করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতি যাতে বড় ধরনের ঝুকির মাঝে না পরে তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি এবং এদেশের জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন।দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমি যাতে কাজে লাগে সেটি তিনি শুধু ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেননি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য নিজেই নেমে যান মাঠে। গণভবনে তার এই প্রচেষ্টা যখন শাইখ সিরাজের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তখন সবার কাছে সেটি নতুন অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথই উদ্যোগ আর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেন না কেন যদি সরকারের কাজ বাস্তবায়নকারী ও তদারকি সংস্থার গাফিলতি থাকে তাহলে সেই উদ্যোগ মার খাবে। এমনই একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের হাওর এলাকায়। বন্যা, শিলাবৃষ্টি ও খরার জন্য হাওর এলাকার বোরো ধান নিয়ে ঝুকি ও অনিশ্চয়তা থাকলেও এবার সেই ঝুকির কারণ বিএডিসি ও কৃষি বিভাগের চরম গাফিলতি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হাওর এলাকার বোরো ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই দুই সংস্থার কারণে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই বিপর্যয়ের কারণ হল অসচেতণ কৃষককে সজাগ না করায় তারা চিরাচরিত নিয়মে ব্রি-২৮ ধান আবাদ করে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কৃষি বিভাগ এই ধানকে আবাদের অনুপযোগী বললেও সেই খবরটি কৃষককে দিতে পারছে না। আর বিএডিসির বীজ বিভাগ ক্ষতিকর জানার পরও কেন কৃষকের হাতে এই বীজটি তুলে দিল তা নিয়েই প্রশ্ন আমার।
বাংলাদেশে বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে যে জাতটি সবছেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয় সেটি হল ব্রি-২৮। ভাল ফলন ও আগাম কেটে ফেলার সুযোগ থাকায় কৃষকরা এই ধানটির প্রতি আকর্ষণ বোধ করে বেশি। হাইব্রিড আসার পরও এই জাতের প্রতি কৃষকের মোহ তেমন একটা কমেনি। কিন্তু দুই যুগ পূর্বে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবনকৃত এই জাতটি এখন আর আবাদ উপযোগী নয়।ব্রি-২৮ ধান এতদিন খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এতে চিঠা ও পোকামাকড়ের আক্রমন বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করে।কৃষি বিভাগ বলছে এটি আর আবাদের উপযোগী নয়। কিন্তু কৃষি বিভাগহ সেই কথা বললেও কৃষকের কাছে সেই বার্তাটি সঠিকভাবে পৌছানো হয়নি। আবার আবাদ উপযোগী নয় বলার পরও বিএডিসি এই ধানের বীজ বিক্রি করে আসছে।
হবিগঞ্জের শস্য ভান্ডার খ্যাত গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের বেশ কিছু এলাকায় ব্রি-ধান আবাদ করে মার খেয়েছেন কৃষক। ধানের গাছ ভাল হলেও তা চিটায় ভরপুর। উৎপাদিত ফসলের ৭৫ শতাংশ চিটা এবং ২৫ শতাংশ ধান। অনেকেই গোখাদ্যের জন্য তা কেটে আনছেন। আবার দাওয়ালরা (ধান কাটার শ্রমিক) পোষাবে না বলে সেই ধান না কাটায় জমিতেই পড়ে থাকছে পাকা ধান। বিপুল পরিমাণ জমিতেই এই দৃশ্য বিদ্যমান থাকলেও কৃষি বিভাগ এই ক্ষতিগ্রস্থ জমির পরিমাণ তাদের তথ্য তালিকায় উল্লেখ করেছে অল্প। সেখানকার কৃষকের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি শত শত একর জমিরে ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ বলছে চিটার কারণে ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ৬৫ হেক্টর। হাওরের জমি এক ফসলি। মূলত বোরো ধানই এখানকার প্রধান ফসল। বোরো ধানের ফলন ভালো হলে হাওরের কোনো পরিবারে ভাতের কষ্ট হয় না। তবে কোনো কারণে ফসলহানি হলে পরের মৌসুমে ফসল তোলার আগ পর্যন্ত হাওরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গেল কয়েক বছর ফসল তুলতে কৃষকদের খুব বেশি সমস্যা হয়নি। তবে এবার ব্রি-২৮ কৃষকদের হতাশ করেছে। আমার সাংবাদিক বন্ধুদের মাধ্যেমে জানতে পেরেছি শুধু হবিগঞ্জই নয়, কিশোরগঞ্জ,মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জেও এধরনের ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে।
হারও এলাকার কৃষকদের সাথে আলোচনাকালে তারা জানায়, এই ধান আবাদ করলে ক্ষতি হবে তা তাদের জানা নেই। তিন বছর যাবৎ তাদের এলাকায় কোন কৃষি কর্মকর্তা যায়নি। বিএডিসি থেকে বীজ ক্রয়ের সময়ও কেউ বলেনি এটি আবাদ না করার জন্য। আবার কৃষি বিভাগের লোকজনের সাথে কথা বললে তারা জানায়, তারা কৃষকদের মাঝে ব্যাপক প্রচার করেছে। কিন্তু কেন কৃষকদের কাছে এই ধানের বীজ তুলে দেয়া হল সেই প্রশ্ন আমার। আর এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রচারনার জন্য প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদেরকে কেন সম্পৃক্ত করা হল না সেটিও ভেবে দেখা উচিত।
