স্টাফ রিপোর্টার::
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কুলঞ্জ ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামে গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে গুলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩জন গুলিবিদ্ধসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় উত্তেজনা বিরাজ করায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে একটি পক্ষ এ নিয়ে গত জানুয়ারি থেকে তিনদফা অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। তাদের অস্ত্রের মহড়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। তবে এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন হামলায় ব্যবহৃত বন্দুক ‘কাঠের বন্দুক ও ‘লোহার পাইপ’।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুলঞ্জ ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামের একরার হোসেন সম্প্রতি হাতিয়া স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ নিয়ে গ্রামবাসী ও স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে তার ও তার সমর্থকদের ভয়াবহ বিরোধ চলছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সিলেট শিক্ষা বোর্ড তদন্ত করে অনিয়মের অভিযোগে তার কমিটি বাতিল করে দেয়। ফলে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক ও গ্রামবাসীর সঙ্গে দ্বন্দ প্রকট হয়। এছাড়াও গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য সোহেল মিয়াসহ লিটন ও জুয়েলের সঙ্গেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তার বিরোধ চলছে। গত ৯ ডিসেম্বর সিলেট শিক্ষাবোর্ডে কমিটি বাতিলের কাগজ নিয়ে আসার পথে বোর্ড ক্যাম্পাসেই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ট লোক শামীম আহমদ হঠাৎ হামলা করে শিক্ষকের ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। এ ঘটনায় মোগলাবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে অভিযুক্ত শামীম আহমদ জোরপূর্বক স্কুল ক্যাম্পাসে ডুকে প্রতীকী সংবাদ সম্মেলন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষক মো. আনিস আহমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেন। এ ঘটনায় আনিসুর রহমান সিলেটে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। গত ৯ মার্চ চেয়ারম্যানের লোকজন শিক্ষক আনিস আহমদের উপর হামলা করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে এখন সিলেটে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
শিক্ষকের উপর হামলার প্রতিবাদে স্কুলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী মানববন্ধন করার সময় তার সমর্থক রাজীব হোসেন বন্দুক নিয়ে শিক্ষার্থীদের দিকে তেড়ে যায়। এর আগে গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে একরার হোসেন, তার ভাই কামরুল হোসেন ও ঘনিষ্ট সমর্থক রাজীব হোসেনসহ কয়েকজন অস্ত্র নিয়ে ভোট কেন্দ্র দখল করতে গেলে স্থানীয়রা রুখে দাড়ান। এই দুই ঘটনার অস্ত্র প্রদর্শনের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এলাকাবাসী। আহত শিক্ষক ও এলাকার লোকজন অস্ত্রের মহড়ার ঘটনায় দিরাই থানায় মামলা নিতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ আছে। থানায় মামলা না নেওয়ায় এ ঘটনায় গত ১৩ মার্চ পুলিশ সুপার বরাবর গ্রামবাসী লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন।
এদিকে গত ২৯ মার্চ শুক্রবার জুমআর নামাজের সময় একরার হোসেনের চাচাতো ভাই ফজলু মিয়ার সঙ্গে গ্রামের প্রতিপক্ষের তর্কাতর্কি এবং মাগরিবের নামাজের সময়ও তার ভাতিজার সঙ্গে তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার সময় একরার হোসেনের লোকজন ও গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য সোহেল মিয়ার লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের সময় একরার হোসেনের ভাই ও ভাতিজারা বন্দুকের গুলি ছুড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতরা জানান।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন বন্দুকের গুলিতে প্রতিপক্ষের রফু মিয়া, এওয়ার মিয়া, সমসু মিয়াসহ ৪-৫জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। সংঘর্ষে একরার হোসেন পক্ষের রাজিব হোসেন, সেবুল, সুবাসসহ আরো কয়েকজন ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছেন। আহতরা সিলেট ও জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
পুলিশ সুপার বরাবরে লিখিত অভিযোগকারী হাতিয়া গ্রামের সোনাহর মিয়া বলেন, একরার হোসেনের ভাই সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও পুলিশের তালিকাভুক্ত ক্যাডার ছিল রানা। সেই অস্ত্র এনে এলাকায় বারবার মহড়া দিচ্ছে। থানায় মামলা নিতে গেলে মামলা নেয়না পুলিশ। পরে আমি এলাকাবাসীর পক্ষে গত ১৩ মার্চ পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, বারবার অস্ত্রের মহড়ায় গ্রামবাসী আতঙ্কিত। যে কোন সময় বড় ধরনের কিছু ঘটতে পারে।
অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান একরার হোসেন বলেন, আমি প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী হওয়ায় তারা সবাই আমার পিছনে লেগেছে। শিক্ষকদের তারা উস্কে দিয়েছে। তবে কিছুদিন আগে মানববন্ধনের সময় তার সমর্থক রাজীব হোসেন স্কুলে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এটি প্রকৃত অস্ত্র নয় ‘কাঠের অস্ত্র’। শনিবার তার ভাই ও স্বজনদের বন্দুক নিয়ে হামলায় অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো অস্ত্র নয় পাইপ’। তার বাড়িতে এসে সোহেল মেম্বারের লোকজন হামলা করলে তারা আতœরক্ষায় সংঘর্ষে জড়ায় বলে দাবি করেন তিনি।
দিরাই থানার ওসি (তদন্ত) রতন দেবনাথ বলেন, খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ পাঠিয়েছি। আমরা আজকের ঘটনায় অবশ্যই আইনী ব্যবস্থা নেব। বন্দুকের ছিটাগুলিতে ৩-৪জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানান তিনি।
এর আগে দিরাই সার্কেল এএসপি মো. শহিদুল হক মুন্সি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, একজন শিক্ষককে মারধর করা হয়েছে এমন কোন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ নিয়ে আসেনি। স্কুলে অস্ত্র নিয়ে কেউ মহড়া দিয়েছে বা গত জাতীয় নির্বাচনে অস্ত্রের মহড়া হয়েছে কেন্দ্রে এমন ঘটনাও আমরা অবগত নই। শনিবার তার মোবাইলে একাধিকবার বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।