হাওর ডেস্ক ::
ভারতের মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের নদ-নদীতে আবারও পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় হাওরের বোরো ধান কাটার পাশাপাশি বাঁধ রক্ষায় নিয়োজিত কৃষকরা নতুন করে ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। এরই মধ্যে তাহিরপুরে বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। পানিতে সৃষ্ট ঢেউ বাঁধের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ধান কাটার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গাজীপুর ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ায় তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত।
সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি ৬২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময় সীমান্ত নদী যাদুকাটার পানি বেড়েছে ২৬ সেন্টিমিটার। পুরাতন সুরমায় পানি বেড়েছে ২০ সেন্টিমিটার। এই নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ টেকানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ১৫ দিন ধরে পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো যেকোনো সময় ভেঙে ফসলহানির আশঙ্কা করছে প্রশাসন। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে ধান কাটার আহ্বান জানানো হচ্ছে কৃষকদের।
গতকাল দুপুর ২টায় সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তাদের বুলেটিনে জানিয়েছে, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার নদ-নদীতে দ্রুত পানি বাড়ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাণিতিক মডেল পর্যালোচনা করে জানানো হয়, ভারতের মেঘালয় ও আসাম প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় জেলায় বন্যার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, গত ৪৮ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বর্ষণের পানি নেমে আসছে নদ-নদী দিয়ে।
২ এপ্রিল টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে যায়। এর পর থেকেই টাঙ্গুয়ার হাওর-সংলগ্ন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বর্ধিত গুরমা ফসল রক্ষা বাঁধের ১৭টি প্রকল্পে পানির চাপ বাড়ে। ৪ এপ্রিল ধসে যায় ২৩, ২৫, ৩৭ ও ৩৯ নম্বর ফসল রক্ষা বাঁধের কয়েকটি অংশ। ওই দিন থেকেই ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষায় রাত-দিন কাজ করছেন হাওরপারের দুই শতাধিক কৃষক। কাজ তদারকিতে আছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। নববর্ষের দিনও দিন-রাত কাজ করেছেন তাঁরা।
কৃষকরা জানান, বর্ধিত গুরমা ফসল রক্ষা বাঁধের একটি অংশ ঝুঁকিমুক্ত করলেও অন্য অংশে আবারও ধস নামছে। গতকাল সকালে বাঁধের ২৫ ও ৩৭ নং প্রকল্পের দুটি অংশের প্রায় ২০ ফুট স্থান ধসে যায়। গুরমা ফসল রক্ষা বাঁধের অন্তর্ভুক্ত জমির ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে ধান কাটা শেষ হতে আরো ১২ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয় দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আলী আহমদ মুরাদ বলেন, ‘রাতে ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে পানিও বেড়েছে। বাঁধের দুটি স্থানে আবারও ধস নেমেছে। আমরা সবাই মিলে কাজ করছি বাঁধ মেরামতে। ’
স্থানীয় রামসিংহপুর গ্রামের কৃষক তারা মিয়া বলেন, ‘আমি ১১ দিন ধরে ২৫ নম্বর প্রকল্পের বাঘমারাকান্দায় আছি। খাওয়া, গোসলের ঠিক নেই। ফসল ডুবলে তো সারা বছরের খাওয়া শেষ। ’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘২৫ নং প্রকল্পের (বাঘমারা) বাঁধটি পাউবো নদীর পার দিয়ে করেছে। আমাদের কথা আমলে নেয়নি। এ জন্যই এই স্থায়ী বাঁধটি এ বছর এত ঝুিঁকপূর্ণ হয়েছে। ’
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান উদ দৌলা বলেন, গতকাল পর্যন্ত তাহিরপুর উপজেলায় ৮৫০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে।
