হাওর ডেস্ক::
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত সব ধরনের মোটরগাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জ বহাল না রাখার প্রস্তাব করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন একের অধিক মোটরগাড়ির ক্ষেত্রে পরিবেশ সারচার্জ প্রযোজ্য থাকছে।
প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের অর্থ বিলে এ সংক্রান্ত সংশোধন আনার কথা বলেছেন রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
একাধিক গাড়ির মালিক হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করার বিধান রেখে সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য অর্থ বিল পাস করেছিল। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের যানবাহন থেকে তা সংগ্রহে বাধার মুখে পড়ছিল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ও করমুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতাও নেই। এ দুই কারণে তাদের পক্ষে যানবাহনের সংখ্যা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে এনবিআরকে দফায় দফায় অবহিত করে বিআরটিএ।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি আমলে নিয়েছে এনবিআর। এবার সংস্থাটি সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি কোম্পানি, ফার্ম ও ট্রাস্টের গাড়িতে পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধের বিধান বাতিল করতে যাচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে সংশোধিত এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (কর আইন) বাপন চন্দ্র দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিদ্যমান আইনে প্রতিষ্ঠান বলতে সকল প্রতিষ্ঠান বোঝালেও বিআরটিএ নানা সময়ে তাদের সংকটের কথা বলেছে। আমাদের কাছে তাদের অনুরোধ ছিল যাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।
“কিন্তু আমরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে বৈষম্য দূর করতে সকল প্রকার প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন যানবাহনের ওপর থেকে পরিবেশ সারচার্জ বাতিলের কথা ভাবছি। তবে অর্থ বিল পাস যেহেতু সংসদের বিষয়, কী হয় সেটি পাস হওয়ার পরই জানা যাবে।”
আগামী শনিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থ বিল পাস করতে সংসদে উপস্থাপন হওয়ার কথা। আর বাজেট পাস হবে পরদিন ৩০ জুন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের ফলে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে। এতে বৈষম্যও তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি করদাতাদের কাছ থেকেও তখন পরিবেশ সারচার্জ আদায় করা কঠিন হবে।
বিআরটিএ ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এনবিআরকে অবহিত করে, পরিবহন নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে যে সফটওয়্যার রয়েছে, সেটি করমুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানাধীন যানবাহনের সংখ্যা শনাক্ত করতে সক্ষম নয়।
সরকার ‘কার্বন কর নীতি’ প্রবর্তন করেছে, যার আওতায় একাধিক মোটর গাড়ির মালিকদের দ্বিতীয় গাড়ি নিবন্ধন বা নবায়নের সময় অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিবেশ সারচার্জ দিতে হয়। ইঞ্জিন ক্ষমতা অর্থাৎ কোন গাড়ি কত সিসির তার ওপর নির্ভর করে এর পরিমাণ কমে বা বাড়ে।
এই সারচার্জ কার্বন নিঃসরণ কমানো, শহরের যানজট নিরসন ও গণপরিবহন ব্যবহারে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে বলে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়।
এ ধরনের সারচার্জ বিআরটিএতে গাড়ির ফিটনেস নবায়নের সময় অগ্রিম আয়কর হিসাবে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ (পিইবি) এর চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে গাড়ির ব্যবহার ও সংখ্যা বৃদ্ধি যৌক্তিক স্তরে রাখতে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে ‘কার্বন কর’ একটি ভালো পদক্ষেপ।
“তবে সরকার পরিবেশ সারচার্জ কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার ফলে কার্বন কর নীতি আর সেভাবে কার্যকর থাকছে না। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে নানাভাবে ( ব্যক্তির গাড়ি কোম্পানির নামে নিবন্ধন করে) কর ফাঁকির সুযোগ তৈরি হবে। বাড়বে বৈষম্যও।”
সরকারের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত এবং অন্তত করপোরেট কোম্পানির মালিকানাধীন যানবাহনের ওপর পরিবেশ সারচার্জ আরোপ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
২০২৩ সালের ৩০ জুলাই বিআরটিএকে চিঠি দিয়ে এনবিআর নির্দেশ দেয়, দ্বিতীয় গাড়ির সব মালিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে সারচার্জ আদায় করতে হবে।
তবে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশন, বিদেশি কূটনীতিক, কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংগঠনের অফিস, উন্নয়ন সহযোগীদের অফিস, এমপিওর আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, গেজেটেড যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার গাড়ির ওপর কোনো কর ধার্য করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ রয়ে গেছে বলে বিআরটিএ গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এনবিআরকে আরও পর্যালোচনা ও সুস্পষ্টকরণের জন্য অনুরোধ করে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের গাড়িতে ‘অগ্রিম কর’ নেই
বিআরটির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মালিকানাধীন যানবাহনগুলোর নিবন্ধনে অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হবে না।
এনবিআর গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের ক্ষেত্রে এআইটি মওকুফের প্রয়োগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলে দেয়, সাত ধরনের প্রতিষ্ঠানের এআইটি মওকুফ হবে, যার মধ্যে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো থাকবে।
চলতি বছরের ৮ এপ্রিল এনবিআর আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের করদাতা নম্বর শনাক্তকরণের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিআরটিএ।
সারচার্জ দিতে হবে কত
সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব হারাতে পারে, তা অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রস্তাবিত বাজেটে গাড়ির শ্রেণি ও সিসি-ভিত্তিক পরিবেশ সারচার্জের নির্ধারণের দিকে তাকালে বোঝা যায়।
মোটর গাড়ি বলতে কী বোঝাবে, তাও সুনির্দিষ্ট করা আছে। বাস, মিনিবাস, কোস্টার, প্রাইম মুভার, ট্রাক, লরি, ট্যাংক লরি, পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য মোটরযান এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
পরিবেশ সারচার্জেও কয়েকটি শর্তের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হল: একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে যে গাড়ির উপর সর্বনিম্ন হারে পরিবেশ সারচার্জ আরোপিত হবে, ওই গাড়ি ছাড়া অন্যান্য গাড়ির বিপরীতে পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়, ১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট পর্যন্ত প্রতিটি মোটর গাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জের হার ২৫ হাজার টাকা।
১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াটের বেশি কিন্তু ২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াটের বেশি নয়, এমন প্রতিটি মোটর গাড়ির জন্য দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা।
২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াটের বেশি কিন্তু ২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াটের বেশি নয়, এমন প্রতিটি মোটর গাড়ির জন্য দিতে হবে ৭৫ হাজার টাকা।
২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াটের বেশি, কিন্তু ৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াটের বেশি নয়, এমন মোটর গাড়ির জন্য দিতে হবে দেড় লাখ টাকা।
৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াটের বেশি, কিন্তু ৩৫০০ সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের বেশি নয়, এমন প্রতিটি মোটর গাড়ির জন্য দিতে হবে দুই লাখ টাকা।
এর চেয়েও বেশি সিসি বা কিলোওয়াট হলে অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের বেশি প্রতিটি মোটর গাড়ির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা সারচার্জ দিতে হবে।