হাওর ডেস্ক::
বাংলাদেশে ১০ ট্রাক অস্ত্রসহ বিভিন্ন সময় যে অস্ত্রগুলো ধরা পড়েছে সেগুলো উলফার ‘একার নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন অনুপ চেটিয়া।
তার ভাষ্য, সেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের অস্ত্রও থাকতে পারে। বিভিন্ন সময়ে উলফার সঙ্গে অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগের কথা শোনা গেলেও তা অস্বীকার করেছেন তিনি।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশ ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া সম্প্রতি দেশে এসে একদল সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। পুরো সাক্ষাৎকারটি একটি ইউটিউব চ্যানেলেও প্রকাশ করা হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার আদাবরের একটি বাসা থেকে দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন অনুপ চেটিয়া। তখন তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ, বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়।
তিন মামলায় তাকে তিন, চার ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার আদালত। ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাজার মেয়াদ শেষ হলেও তাকে দেশে ফেরানো যায়নি।
কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজতে আরও প্রায় আট বছর থাকার পর ২০১৫ সালে তাকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। এরপর আসামে একমাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান অনুপ চেটিয়া। সেখানকার সরকারের সঙ্গে এখন তাদের আলোচনা চলছে, পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে দুটো মামলাও চলছে।
আট বছর পর সম্প্রতি মেয়ে বন্যা বড়ুয়াকে দেখতে বাংলাদেশে আসেন উলফা নেতা। তার জামাতার বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লায়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি হোটেলে কয়েকজন সাংবাদিকের মুখোমুখি হন তিনি।
অনুপ চেটিয়া বলেন, “আমি প্রথম আসলাম ১৯৮৮ তে, যখন আসাম-বাংলাদেশে একটা বড় বন্যা হল। আমরা চিন্তা করছিলাম বাংলাদেশে একটা ঘাঁটি করব, যেটা ডিপ্লোমেটিক ঘাঁটি হবে। বার্মায় আমাদের একটা শেল্টার ছিল। কিন্তু সেটা অরণ্য, পাহাড়ের মধ্যে- কমিউনিকেশন কিছু ছিল না, হেঁটে যেতে হয়। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো যোগাযোগ করা যায় না।
“সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাংলাদেশে একটা ঘাঁটি গেড়ে সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন করব। তখন আমরা পার্মানেন্টলি এখানে থাকতাম না। যখন প্রয়োজন তখন আসতাম আবার চলে যেতাম। তখন বর্ডারে এতো কড়াকড়ি ছিল না। তারপর ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে আসলাম। আমি বেশি সময় দিতে চেয়েছিলাম আমাদের আন্তর্জাতিক প্রচার, ক্যাম্পেইন ও লবি করার জন্য। ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে আমি অ্যারেস্ট হইলাম।”
সে সময় ঢাকায় কী পরিচয়ে থাকছিলেন জানতে চাইলে এই উলফা নেতা বলেন, “সেসময় তো বিজনেসম্যান হিসেবে থাকতাম। একটা নাম নিছিলাম জন ডেভিড, আমি এখানে খাসিয়া উপজাতি পরিচয় দিয়ে থাকতাম। আমি অ্যারেসট হয়েছিলাম আদাবর থেকে, ওখানেই থাকতাম।
“১৯৯৭ এর পরে আমার ওয়াইফ মেয়েকে স্কুলে দিল। অনেকগুলো স্কুলে পড়ছে। লাস্টে গিয়ে মাস্টারমাইন্ডে পড়ছে। তখন ওরা মুসলিম নাম নিয়ে পড়েছে। আমি যখন ছিলাম, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের আগে আমার ছেলেকে যখন ভর্তি করালাম, তখন কিন্তু আমি তার নামের টাইটেল লিখেছিলাম বড়ুয়া।”
বাংলাদেশের কারা সম্পৃক্ত ছিল উলফার সঙ্গে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল অনুপ চেটিয়ার কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের যাদের আত্মীয়রা আসামে রয়েছেন বা আসামের যারা এদেশে রয়েছেন, এমন কিছু পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। এর বাইরে বাংলাদেশিদের সঙ্গে উলফার সম্পর্ক ছিল না।