রাত ১১টায় বর্ধিত গুরমা হাওর থেকে তাহিরপুরের ইউএনও মো. রায়হান কবির বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে বাতাসে প্রচণ্ড ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিটি বাঁধের ওপর দিয়ে ঢেউ প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বাঁধ টিকে আছে।
এদিকে তুরাগ নদে আকস্মিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গাজীপুরে বোরো ধান তলিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ইসলামপুর, কড্ডা, বাসন, লাঠিভাঙ্গা, ইটাহাটা, কাঁঠালিয়াপাড়া, মজলিশপুর এলাকার শত শত বিঘা জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। কষ্টের ফসল চোখের সামনে ডুবতে দেখে দিশাহারা কৃষক। অনেকে কাঁচা বা আধাপাকা ধানই কেটে নিচ্ছেন।
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গাজীপুর সদরে ১২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে রোরো ধান চাষ হয়েছে। উজান থেকে আসা পানিতে তুরাগ নদতীরের বিল ও নিচু জমিতে প্রতিদিনই পানি বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা গেছে, কোনো ক্ষেতের ধান সবুজ, কোনো ক্ষেতেরটা মাত্র সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। নদের পানি বিলে ঢুকে অনেক স্থানে ধান ডুবুডুবু করছে। কৃষক নৌকা, কলাগাছের ভেলা নিয়ে আধাপাকা ধান কাটছেন। বসে নেই নারী-শিশুরাও।
মজলিশপুর এলাকার কৃষক মনির হোসাইন বলেন, রবিবার থেকে নদে পানি বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে চোখের সামনেই ডুবতে থাকে তাঁদের স্বপ্ন। কারণ এলাকার শত শত কৃষক এ রোরো ধানের ওপরই নির্ভরশীল। পরিবারের সদস্যদের বছরের খাবার, সাংসারিক খরচ সব এই ফসল থেকেই আসে। এরই মধ্যে বিলের ৭০ শতাংশ ফসল ডুবে গেছে। আর ১০-১৫ দিন গেলে কৃষক পাকা ধান ঘরে তুলতে পারতেন।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে হঠাৎ নদ-নদীর পানি বাড়ায় আশপাশের এলাকার শতাধিক একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। উপজেলার ওপর দিয়ে ঝিনাই ও বংশাই নদী প্রবাহিত। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছর এসব নদীর তলদেশ এবং তীরবর্তী এলাকার চর জেগে ওঠে। বিস্তীর্ণ এসব চরে স্থানীয় চাষিরা বোরো ধানসহ নানা ধরনের সবজি আবাদ করে থাকেন।
বৃহস্পতিবার উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের শেহড়াতৈল, টেংরাপাড়া প্যাঁচপাড়া, বান্দরমারা তরফপুর ইউনিয়নের পাথরঘাটা, রামপুর, ফতেপুর ইউনিয়নের চাকলেশ্বর, নিচিন্দপুর, সুতানড়ী, ফতেপুর, থলপাড়া ও বানকাটা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বোরো ধানসহ আবাদকৃত সবজি জোয়ারের পনিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানায়, এক সপ্তাহ আগেও যেখানে সবুজের সমারোহ ছিল, সেখানে বর্তমানে জোয়ারের পানি থইথই করছে।
থলপাড়া গ্রামের চাষি শামছু মিয়া ও আপেল মিয়া জানান, অন্য সব বছরের চেয়ে এ বছর ধানের ফলন বেশি হয়েছিল। অসময়ের পানি এ এলাকার চাষিদের স্বপ্ন তলিয়ে দিয়েছে।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল বলেন, কৃষি অফিসের লোকজন এলাকায় গিয়ে ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছেন।
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত জেলায় মোট ২০ হাজার ১১০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। এখনো হাওরে ২১ হাজার ৮৬০ হেক্টর ও সমতলে এক লাখ ৪২ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি আছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, ধনুর পানি বাড়তে থাকায় কাটার বাকি ধান নিয়ে আতঙ্কে আছেন তাঁরা। খালিয়াজুরী উপজেলার কীর্তনখোলা এলাকার বাঁধের পাঁচ কিলোমিটার অংশ পানির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাঁধ ভেঙে গেলে চোখের পলকে তলিয়ে যাবে জমির সব ধান। সূত্র : কালের কণ্ঠ