স্টাফ রিপোর্টার::
সদ্যপ্রয়াত দেশবরণ্যে সাংবাদিক ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর নাগরিক শোকসভায় বক্তারা বলেছেন, তিনি আমৃত্যু প্রগতির পক্ষে, অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। একাত্তরের লড়াকু এই যোদ্ধা আমৃত্যু অপরাজেয় বাংলার স্বপ্ন দেখে গেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত তরুণ প্রজন্মকেই সেই অপরাজেয় বাংলা বিনির্মাণ করে সালেহ চৌধুরীর স্বপ্নপূরণ করতে হবে। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর স্মৃতিরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বক্তারা। বক্তারা তার সাংবাদিকতা, একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী আদর্শিক সংগ্রামসহ তার ব্যক্তিজীবনের নানা দিক তুলে ধরেন। অনেকে তার বহুমুখি প্রতিভার কথাও স্মরণ করেন।
সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে এই নাগরিক শোকসভার আয়োজন করে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং জাহাঙ্গীর আলমের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নাগরিক শোকসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ ও সালেহ চৌধুরীর ঘনিষ্টজন মুহিবুর রহমান মানিক।
শোকসভায় বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তা, সংরক্ষিত আসনের সাংসদ শামছুন নাহার বেগম শাহানা রব্বানী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন, নারী নেত্রী শীলা রায়, আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাড. আফতাব উদ্দিন আহমেদ, দোয়ারাবাজার উপজেলার চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক, বিশিষ্ট আইনজীবী হুমায়ুন মঞ্জুর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ পরিমল কান্তি দে, মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, আতম সালেহ, আব্দুল হাসিম, আলী আমজাদ, আবু সুফিয়ান, এ্যাড. আব্দুল মজিদ, নাট্য কর্মী ফজলুল কবির তুহিন, সাংবাদিক পংকজ কান্তি দে, শামস শামীম, এমরানুল হক চৌধুরী। শোকাহত পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন, সালেহ চৌধুরীর বড় ছেলে ইয়াছির আজমান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রয়াত সাংবাদিকের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন।
শোকসভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম. এনামুল কবির ইমন বলেন, একজন মহৎপ্রাণ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন সালেহ চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার নামকরণ করেছিলেন। তিনি অপরাজেয় বাংলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই অপরাজেয় বাংলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই সালেহ চৌধুরীর স্বপ্নপূরণ হবে। অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, প্রখ্যাত সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ছিলেন একজন সৎ মানুষ। তিনি অনেক উচ্চতায় থেকেও কখনো নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেন না। একাত্তরের এই যোদ্ধা একাধারে সাংবাদিক দাবাড়ু, আর্টিস্টও ছিলেন। আমরা থাকে যখনই যে সময় প্রয়োজন কাছে পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, সালেহ চৌধুরী সুনামগঞ্জে কেন্দীয় শহীদ মিনারের নক্সাকার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার শহীদ মিনারের ডিজাইন করে সেগুলোর চেতনাশ্রয়ী নামও তিনি দিয়ে গেছেন। এসব নামেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
অ্যাডভোকেট হুমায়ূন মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, ১৯৯৭ সনে দৈনিক বাংলা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সালেহ চৌধুরী নিষ্টা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করেছেন। এই দৈনিকটি বন্ধ হওয়ার পর অনেক মালিক তাকে সম্পাদক করে পত্রিকা করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা খর্ব হবে ভেবে তিনি কোন পত্রিকার সম্পাদক হতে চাননি। তিনি আজীবন দেশের পক্ষেই ছিলেন।
সুনামগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ ড. জয়া সেনগুপ্তা বলেন, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন আমাদের সালেহ ভাই। তিনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। সুরঞ্জিতের প্রতিটি নির্বাচনে তিনি তার পেশা ও পরিবার ছেড়ে এসে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি লেখালেখিতেই ছিলেন। জাতিগঠনমূলক লেখাগুলো আমাদের প্রেরণা ছিল। আমরা তাঁর কাছে ঋণি। তার স্মৃতিরক্ষায় আমি অবশ্যই উদ্যোগ নেব।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই আমি সালেহ ভাইর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। দৈনিক বাংলায় প্রেসরিলিজের ছুতোয় তার সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম। বিচিত্রায়ও অনেক আড্ডায় জড়ো হয়েছি। তিনি বলেন, ৭৫ সনের পরে মুক্তিযোদ্ধারা যখন সামরিক সরকারের ভয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলতো তখনও সালেহ চৌধুরী গর্ব করে তার সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করতেন। সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করে নতুন প্রজন্মকে কিভাবে মুুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবিত করা যায় সেই চেষ্টাই করেছেন। আমাদের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোয় প্রেরণামূলক নক্সা করে সেগুলোর নামকরণ করেছেন তিনি।
পরিবারের পক্ষে সালেহ চৌধুরীর বড় ছেলে ইয়াছির আজমান চৌধুরী বাবার স্মৃতিচারণ করতে এসে বলেন, বাবার অনেক কথা আপনারা বলেছেন। কিন্তু দুটো বিষয় সবসময় আমাদের গর্ব করে বলতেন বাবা। জাতির জনকের নেতৃত্বে ৬দফার যে খসড়াপত্র তৈরি করা হয়েছিল তা গোপনীয়ভাবে পত্রিকায় ছাপানোর জন্য নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক হিসেবে বাবার কাছে এসেছিল। তিনি ঝূকি নিয়ে সেটি প্রচার করেছিলেন। দ্বিতীয়টি হলো সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উত্তরাঞ্চল ঘুরে বেড়ানো। আসার সময় একই লঞ্চে পাশাপাশি কামড়ায় ছিলেন বাবা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মধ্যরাতে তিনি দেখেন রাতের নদী দেখছেন বঙ্গবন্ধু। বাবাকে লঞ্চের বাইরে দেখে তিনি ডেকে বললেন সফরে কি দেখলেন। তখন বাবা বলেছিলেন সব ঠিক আছে, তবে মওলানাকে বাগে আনতে হবে। তিনি বলেছিলেন, চিন্তা করবেননা, তাকে ম্যানেজ করবই। নির্বাচনের পরে বাবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হলে বাবার পেটে আঙ্গুলের খোঁচা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মওলানাকে বাগে আনতে পেরেছিলামতো?
তিনি আরো বলেন, বাবা নিজের ভাতার টাকায় তার সহযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ করে গেছেন। আরো দুটি সংরক্ষণের কাজ শেষ পর্যায়ে ছিল। সেগুলো তার উদ্বোধন করার কথা। কিন্তু তিনি করে যেতে পারেননি। আমরা বাবার দেখানো প্রগতির পথেই চলব। তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে সকলের সহযোগিতা চান তিনি।