বিশেষ প্রতিনিধি::
‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজে যায়/ এসোনা গল্প করি’ ভরা বর্ষায় জোছনা বিলাসে গিয়ে রাতের বজরায় আমাদের এই গান গাওয়ার কথা ছিল। জোছনার পৌরাণিক আলোয় কথা ছিল রাতে উথলা হওয়ার। কিন্তু প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের ‘চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো’-তেই আমাদের থামতে হয়েছে ‘চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়’। মেঘালয় থেকে নেমে আসা চলতি নদীর মোহনা জিনারপুর দ্বীপখণ্ডে সবুজ ঘাসের বিছানায় উপভোগ করতে হয়েছে মেঘঘেরা চাঁদের জোছনাকে। ব্যাস, এটুকুনেই শান্ত ছিলেন জোছনাভূক যুবকের দল। এক অন্যরকম প্রকৃতিঘনিষ্ট নির্ভেজাল ও স্বচ্ছ পৃথিবীর স্বাদ নিয়ে ঘরে ফিরেছেন তারা।
এভাবেই বৃহষ্পতিবার রাতে আড্ডা ও গানে নৌবিহারে মেঘে মেঘেই জোছনাস্নান করেছেন সুনামগঞ্জের পেশাজীবী সংগঠনের তরুণরা। বৃহষ্পতিবার রাত ৯টা থেকে শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত তারা চলতি নদীর বুকে নৌকায় অবস্থান করে আনন্দ উদযাপন করেন। জোছনাবিলাস নামে তরুণদের এই রাতভ্রমণে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীরা অংশ নেন। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, যাপিত জীবনের বারো রকমের অভিজ্ঞতা ওঠে আসে আড্ডার বক্তব্যে। পরে রাতভর বাঁশির সুর ও গানে গানে আনন্দ উপভোগ করেন তারা।
সুনামগঞ্জের সন্তান ও মানবিক চিকিৎসক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাককান গলা বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. এম নূরুল ইসলামের উদ্যোগে জোছনাবিলাস উদযাপন করা হয়। তাকে অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন তার বাল্যবন্ধুরা। তিনি তার সহপাঠীসহ কর্মজীবনের বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান অনুষ্ঠানে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা ছুটে আসেন জোছনার ডাকে।
৩ আগস্ট বৃহষ্পতিবার রাত ১০ টায় শহরের রিভারভিউ থেকে হাউসবোট নিয়ে জোছনার খুঁজে বের হন তারা। জোছনাবিলাসী যুবকেরা জোছনায় মাতোয়ারা হতে ঘর থেকে বেরুলেও আকাশ তখন মেঘের দখলে। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় বৃষ্টি। জোছনা খোঁজার মিশনে প্রকৃতির এই খেলায় বিষন্ন হওয়ার কথা থাকলেও কেউ মন খারাপ করেনি। একটা রাতÑজল, জলা, হাওর-কান্দা, নদী, পাহাড় নদী-প্রকৃতির সঙ্গে কাটানো যাবে ব্যাস, এতেই তারা তৃপ্তি ছিলেন।
নৌকা ছাড়ার পরই শুরু হয় গান। ইচ্ছেমতো পছন্দের গান পরিবেশন করেন অংশগ্রহণকারীরা। ফাঁকে ফাঁকে চলে বক্তব্য। জীবনের গভীরতা ও হাস্যরসে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বন্ধুদের আনন্দ দেন অংশগ্রহণকারীরা।
বেলা ১টার সময় চলতি নদীর জিনারপুর মোহনার দ্বীপখ-ে নৌকাটি নোঙ্গর করা হয়। নদীর বুকে জেগে ওঠা একখ- ঘাসছাওয়া ভূমিতে নেমে সবাই লম্বা শ্বাস নেয়। এসময় দেখা যায় মেঘের চাদর সড়িয়ে পৌরাণিক চাঁদ রূপের ছটা নিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্ঠা করছে। আর কালিদাসের দলছুট মেঘগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে-কিছুতেই রূপের ছটা দেখাতে দিবেনা রাতের পৃথিবীকে। জোছনা ও মেঘের লড়াই দেখেই জোছনা¯œানের তৃপ্তি মেটান জোছনাবিলাসী তরুণেরা। একটু ক্ষণের জন্য লজ্জাবতী চাঁদকে পেয়ে সবাই আবেগে উথলে ওঠেছিলেন। এখানেই চালের রুটি ও রাজহাঁসের মাংসে উদরপূর্তি করেন সবাই। তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একদল তরুণ চিকিৎসক ছুটে আসেন। ডা. কায়সার খোকন, ডা. অরূপ, ডা. হাসান ও ডা. মনতোষ। তারা খোলা ও কোরাস কণ্ঠে পরিবেশন করেন সিলেটের নিভৃতচারী কবি জাহেদ আহমদের কথা ও সুরারোপিত ‘হতাম যদি মাছ/নলুয়ার হিজল গাছ’ গানটি। এরপরে মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত বাউল কানু ও তার দল এই অঞ্চলের বাউল সাধকদের একাধিক গান পরিবেশন করেন। উদ্দাম আনন্দে নেচে গেয়ে রাতের পৃথিবীকে উপভোগ করেন জোছনাভূক যুবকের দল।
মেঘ ও জোছনার লুকোচুরির কারণে জোছনাবিলাস অভিযাত্রার পুরো তৃপ্তি না পেয়ে আয়োজক ডা. নূরুল হাতে তুলে নেন মাইক্রোফোন। তিনি ঘোষণা দিন আগামীতে বন্ধুদের নিয়ে কোনও এক হাওরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে বজরা ভাসাবেন। নিশুতিনিবীড়ে সিক্ত হবেন জোছনায়। এই ঘোষনায় সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান।