির ঘিরে মেলাও বসে। তিনি জানান, এই মেলা ও পুজার বয়স আনুমানিক ৫শত বছর হবে। প্রকৃতির কাছে অসহায় হাওরাঞ্চলের নারী পুরুষ জীবন, সম্পদ ও ফসলের নিরাপত্তা চেয়ে প্রাথনা করেন দেবীর মন্দিরে এসে। হাওরের কান্দায় দুর্গম স্থানে দেবী ভক্তরাই কোন এক সময়ে তৈরি করেছেন দেবীর মন্দির। সেখানে স্থাপিত হয়েছেন দেবী। মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য দেবির পদতলে নানা রকম ভোগ ও লুট দিয়ে নৈবেদ্য জানানা আগতরা। মহিষ, খাসি ও কবুতরসহ বিভিন্ন উপকরণে মানত (মনোবাসনা) পূরণে বলি দিয়ে দেবীর কাছে মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা জানান। এলাকার নারীরা বাড়ির উঠোনে বসে ভাড়ারের নতুন ধান বের করে তা থেকে চাল তৈরি করে নতুন-পিঠাচিড়ায় দেবীকে ভোগ দিয়ে হাওরের ফসল নিরাপদে গোলায় তোলার প্রার্থনা করেন। বাড়ি ফেরার সময় হাজারো নারী পুরুষ মন্দিরের ‘চরণামৃত’ (দুধজলঘি¯œাত মাটি ও মহিষের রক্ত¯œাত মাটি) বোতলে ভরে নিয়ে যান জীবনের মঙ্গল কামনার বিশ্বাসে। তারা রোগ বালাই দূর করতে শরিরে সেই চরণামৃত মাখেন। ওই শিক্ষক আরো জানান, তবে অনুষ্ঠানের আগের দিন ঐতিহ্য হিসেবে দাড়াইন নদী তীরের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ইক্ষু, বেল ও লাঠির দোকান নিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়রা আগের দিনের উৎসবকে বেল-কুইশ্যারের মেলা এবং পরের দিনের উৎসবকে ‘সোমেশ্বরী’ মেলা নামে ডাকেন বলে জানান তিনি। তার মতে শাল্লা উপজেলার দুর্গম একটি গ্রাম বাহারার দাড়াইন নদী তীরে অনুষ্ঠিত এই উৎসবটি এখন হাওর-ভাটির অসাম্প্রদায়িক উৎসবে রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস লৌকিক দেবী সোমেশ্বরীসহ তার কয়েকজন বোন হাওর ভাটির হিন্দু ধর্মের সকল শ্রেণীর মানুষের উপর আশির্বাদের ছায়া বিছিয়ে রেখেছেন। দুর্যোগে, দুর্বিপাকে তারা এই দেবীদের কাছে প্রার্থনা করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় হাওরবাসীর মনে এই দেবীর স্থায়ী আসন। তাই তারা এই দিনে দলে দলে এসে দেবীকে অর্ঘ্য দেন।
সোমেশ্বরী সংঘের সদস্য ফির্তিলাল দাস জানান, এক সময় শুধু বাহারা গ্রামের লোকজন উৎসবের প্রধান দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীতে পার্শবর্তী যাত্রাপুর, পোড়ারপাড়, শিবপুর বাগের কোণাসহ কয়েকটি গ্রাম মিলেমিশে উৎসবের আয়োজন করছে। নির্বিগ্নে উৎসব পালনের জন্য মন্দিরের পাশাপাশি আরেকটি গোলছাউনির খোলা ঘর বানানো হয়েছে। যাতে এসে আশ্রয় নেন দূর দূরান্তের নারীরা। এবারও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পূণ্যার্থীরা এখানে এসে পুজা দিয়েছেন এবং বিশ্রাম করেছেন। তিনি জানান, চৈত্র মাসের প্রথম সোমবার সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকার হাজারো নারী পুরুষ, দুধ, ঘি, হলুদ বাটা, পিঠা, চিড়া, মিষ্টান্ন, বাতাসাসহ লুট ও ভোগের উপকরণ নিয়ে মন্দিরে জড়ো হন। মোম বাতি জ্বালিয়ে দেবীকে ভক্তি দেন। এর আগ থেকেই চলে দেবীকে নৈবেদ্য জানানোর আয়োজন। উৎসবের দিন দেবী ভক্তবৃন্দ বাড়ি থেকে দেবিকে নৈবেদ্য দিতে নিয়ে আসা দুধ ঘি জল মন্দিরের ভিতরে স্থাপিত পাথরে ছিটিয়ে দেবিকে প্রণাম করেন। অনেকে দুধ ও ঘির বোতল মন্দিরে লাগানো তুলসি গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে দেন। দুধ, ঘি ও জলভেজা স্যাসসেতে মাটি সংগ্রহ করে অনেকে রোগ বালাই দূরের বিশ্বাসে গায়ে মাখেন, বসতঘর ও গরুর গোয়ালঘরে ছিটিয়ে দেন। অনেকে এই ভেজা মাটি হাওরের জমিতে ছিটিয়ে দেন উন্নত ফলন ও ফসল রক্ষার আশায়। দুধ, ঘি ও জল¯œাত মাটিকে তারা ‘চরণামৃত’ বলেন। তিনি আরো জানান, মহিষ বলির আগ পর্যন্ত আয়োজক গ্রামের কোন বাড়ির চুলোতে কোন আগুন জ্বলে না। বলির পরই পূজা অর্চনা সেরে এসে রান্না বান্নায় বসেন নারীরা। দূর দূরান্তের নারী পুরুষ বাড়ি থেকে উপবাস করে এখানে এসে ভোগ ও লুট দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। এলাকার