হাওর ডেস্ক::
মামলা ছাড়া কারো অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন -র্যাব কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারে কিনা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কাউকে গ্রেপ্তারের এখতিয়ার র্যাবের আছে কিনা, সে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়ার রিট শুনানিতে এ প্রশ্ন তোলেন আদালত।
গত ২২ মার্চ ১২টার দিকে আটকের পর গত ২৪ মার্চ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের। আটকের পর সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কিনা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের ব্যবহার আইনানুগ হয়েছে কিনা, হাইকোর্ট সে প্রশ্নও রেখেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কাছে।
আগামী ৫ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এ সময়ের মধ্যে এসব প্রশ্ন সংক্রান্ত আইন, নথি ও সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
নওগাঁ সদরে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের (৪৫) মৃত্যু সংক্রান্ত প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন সোমবার নজরে এনে আদালতের স্বপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। বিষয়টিতে শুনানির পর হেফাজতে ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা এবং মৃত্যুর কারণ জানতে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেখতে চান আদালত।
সুলতানা জেসমিনকে আটকের কারণ, স্থান, সময়, হেফাজতে নেওয়ার কারণ, জিজ্ঞাসাবাদ সুনির্দিষ্ট তথ্যও চান আদালত। আর এসব তথ্য জানাতে রাষ্ট্রপক্ষকে এক দিনের সময় দেওয়া হয়। আর আদালতের দৃষ্টিতে আনা ওই আইনজীবীকে বলা হয় রিট আবেদন নিয়ে আসতে। নির্দেশমত আজ মঙ্গলবার আদালতে প্রতিবেদন দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছিল না। অন্যদিকে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সহকারী অ্যাটির্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ।
বেলা আড়াইটায় শুনানি শুরু হলে রিটকারী আইনজীবী আবেদনের আরজি তুলে ধরে বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো বিষয়ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। র্যাব গঠন করা হয়েছিল দাগি চোর-ডাকাত, মাদক চোরাকারবারি ধরতে। এই নারীকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করা হয় ২২ মার্চ। আর ২৪ মার্চ তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তারের এখতিয়ার পুলিশের থাকলেও র্যাবের নেই। তাছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই র্যাব এ ধরনের বেআইনি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আজ অসহায়। র্যাব যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নিয়ে উধাও করে দিচ্ছে। এটি (সুলতানা জেসমিনকে আটক, হেফাজত, জিজ্ঞাসাবাদ) সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে করা হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে। ফলে র্যাবের কর্মকাণ্ড ও নারীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। যে কারণে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।’
এরপর শুনানিতে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সুলতানা জেসমিনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। তার মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এক ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ ১১ টা ৫০ মিনিটে নওগাঁ সদরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। পরে জনসাধারণের সামনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। তার আগে আটক ওই নারীর মোবাইল ফোন থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য ও নথি উদ্ধার করা হয়।’
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় র্যাব ওই নারীকে আটকে রাখেনি দাবি করে আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশে সোপর্দ করতে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে আটক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে দুপুর সোয়া ১টায় প্রথমে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তার রক্তচাপ ছিল ৯০/৬০। এরপর ওইদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তিতে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এটি সম্পূর্ণভাবে ভুল যে, ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ওই নারীকে রাখা হয়েছে।’
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘কোনো অনুমানের ভিত্তিতে আমরা ঘটনাটি বিবেচনা করব না। আটকের পর তাকে পুলিশে সোপর্দ করার কথা। সেটি কিন্তু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তার মাথায় আঘাতের কথা বলা হচ্ছে। দেশবাসীর প্রশ্ন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল কিনা। বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। তার জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আমরা দেখতে চাই। তাছাড়া, র্যাব গঠন-নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনটিও দেখতে চাই যে, সে আইনে র্যাবকে কি কি এখতিয়ার, ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দেখতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় র্যাব কাউকে আটক করতে পারে কিনা, জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে কিনা। যে কারণে র্যাবের এখতিয়ার জানাটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেতে চাই মামলা ছাড়া কারো কোনো অভিযোগে র্যাব কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারে কিনা। স্বীকারোক্তি নিতে পারে কিনা।’