গণমাধ্যমে দখলকৃত খালের খবর করতে গিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে, ‘দখলে বেহাল ৭ খাল’। শিরোনামের নিচে লেখা হয়েছে, “আদালতের নির্দেশে সুনামগঞ্জের সাতটি খালের বেশিরভাগ অংশ স্থানীয় প্রশাসন ইতোপূর্বে দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার করলেও আবারও খালগুলো দখল হতে চলেছে। অন্যদিকে, অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় খালগুলো জীবন্ত করতে পারছে না কতৃর্পক্ষ। সব মিলিয়ে দ্রুত খালগুলোকে জীবন্ত না করলে ভূমিখেকোরা সরকারি এসব খালে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন সকলে। মঙ্গলবার [২৬ নভেম্বর ২০২৪] জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শহরের নানা পেশার মানুষজনসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় এসব খাল উচ্ছেদ করে জীবন্ত করার উদ্যোগ না নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি অবিলম্বে খাল উদ্ধার এবং সচল করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবারও নির্দেশ দেন। পৌর কর্তৃপক্ষ অবশ্য অর্থ বরাদ্দের জন্য বাকি কাজ হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন।” খালের বাস্তব অবস্থাটা জানা গেলো। পৌরসভা টাকার অভাবে কাজ করতে পারছেন না বলে জানালেন। জানা গেলো আদাললেতর রায় উপেক্ষিত হওয়ার কথা। জানা গেলো ক্ষুব্ধ হয়েছেন উপদেষ্টা। এতে পৌরসভার কোনও দোষ দেখি না। ‘যতো দোষ নন্দ ঘোষ’ বলে পৌরসভাকে দোষলেই পৌরবাসীর বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের দায় স্খালন হয়ে যায় না। কাজ করতে গেলে টাকার অবশ্যই দরকার আছে। সংশ্লিষ্ট তরফ থেকে টাকার বরাদ্দ না পেলে কাজ এমনি এমনি হয়ে যাবে না। তাছাড়া বরাদ্দকৃত টাকা নয়ছয় হওয়ারও আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি টাকা বরাদ্দের আবেদনই হয় তো করা হয় নি। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের যে যেখানে বসে আছেন প্রত্যেকেই একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা নন। সমাজোন্নয়নের কাজে উপেক্ষার সংস্কৃতি থেকে তাঁরা এখনও বেরিয়ে আসতে পারেন নি। আসলে তাঁদেরও টাকা পয়সার দরকার আছে। তাঁরা নয়ছয় করতেই পারেন। প্রকারান্তরে বা ঘুরেফিরে প্রতিপন্ন হয় যে, এই নয় ছয় তাঁরা করেন জনসমাজের সঙ্গেই। পৌরসভায় যাঁরা বসেন তাঁরা জনগণের ভোটের কাঙাল। তাঁরা ভোট শিকারের ধান্দায় থেকে প্রায়ই পৌরবাসীর অন্যায় আবদার পূরণ করতে কসুর করেন না। তাঁরা পৌরসভার পুকুরের সংকীর্ণ পাড় পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণের জন্যে অবলীলায় বরাদ্দ দিয়ে দেন এবং যথারীতি বরাদ্দের বেশি জায়গা দখল করে পুকুর দখলে কার্পণ্য পরিলক্ষিত হয় না। কেউ কেউ পুকুরের জায়গা দখল করে বসতভিটার বহর বাড়িয়ে নেন। পৌরকতৃপক্ষ দেখেও দেখেন না। শহরের কেন্দ্রস্থলের কালীবাড়ি পুকুর এমনি করে দখল হয়ে যাচ্ছে। যেতে আসতে সকলেই দেখছেন। কেউ কীছু কলছেন না, করছেন না। কার ঘাড়ে কটা মাথা মাঝে আছে। ব্যক্তিগতভাবে কারও শত্রু হওয়ার উটকো ঝামেলা কেউ ঘাড়ে নিতে চান না। পৌরসভার জনসমাজের অবস্থা এমনটাই। বিভিন্ন অনিয়ম তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করেন এবং নিজেরা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণের সুযোগ খোঁজেন। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ অবস্থায় পড়া সামাজিক বাস্তবতায় খাল উদ্ধার কোনও সহজ কাজ নয়। ইতোমধ্যে দুই বার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আদালতের নির্দেশে সুনামগঞ্জের সাতটি খালের বেশিরভাগ অংশ স্থানীয় প্রশাসন ইতোপূর্বে দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার করলেও আবারও খালগুলো দখল হতে চলেছে।” কথাটা তো মিথ্যে নয়। তিন নল উদ্ধার করে মাঝখানে এক নল ছাড় দিয়ে উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করাকে কোনও বিবেচনায়ই উদ্ধার করা হয়ে গেছে বলা যায় না, বরং এমন হলেই লোকে বলে ‘যেই লাউ সেই কদু’। উদ্ধার করার পর সংরক্ষণের দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রশাসনিক সংস্কৃতির এই ফাঁকিকে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ফাঁকির বিচার চাই। যাতে ফাঁকি না দেওয়া হয়, তার নিশ্চয়তা চাই। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সরকারের জায়গা কেন কোনও ব্যক্তি দখল করে নেবেন? খাল কেন দখল করে নেবেন খালপাড়ের মানুষেরা। এমন দখলবাজ মানসিকতা কেন মানুষের হবে। এই রকম মানসিকতার মানুষকে কি আসলেই ভালো মানুষ বলা যায়? পৌরসভায় এমন অসংস্কৃত মানসিকতার মানুষকে রাজনীতিক সমাজ কেনই বা পাত্তা দেবে? সমাজসাংস্থিতিক অবস্থাটা এমন যে, আসলে জনসমাজের এই দখলবাজরাই সমাজ পরিচালনা করে, সমাজে তারাই প্রভাবশালী ও ধনের অধিকারী হয়। এই শহরে সরকারি স্থাপনা দখলকারি মানুষ খোঁজলে পাওয়া যাবে না এমন নয়। সকলেই তাঁকে জানেন এবং চেনেন। তিনি কী করেছেন তাও জানেন। কিন্তু কেউ কীছু বলেন না। সরকারও তার নিজের জায়গা ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়, সরকারের কর্মচারীরা সরকারের বেতন খেয়ে ব্যক্তি বিশেষের গোলামি করে দু পয়সা বাড়তি কামিয়ে নেয়। এই গোলামির অপরাধের কোনও বিচার হয় না। এমতাবস্থায় করণীয় কী? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের কাছে বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতার সাপেক্ষে কোনও সদুত্তর নেই। বরং বলা ভালো যে, সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর সমাজসাংস্থিতিক বাস্তবতায় এবংবিধ দখল চলতেই থাকবে। হতে পারে তা খাল, নদী, বিল, চর, মাঠ অথবা কোনও সরকারি বাসাবাড়ি কিংবা খোদ পৌরসভার রাস্তা। এই ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’ অবস্থা থেকে বেরোনো যাবে না, যদি রাষ্ট্র পক্ষ থেকে সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানা বাতিল করা না হয়। অর্থাৎ খাল দখল হবেই। দখলকৃত খাল জীবন্ত করার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ খালে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। কামারখালির কথাই ধরা যাক। কমারখালি খালে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার অর্থ হলো, খালটি উদ্ধার ও তার পানিপ্রবাহের নিশ্চিয়তা বিধান। মনে হচ্ছে ‘ন মণ ঘিও হবে না, রাধাও নাচবে না’।