এলাকায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও অসহায় মানুষের সেবা করাই যার নেশা, তিনি হলেন অমর চাঁদ দাস। যিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত, রয়েছেন চিরকুমার। অসহায় মানুষের বন্ধু অমর চাঁদ দাস ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের শ্যামারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নদী দাস, মাতার নাম ভগবতী দাস।
অমর চাঁদ দাস জন্মের কিছুদিন পর তাঁর মা মারা যান এবং তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে অধ্যায়ন করেন তখন তাঁর বাবা মারা যান। পিতা মাতা হারা অমর চাঁদ দাস নিজ জন্মভূমি শ্যামারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর দিরাই থানার রাজানগর কৃষ্ণচন্দ্র পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় মাধ্যমিক এবং নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঐ কলেজেই স্নাতক অধ্যায়ন করেন। তিনি ছাত্র জীবনে ১৯৬২ সালে স্থানীয় ভাবে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নেত্রকোণা কলেজে অধ্যায়নকালে দেশে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। এসময় অমর চাঁদ দাস ভারত চলে যান। পরবর্তীতে দেশে ফিরে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করলেও ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে বিএ পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে অবস্থিত মাক্সিট লেলিনিস্ট ইন্টারনেশনাল স্কুলে রাজনীতি বিষয়ে ৭ মাস অধ্যায়ন করেন।
তিনি রজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় ছাত্র ইউনিয়ন, নেত্রকোণা কলেজ শাখার সদস্য, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, দিরাই থানা শাখা সক্রিয় কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির প্রথমে কর্মী পরে সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, কৃষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
অমর চাঁদ দাস মূলত ছাত্র জীবনে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও ১৯৬৭ সালে বাংলার অগ্নিকন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতা ও পংকজ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক আলোচনা শুনে ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হন এবং তাঁর কার্যক্রমকে আরো বেগবান করেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির দিরাই থানা শাখার সক্রিয় কর্মী হিসেবে বৈঠা চালিত নৌকা বেয়ে গ্রামে গ্রামে নির্বাচনী প্রচার চালান এবং দলের তহবিল শিক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনে বাঁশের লাঠি নিয়ে এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। পরবর্তীতে কমরেড বরুণ রায় এবং পীর হাবিবুর রহমানের নির্দেশ মেনে মেঘাল-মৈলাম আশ্রয় শিবিরে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এলাকায় ফিরে বিভিন্ন ধরণের জনকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত হন।
এদেশের সবচেয়ে অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াকু সংগঠন ক্ষেতমজুর সমিতির আন্দোলনে দিরাই শাল্লা ও খালিয়াজুরি থানা এলাকা থেকে শতাধিক কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠিত করে পায়ে হেটে মোহনগঞ্জ যান এবং সেখান থেকে বিনাভাড়ায় ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দেন। এছাড়াও খাসজমির আন্দোলনের সময় সুনামগঞ্জ জেলার উজান গাঁয়ের কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি হাওরাঞ্চলে ভিত্তবান কৃষক পরিবার কর্তৃক দিনমজুর কৃষকদের উপর চালিত নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। অমর চাঁদ দাস এলাকাবাসীর সমন্বয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে কাজ করছেন। ৮৪ সালে হাওরাঞ্চলে বর্ষায় ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকারের দাবিতে বরুণ রায়ের নেতৃত্বে প্রান্তিক জনগণ সংগঠিত হয়ে ভাসান পানির আন্দোলন করে। এই আন্দোলনেও অমর চাঁদ দাস গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জানাহরা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। ঐ বছর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণ-আদালত অনুষ্ঠানের সিন্ধান্ত চুড়ান্ত হলে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আহ্বানে অনুষ্ঠীত গণহত্যার বিচার গণ-আদালতকে সমর্থন জানিয়ে অমর চাঁদ দাস দিরাই শাল্লা থেকে সাধারণ মানুষ নিয়ে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হন। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেন সুনামগঞ্জ জেলায় সংগঠিত গণহত্যার বিচার দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। যে আন্দোলন বর্তমানেও চলিয়ে যাচ্ছেন। অমর চাঁদ দাসের উদ্যোগে শ্যামারচর, পেরুয়ায় সংগঠিত গণহত্যার মামলা দয়ের হয়। তিনি এ মামলার সার্বিক তদারকি করছেন। তাই আসামীপক্ষ অমর চাঁদ দাসকে হত্যার হুমকি দিলে তিনি বাধ্য হয়ে দিরাই থানায় জিডি করে তাঁর কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অমর চাঁদ দাসেরও অবদান আছে। কিন্তু গেজেট ভূক্ত হয়নি তাঁর নাম। তবুও তিনি নিজের নাম গেজেটভূক্ত করার চেষ্টা না করে, একাত্তর সালে নিজ এলাকার নির্যাতীত বীরাঙ্গনা ও তালিকা থেকে বাদ পরা যুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেজেটভূক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ৬ (ছয়) জন বীরাঙ্গনা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভূক্ত হয়েছেন, পচ্ছেন ভাতা। আরও ০৯ (নয়) জন বীরাঙ্গনা গেজেট ভূক্ত হওয়া প্রকৃয়াধীন আছেন। তিনি, শাল্লা উপজেলায় বীরমাতা পল্লী নির্মাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অমর চাঁদ দাসের প্রচেষ্টায় অনেক গৃহহীন পেয়েছে ঘর, বঞ্চিত মানুষ পেয়েছে তাঁদের অধিকার। অথচ তাঁর নিজের বাড়িতে ঘর না থাকায় তিনি বসবাস করছেন ভাতিজার বাড়িতে। গরীবের বন্ধু খ্যাত অমর চাঁদ দাস তাঁর দেহ এবং চোখ মরণোত্তর দান করেছেন হতদরিদ্র রোগীদের স্বার্থে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত সমাজ এবং মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া অমর চাঁদ দাসের অসামাণ্য অবদান কোনদিন ভুলার নয়। সমাজসেবায় তাঁর সামগ্রীক জীবনের কর্মকান্ড তথা আত্মত্যাগের বিনিময়ে উপকৃত হয়েছে সমাজ, উপকৃত হয়েছে দেশ।
১৯৮৩ সালে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, শ্যামারচর শাখায় অবর্ণনীয় দূর্ণীতি হয়। এর প্রতিবাদে বিপ্লবী অমর চাঁদ দাস ‘গণ স্বাক্ষর নিয়ে’ সিলেট রিজিওনাল অফিসে অভিযোগ করেন। অভিযোগের তদন্ত এলে নির্ধারিত তারিখে শ্যামারচর হাই স্কুল মাঠে তৈরী হয় অস্থায়ী মঞ্চ; আসেন কৃষি ব্যাংকের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে গণজমায়েতের মাধ্যমে দায়েরকৃত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণীত হয়, নেয়া হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
অমর চাঁদ দাস সত্তরের দশকে হিন্দু রীতি অনুযায়ী প্রচলিত পণ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং সফল হন। অমর চাঁদ দাস বিশ বছর যাবৎ বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে নিম এবং তুলসী গাছের চারা উপহার দিচ্ছেন এবং নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে বট গাছের চারা লাগিয়ে আসছেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় এলাকার শিক্ষার্থীদের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে ফজরের আযানের পর ফোন করে জাগিয়ে দেন পড়াশোনা করার জন্য। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে ৭৭ বছর বয়সী অমর চাঁদ দাস রয়েছেন চিরকুমার। এ বয়সেও মানুষের বিপদে আপদে এগিয়ে যান সবার আগে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালের একটি ঘটনা। এক রাতে অমর চাঁদ দাস বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ দেখেন দিরাই-শ্যামারচর রোডে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রক্তাক্ত চারজন লোক রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। অমর চাঁদ দাস তাঁদের দিরাই সদর হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ডাক্তারের পরামর্শে সেখান থেকে আহতদের সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান নিজেই। চাঁদা তুলে অসহায় হতদরিদ্র এই রোগীদের যাবতীয় সুচিকিৎসা নিশ্চিত করে বাড়ি ফিরেন তিনি।
হাওর এলাকায় জন্ম নেয়া চিরকুমার অমর চাঁদ দাসের জীবন কেটেছে গরীব অসহায় লাঞ্চিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষের কাজ করে। তাঁর অপরসীম আত্মত্যাগের ফলে উপকৃত হয়েছে মানুষ, উপকৃত হয়েছে সমাজ, উপকৃত হয়েছে দেশ। কিন্তু আমাদের এ সমাজব্যস্থা কি দিয়েছে অমর চাঁদ দাসকে।
প্রাপ্তির এ তালিকা তৈরী করতে গিয়ে দেখা যায়- সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য অমর চাঁদ দাসকে ২০১৭ সালে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ (একটি সহায়তা ট্রাস্ট), সুনামগঞ্জ। কৃষক নেতা হিসেবে ২০১৮ সালে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে দিরাই উপজেলা সমাজ কল্যাণ এফ.বি. পাবলিক গ্রুপ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে ২০১৭ সালে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে খেলাঘর, দিরাই উপজেলা। সমগ্রজীবন নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অমর চাঁদ দাস উল্লেখিত সম্মাননা স্মারকের বাইরে কিছু পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই, এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু অমর চাঁদ দাসের উপর আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনও দায়িত্ব নেই ? যদি থাকে, সে দায়িত্ব আমরা কতটুকু পালন করেছি ?
লেখক : ফারুকুর রহমান চৌধুরী, গীতিকার ও সংগ্রাহক, দিরাই, সুনামগঞ্জ।