নারীরা নিজ নিজ বাড়িতে পুতপবিত্র হয়ে ঘরের নতুন ধান ভাড়ার থেকে বের করে উঠানের কিছু অংশ লেপামোছা করে তা ভেনে পিঠাচিড়া করে বাড়িতে ভোগ দেন। পরে নতুন ধান ভাঙ্গিয়ে উঠোনে সোমেশ্বরীর উদ্দেশ্যে ঘট বসিয়ে ভক্তি দিয়ে কলাপাতা, আমপাতা, ধোপ, তুলসিপাতায় ভোগ দেন। কয়েকশ বছর ধরেই পরম্পরায় এই আচারাদি পালন করছেন নারীরা। তাছাড়া দেবীর মন্দিরের পাশে বিশেষ কীর্তন ও প্রার্থনা সঙ্গীতও পরিবেশিত হয়। তিনি জানান, মেলায় প্রতি বছর অপরাহ্নের শুরুতে মহিষ বলি দেওয়া হয়। বলির পর সোমেশ্বরী ভক্তবৃন্দ তা সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি করে রক্তভেজা মাটিসংগ্রহ করেন। তাদের বিশ্বাস এ মাটি গায়ে মাখলে সব ধরনের রোগের উপশম হয়। একারণে এই মাটি সংগ্রহের জন্য নারী পুরুষ হুড়োহুড়িতে জড়িয়ে পড়েন। সোমেশ্বরী সংঘের স্বেচ্ছাসেবকরা মহিষ বলি দেওয়ার পর দ্রুত মহিষটি পাশের পুকুরে ফেলে দেন। যাতে কেউ কাড়াকাড়ি করতে না পারেন।
শাল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি পিসি দাস পীযুষ জানান, সোমেশ্বরী দেবীর মেলা হাওর-ভাটির দুর্গম এলাকার সবচেয়ে প্রাচীণ ও বড়ো উৎসব। চৈত্রের প্রথম রোববার বেল কুইশ্যারের মেলা এবং পরদিন সোমেশ্বরী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন। মেলায় আগত লোকজন নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সৌখিন অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে দেবির আশির্বাদ হিসেবে ‘বেল-ইক্কু ও লাটি’ নিয়ে বাড়ি ফিরেন। হাওরাঞ্চলের অন্যান্য জেলা কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ থেকে দোকানী পূজারিরা আসেন মেলায়। এসব এলাকা থেকে সোমেশ্বরী ভক্তবৃন্দও এসেছেন। শিশু খেলনাসহ গেরস্থালির নানা ধরনের পণ্যের দোকান থাকে মেলায়। দুর্গম এলাকার মানুষ এ উপলক্ষে জমানো খরচ দিয়ে সাংসারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য নানা ধরনের পন্য কিনেন। প্রতি বছর এই মেলার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন তারা।
সোমেশ্বরী মেলায় আসা দিরাই উপজেলার লৌলারচর গ্রামের নৃপেশ চক্রবর্তী (৬২) বলেন, ‘আমরা গাভির প্রথম দুধ দোহন করে সোমেশ্বরী মাকে এনে প্রণাম দেই। এতে গাভি বেশি দুধ দেয় এবং স্বাস্থ্যবান থাকে। এই গাভি তখন আমাদের কৃষি ক্ষেতেও বেশি কাজ করতে পারে। দুধ ঘি ও জল¯œাত মাটিও আমরা হাওরের জমির ভালো ফলন ও ফসল রক্ষার আশায় দেবির নামে ছিটিয়ে দেই। শত বছর ধরে আমরা এসব করে উপকার পাচ্ছি। তাই দেবীকে সাধন ভজন করতে প্রতি বছরই ছুটে আসি।
বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, প্রায় ৫ শত বছর ধরে অনুষ্ঠিত সোমেশ্বরী মেলা এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। হিন্দু ধর্মের লৌকিক দেবী সোমেশ্বরীকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হলেও এখন সব ধর্মের লোকজন এতে অংশ নিচ্ছেন। প্রতি বছর চৈত্রের প্রথম সোমবার সোমেশ্বরী মেলা বসে। তবে এর আগের দিন বেল, ইক্ষু ও লাঠির মেলা বসে। এই মেলাও ঐতিহ্যের অংশ। তিনি জানান, মেলায় হাজার হাজার নারী পুরুষ মাইনসা (মনোবাসনা পূরণের প্রতীকি বস্তু) নিয়ে এসে জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রার্থনা করেন। হিন্দু ধর্মের সকল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস দেবি তাদের উপর আশির্বাদের ছায়া বিছিয়ে জীবন ও সম্পদের পাহারা দিচ্ছেন। সোমেশ্বরী পূজা এখন মানুষের মিলন মেলায় রূপ নিয়েছে। এই উৎসবের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি আমরা। আমাদের বোন ভাগ্নিসহ দূরের আতœীয়-স্বজনরা এ উপলক্ষে আসেন। লোকায়ত নানা বিশ্বাস নিয়ে এই উৎসব শত বছর ধরে পালিত হচ্ছে। মেলায় স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মিষ্টান্ন, খাবার, প্রসাধনী, ক্রোকারিজ, কাপড়, নিত্যপণ্যসহ নানা ধরনের পণ্যের হাজারও দোকান থেকে মানুষ চাহিদা মতো কেনাকাটা করেন।