১৯৮৮ সাল থেকে অনুপ চেটিয়া যখন বাংলাদেশে থাকতে শুরু করলেন, সে সময় উলফার কতোজন এদেশে ছিল, তাও জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।
উত্তরে অনুপ চেটিয়া বলেন, “বেশি ছিল না তখন, পাঁচ-ছয়জন হবে হয়ত, অফিস মেইনটেইন করার জন্য। আমি ধরা পড়ার সময় আমরা মনে হয় ১০-১২ জন ছিলাম। বেশি লোক কিন্তু ছিল না। এখানে আমাদের কোনো ক্যাম্প ছিল না।”
প্রসঙ্গ: অস্ত্র
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সিইউএফএল জেটিঘাটে দুটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে অস্ত্র খালাস করে ট্রাকে তোলার সময় পুলিশ আটক করে। পরে তা ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হিসেবে পরিচিতি পায়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অস্ত্র ও গোলাবারুদের এই বিপুল চালান ধরা পড়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেসময় বলা হয়েছিল, চীনের তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওই চালান ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া বলেন, “প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে সেগুলো উলফার ছিল। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, ওগুলো উলফার একার ছিল না।”
হবিগঞ্জের বনে কয়েক দফায় মর্টার শেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। একইভাবে জামালপুরের হালুয়াঘাট থেকেও অনেক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল ওই অস্ত্রগুলোও উলফার।
এ বিষয়ে অনুপ চেটিয়ার উত্তর, “আমি মনে করি এগুলো উলফার এটা বলা যাবে না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কোনো না কোনো সংগঠন এটা আনছে। কিন্তু উলফাই বলা যাবে না। কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যতোগুলো সংগঠন ছিল, তাদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। সেরকম হতে পারে।”
সেসময় আসাম ছাড়াও ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে অবস্থানের খবর শোনা যেত।
অস্ত্রগুলো কীভাবে আনা হয়েছে জানতে চাইলে উলফা নেতা বলেন, “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক চোরাকারবারী তো বেচার জন্য বসে আছে। আপনার টাকা থাকলে আপনি কী না পাবেন।”
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় হয়। তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং উলফার সামরিক শাখার কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ মোট ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
অর্থের সংস্থান
উলফার অর্থের সংস্থান হত কী করে জানতে চাইলে অনুপ চেটিয়া বলেন, “আমরা সেসময় চা বাগানের মালিকদের কাছ থেকে প্রতিকেজি চায়ে ৫০ পয়সা করে উসুল করেছি, সংগঠন চালিয়েছি।”
বলা হয়, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং চীনা সরকারি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে উলফা। এ বিষয়ে অনুপ চেটিয়ার ভাষ্য, “এগুলো সব মিথ্যা কথা। আমি তো বলেছি চা বাগান থেকে আমরা অর্থ সংগ্রহ করেছি।”
বাংলাদেশে উলফার কোনো বিনিয়োগ ছিল কী না জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, “যখন জেলে ছিলাম তখন পত্রিকায় দেখতাম লিস্ট দিত, কোথায় কোথায় উলফার ব্যবসা আছে। কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছে। এগুলো সবই অপপ্রচার। এরকম কিছু কখনোই ছিল না। পরে তো সরকার এনকোয়ারি করছে। কিন্তু কিছু তো পায়নি। থাকলে তো পাবে, না থাকলে কই থেকে পাবে।”
উলফা এখন কারা চালাচ্ছে জানতে চাইলে অনুপ চেটিয়া বলেন, “উলফা আসলে দুই ভাগ হয়ে গেছে। একটা আমরা। আরেকটা উলফা স্বাধীন, যেটা পরেশ বড়ুয়ারা চালাচ্ছেন। তবে আমাদের মধ্যে আলাপ চলছে।”
তবে মূলধারার রাজনীতিতে আসতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অনেকেই যোগ দিচ্ছেন। সংসদীয় রাজনীতিতে আমি আসব না।”
(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)