প্রতিদিন তপ্ত হচ্ছে ঢাকা। বিষাক্ত হচ্ছে বাতাস। চামড়া থেকে চাদর ধূলার আস্তর এমনভাবে পড়ছে যাকে আর ‘ধূলিমলিন কিংবা ‘ধূলি ধূসরিত’ বলা যাচ্ছে না। ধূলি-দূষণের এই যন্ত্রণাকে বোঝাতে কী নতুন কোনো শব্দ তৈরি হচ্ছে? ঢাকার হাজারিবাগ থেকে বালুরমাঠ ঘুরে এমন কিছু একটা আন্দাজ করা গেল। বস্তিবাসী নি¤œআয়ের মানুষেরা ধূলি-দূষণের এই নাকাল অবস্থাকে বলছেন ‘ধূলায় সব ভইরা গেছে’। এই ‘ভরে যাওয়া’ বলতে তারা কিন্তু ‘প্রলেপ বা আস্তর কিংবা অনুজ্জ্বলতা’ বোঝেন না, বোঝান ধূলায় তলিয়ে যাওয়া বা ডুবে যাওয়া। এভাবে জলবায়ু, প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট সংকটগুলো বরাবরই আমাদের ভাষা ও ব্যাকরণ প্রভাবিত করে। আবহাওয়া বদলায়, ভাষা বদলায়। প্রাণ-প্রকৃতি চুরমার হয়, ভাষাও বদলে বদলে যায়। যাহোক আলাপখানি ভাষা নিয়ে নয়, জলাভূমি নিয়ে। প্রমাণ হয়েছে তপ্ত, বায়ু ও ধূলি দূষিত ঢাকার এই নাকাল অবস্থা দ্রুত ঘটছে জলাভূমি, সবুজ বলয় ও উন্মুক্ত প্রান্তরের অভাবে। যদি এই নগরে পর্যাপ্ত জলাভূমি থাকতো তবে এই নগর প্রাণবন্ত থাকতো। দূষণের এই তীব্র ধকল সইতে হতো না। নিদেনপক্ষে ঢাকার আশেপাশের নদী ও খালগুলো আমাদের বাঁচানো জরুরি। দখল আর দূষণে মৃত, রুগণ জলাভূমি অঞ্চল গুলো পুনরুদ্ধারের এখনি শেষ সময়। যত দেরি তত ভোগান্তি। আর দীর্ঘসূত্রিতা সামগ্রিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলবে, চাইলেও আর জলাভূমি গুলো পুনরুদ্ধার হয়তো সম্ভব হবে না। কেবল ঢাকা নয়, দেশজুড়ে সকল জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষার তৎপরতা জোরদার করতে হবে। জলাভূমি সুরক্ষায় আমাদের সংবিধান ও আইনসমূহ অঙ্গীকারাবদ্ধ। জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষায় নাগরিক ঐক্য ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার সক্রিয় করা জরুরি।
কেবল ঢাকা বা বড় শহরগুলি নয়; দেশের সর্বত্র জলাভূমিগুলো আজ নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। চলনবিলের পাড়ে নাটোরের জোয়াড়ি গ্রামে ১৯০১ সনে জন্মান প্রমথনাথ বিশী। সাহিত্যিক, শিক্ষক ও রাজনীতিক। ১৯৫১ সনে প্রকাশিত ‘চলনবিল’ বইতে প্রমথনাথ লিখেছেন, …অনুমান করলে অন্যায় হবে না যে, চারশত বৎসর পূর্বে এ বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি, প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী-¯œায়ুজালের নাভিকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না।’ দেশের সবচে’ বড় বিল হিসেবে পরিচিত ‘চলনবিলকে’ নিদারুণভাবে এলোপাথারি উন্নয়নের কোপে ফালি ফালি করা হয়েছে। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকেও বিলটির আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার বর্গ কি.মি.। চলতি সময়ে তা মাত্র ৩৬৮ বর্গ কি.মি. এ দাঁড়িয়েছে। বর্ষাতে জলের বিস্তার থাকলেও হেমন্তে এর আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ২৫.৯ বর্গ কি.মি.। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, পাবনার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর উপজেলা, নওগাঁর আত্রাই উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় বিস্তৃত দেশের এই বৃহত্তম বিলের বুকের কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সড়কপথ। শুধুমাত্র চলনবিল নয়, দেশের সকল বিল জলাভূমিই আজ অধিপতি উন্নয়নের বাহাদুরিতে রক্তাক্ত। খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলায় বিস্তৃত বিলডাকাতিয়া এমনি আরেক দু:সহ উন্নয়ন-ক্ষত। উপকূলীয় বাঁধ, বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের বিলডাকাতিয়াকে তীব্র লবনজলে বন্দী করে রেখেছিল দীর্ঘসময়। মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের মধ্যঅঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ বিল আড়িয়ল। শতবছর আগে ইতিহাসকার যতীন্দ্রমোহন রায় এই বিলের প্রশস্তি টেনে লিখেছেন, চলবিল ও আইরল (আড়িয়ল) বিলেই অতি প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম ঘটেছিল। রাষ্ট্র আড়িয়ল-সভ্যতাকে অস্বীকার করে বিমানবন্দর করতে চেয়েছিল। প্রবল জনরোষের মুখে তা বাতিল হয়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ জলাভূমিময়। এ কারণেই হয়তো শ্রী হরিদাস পালিত ১৯৩২ সনে প্রকাশিত ‘কায়স্থ সমাজ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, এদেশটা জলবহুল দেশ, জলাভূমি যথেষ্ট, ছেঁচে জল ক্ষেত্রে দিতে হতো না। বাং মানে না, আর লো মানে পাত্র ডুবিয়ে জল তোলা। তা থেকে জল ছেঁচাও বোঝায়। যে দেশে ছেঁচে জল দিতে হয় না, জল ছেঁচার আবশ্যক হয়না, অর্থাৎ ধান্যক্ষেত্রে জলের অভাব হয় না সেই দেশই ‘বাংলোদিশম’। নানা বাস্তুসংস্থানে, নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসব জলাভূমি দেশের নানাস্থানে গড়ে তুলেছে বহুমাত্রিক জীবনসম্পর্ক। হাওর, বিল, বাওড়, খাল, নালা, খাঁড়ি, দীঘি, পুকুর, ঝিরি, হ্রদ, ঝর্ণা, গর্ত, খাদ, পাগাড়, বাইদ এরকম নানা নামে নানা বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাংলাদেশের জলাভূমি আখ্যান। জলাভূমি অঞ্চল হয়েও আমরা তৈরি করতে পারিনি ‘জাতীয় জলাভূমি নিবন্ধনতালিকা ও নির্ঘণ্ট’। দেশের জলাভূমি সমূহের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ও বিবরণ আমাদের নাগালে নেই। জলাভূমির ধরণ ও বিস্তারে ভিন্নতাকে গায়েব করে ‘জলাভূমি’ প্রত্যয়টি মূলত: ‘নি¤œাঞ্চল’ এর সমার্থক করে তোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র জলধারা। সিলেট অঞ্চলে টিলা-অরণ্যে এরকম অসংখ্য ঝর্ণা ও ছড়া স্থানীয় বাস্তুসংস্থানের আদি জলের উৎস। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতকে বনবিভাগ ইজারা দিয়েছে। তার আগে ‘লাইফ’ নামের একটি কোম্পানিকে এই জলপ্রপাতের পানি বোতলে ভরে বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। একই জেলার কমলগঞ্জের হামহাম জলপ্রপাত আজ বাঁশ-বাণিজ্যের কারণে ক্ষত বিক্ষত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঝিরি ও ঝর্ণা গুলোর দশাও করুণ। বান্দরবান জেলার আলীকদমের পোয়ামুহুরী, কুরুকপাতা, দোছড়ি এলাকায় হেমন্তকালটি নিদারুণ পানির কষ্টে পাড়ি দিতে হয় আদিবাসীদের। কারণ ঝর্ণা ও ঝিরি গুলো আজ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পাহাড়ে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান খুন করে বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ, বনবিভাগের বাণিজ্যিক সেগুন বাগান, নিরাপত্তার নামে বৃহৎ অবকাঠামো, বাণিজ্যিক পর্যটন, লাগাতার ভূমি দখল সব মিলিয়ে ঝিরি গুলো প্রতিদিন উধাও হচ্ছে পাহাড় থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি অঞ্চলের নামও ধারণ করে আছে ঝিরির স্মৃতি। খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি, সিন্দুকছড়ি, বরুণাছড়ি, বড়ইছড়ি, কুতুবছড়ি, মানিকছড়ি, বিলাইছড়ি। বান্দরবানের নাফাখুম ঝর্ণা, বগা হ্রদ, রাঙামাটির শুভলং ঝর্ণা, খাগড়াছড়ির আলুটিলা ঝিরি আজ করপোরেট পর্যটনের চাপে হাঁপাচ্ছে।
দেখা যায় জলাভূমি সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথিগুলো কী বলে। জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯) এর ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘…হাওড়, বাওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলােেদশর আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলির গুরুত্ব অসীম। হাওড় এবং বাওড়গুলিতে শুষ্ক মওসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে তবে ছোট বিলগুলি সাধারনত: চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলি প্লাবনভুমির নি¤œতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য-সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরণের জলজ সবজি ও পাখীর আবাসস্থল। তাছাড়াও শীত মওসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওড় এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাাশিত আবাদী জমিতে পরিনত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমী জাতীয় জলজ সবজীর বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মওসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবাহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হত। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’ অপরদিকে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ ২০০০ সনের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, …‘হাওর ও জলাভূমি এলাকা অর্থ নীচু প্লাবিত অঞ্চল যাহা সাধারনত হাওর এবং বাওর বলিয়া পরিচিত।’ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০ এর ১৮৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, …‘বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বুঝাইবে যাহার চতু:র্সীমা নির্দিষ্ট অর্থাৎ স্থলাবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারনত: হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দীঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’।
১৯৯৭ সনের আগেও বিভিন্ন উদ্যাগ নেয়া হলেও এ সন থেকেই প্রথম প্রতি বছরের ২ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। প্রতি বছরই পৃথিবীর জলাভূমি সমূহের গুরুত্ব এবং এর সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতি বছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরী করা হয়। ২০০৬ সনে জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমিসমূহ এবং পানিনির্ভর জীবন ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা’, ২০০৭ সনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আগামীর জন্য মাছ?’, ২০০৮ সনে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি, স্বাস্থ্যকর জনগণ’, ২০০৯ সনে ‘নদী ও নদী তীর ব্যবস্থাপনা’, ২০১০ সনে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ু পবির্তন’, ২০১১ সনে ‘জলাভূমি ও জংগল’, ২০১২ সনে ‘জলাভূমি ও পর্যটন’, ২০১৩ সনে ‘জলাভূমি ও পানিব্যবস্থাপনা’, ২০১৪ এবং ২০১৫ সনের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি সমূহই আমাদের ভবিষ্যত’, ২০১৬ ‘জলাভূমি আমাদের ভবিষ্যত ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’, ২০১৭ ‘জলাভূমি দূর্যোগ কমায় বা জলাভূমি দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করে, ২০১৮ ’ স্থায়িত্বশীল ভবিষ্যত নগরের জন্য জলাভূমি’, ২০১৯ ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’, ২০২০ ‘জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য’, ২০২১ ‘জল ও জলাভূমি’, ২০২২ ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভূমি কর্মসূচি’। চলতি ২০২৩ সনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জলাভূমি পুনরুদ্ধারের এখনি সময়’। জলাভূমিসমূহ আমাদের এই বৃহৎ বদ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্যের আঁতুরঘর। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ বলেছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিিহ্নত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্নহীন উন্নয়নের চাপে বারবার দেশের সকল জলাভূমির শ্রেণিচরিত্র নিদারুণভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছে। জলাভূমির সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা বহু দেরি করে ফেলেছি। আর নয়। জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় মনোযোগ ও তৎপরতা সক্রিয় করবার এখনি শেষ সময়।
গবেষক ও লেখক। animistbangla@gmail.com