কৃষি বিভাগ বলছে হাওর এলাকায় ৭০ শতাংশ জমিতে আবাদ হয় হাই ব্রীড ধান। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ জমির মাছে ১৫ শতাংশতে আবাদ হয় ব্রি-২৮ এবং ১৫ শতাংশ জমিতে ব্রি-২৯। কিন্তু ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ এর পরিবর্তে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে ব্্ির-৮৮,৮৯ ও ৯২। এগুলোর ফলন ভাল। আগাম কাটা যায় এবং শীত সহনশীল। বিএডিসি এই বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করছে না। কৃষকদেরকেও সচেতন করা হচ্ছেনা। অথচ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের কিছু কিছু বিভাগ ও সংস্থা আছে যেগুলোতে কাজ করা মানে শুধু মাসে মাসে বেতন নেয়া নয়। শিক্ষা, স্থাস্থ্য ও কৃষি বিভাগ এই ধরনের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কৃষি বিভাগের লোকজন চাকুরী করে মাসে মাসে বেতন নিবেন আর কৃষকদেরকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, এটি হতে পারে না। আমাদের নীতি নির্ধারকরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা না করলেও সদুর জাপান থেকে আসা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ টেটসুও সুটসুই নামে এক ব্যাক্তি ঠিকই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছেন। তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখতে পান বাংলাদেশের হাওর এলাকার জন্য নতুন জাত উদ্ভাবন করছে ব্রি। কৃষকদেরকে এই জাত আবাদে সহায়তা করে থাকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আবার কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বীজ উৎপাদন করে বিএডিডিস। কিন্তু এই তিনটি সংস্থার কাজে কোন সমন্বয় না থাকায় কৃষকরা উপকৃত হচ্ছে না। আবার এলজিইডি,পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা সেচ নিয়ে কাজ করছে। সেখানেও পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। তিনি এই সংস্থাগুলোর মাঝে সু সমন্বয় সৃষ্টি করে কৃষকদের উন্নয়নের কথা বলেছেন। তার সাথে আলাপ করলে তিনি বলেন সরকারী এই সংস্থাগুলোর সু সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। আর না হলে কৃষকদের মাধ্যমেই বীজ উৎপাদন করতে হবে। এখানকার কৃষকরা এক সময় নিজেদের বীজ নিজেরাই উৎপাদন করতেন। এখন কৃষকরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আবাদ করছে চায়না হাইব্রিড ধান। এই ধরনের বীজের সমস্যা হল প্রত্যেক বছরই বীজ ক্রয় করতে হয়। তাই ঘরে বীজ তৈরির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তিনি তার প্রতিষ্টান থেকে হবিগঞ্জে একটি ৫ বছরের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। তার প্রচেষ্টার মূল ফোকাস হল ব্রি ৮৮,ব্রি ৮৯ ও ব্রি ৯৪ কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করা। আবার কৃষকদেরা যেন নিজেরাই বীজ তৈরি করতে পারে সেই বার্তা পৌছে দেয়া। তিনি মনে করেন নতুন জাত আবিস্কার নয় বরং আবিস্কারের পর তা কৃষকদের কাছে সরবরাহ করাই এখানে বড় চ্যালেঞ্জ।
টেটসুও সুটসই এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, হাওর এলাকায় ক্লাইমেট চেইঞ্জ ছাড়াও আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। খাল ভরাট ও পানির রিজার্ভার না থাকায় ফসল আবাদ কমে যাচ্ছে। এগুলোও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তা নিয়ে সরকার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে না। ব্রি-২৮ ধানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক অথচ তা নিয়ে তেমন প্রচরণা হচ্ছে না।
এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন ধান বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত ১০৬টির মত নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু এই গবেষণার সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সু-সমন্বয়ের অভাবে। জাপান থেকে আসা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞর চোখে বিষয়টি ধরা পড়লেও আমাদের নীতি নির্ধারকরা তা নিয়ে কেন চিন্তুা করছেন না তা নিয়েও প্রশ্ন আমার।
ধান বিজ্ঞানীদের সাথে আলাপকালে জানতে পারি ব্রিডারের হাতে থাকলে যে কোন জাত আজীবন সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু যখন অন্য কারও মাধ্যমে এই বীজ উৎপাদন হয় তখনই এর বিশুদ্ধতা হারায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ক্লাইমেট চেইঞ্জ এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। বিদেশে যে কোন নতুন জাত আবিস্কারের ৫ বছর পর তা অপসারণ করে নতুন জাত কৃষকদেরকে দেয়া হয়। আমাদের দেশে এই স্বক্ষমতা এখনও হয়নি। তবে ৫/৭ বছর পর নতুন একটি জাত পরিবর্তন না করলে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন ধান বিজ্ঞানীরা। যার প্রমাণ এভাবে হাওর এলাকায় ব্রি-২৮ ধান আবাদ করে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া। এই ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার নমুনা গত কয়েক বছরই ছিল। তবে এবারই বেশি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অথছ এখন সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনতিকেই সেচ,সার ও উপকরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিতে অনেক চ্যালেঞ্জ। তার উপর এই খমাখেয়ালীর কারণে আমাদেরকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে দাড় করিয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে কৃষকরা ভাল দাম না পেয়ে কৃষি বিমুখ হয়েছিলেন। কিন্তু এখন যখন নতুন উদ্যোম আর উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মত তখন এই ক্ষতি মেনে নেয়া যায় না। এর পিছনে যাদের দায় রয়েছে তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার মাঝে নিয়ে আসতে হবে। আর না হলে বড় ধরনের ধাক্ষা খাবে আমাদের কৃষি। বিপন্ন হবে কৃষক। হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। পড়বে রিজার্ভের উপর চাপ।
লেখকঃ
সাংবাদিক ও আইনজীবী