ছোটবেলায় বর্ষাকালে ভাটিবাংলার গ্রামাঞ্চলে ফি-বছর সুদূরবর্তী কুশ্যুমুল গ্রাম থেকে ছইওয়ালা ক্ষুদ্র নৌকায় চেপে ঢপযাত্রার একটা দল আসতো।
আমাদের গ্রামে দলটি মাসখানেক হিন্দু মহল্লার আশেপাশে নৌকা নিয়ে অবস্থান করতো। বেশিরবাগ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত গৃহস্থের অপরিসর উন্মুক্ত উঠোনেই তাদের এ যাত্রাগান পরিবেশিত হতো।
পালা সবসময়ই শেষ বিকেলে শুরু হতো এবং শেষ হতো সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলার আগেই।
তাঁদের পালাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো নিমাই সন্যাস, মানভঞ্জন, মাথুর ও নৌকাবিলাস।
পালায় অনেক চরিত্র থাকলেও আমি একদিন দুপুরের রান্নার বেলা লুকিয়ে সাঁতার কেটে ওঁদের নৌকায় উঁকি দিয়ে দেখেছি বাটনা-কুটনা-রান্না আর ধোয়ামাজায় ব্যস্ত ছোট-বড় মোট চারজন মানুষকে নিয়েই তাঁদের যাত্রাদল।
তারা অনুষ্ঠানের সময় সাজগোজ পাল্টিয়ে প্রত্যেকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে থাকে।
পেইন্ট আর সাজগোজ সেরে পালা শুরুর আগে লাল সালু গায়ে জড়িয়ে অধিকারী সবার সামনে এসে বলতেন আমরা প্রস্তুত, বলুন কোন পালা শুরু করবো।
আমাদের পূবের হাটির একমাত্র কালীবাড়িতে প্রতি বর্ষায় বানিয়াচংয়ের গাজীর গাইন এসে গাজীর পালা পরিবেশন করলেও ঢপযাত্রা অনেক বাড়িতেই হতো।
আমি কালীবাড়ি ছাড়াও প্রতিবেশি সারদাচরণ রায়, ধনী গোঁসাই, আমাদের বাড়ি ও আমাদের কাকা হরিধন দাসের বাড়িতে ঢপযাত্রা শুনেছি। পালার কুশীলবদের সংলাপ দলটি চলে যাবার পরেও দুয়েকমাস মানুষের মুখেমুখে উচ্চারিত হতো।
একটা উল্লেখযোগ্য সংলাপ ছিল নেশার ঘোরে উন্মাদ জগাই-মাধাই ভ্রাতৃদ্বয়ের।
ওটা কে রে- হরিনামে বিভোর নিমাইকে রাস্তায় দেখে মাধাইয়ের এমন প্রশ্নের জবাবে মদের বোতল হাতে টলতে টলতে জগাই বলেছিল, এটা জগন্নাথ মিশ্রের কুপুত্র নিমাই।
বিখ্যাত কুশ্যুমুল গ্রামটি কোথায় এখনো জানি না।
জানা হয়নি ঢপযাত্রা শব্দটির মানেও।
তবে জীবনের ঢপযাত্রায় কুশ্যুমুলের অধিকারীর মতো অনেকেরই মুখে প্রতিদিন সরবে বা নিরবে উচ্চারিত হয়, বলুন আজ কোন পালা শুনবেন।
(লেখাটি লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেওয়া)