বিশেষ প্রতিনিধি::
জীববিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স পড়–য়া কলেজ ছাত্রী মেয়ের নিয়মিত ক্লাস না হওয়ার প্রতিবাদে আড়াই ঘন্টা জেলা প্রশাসকের অফিসের দরোজার সামনের ফ্লোরে বসে অনশ করেছেন এক মুক্তিযোদ্ধা বাবা। বৃহষ্পতিবার সকাল ৯টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত এই ব্যতিক্রমধর্মী অনশ করেন তিনি। এই সময়ে জেলা প্রশাসকের অধীনস্থ কর্মকর্তারা তার অনশন ভাঙ্গানোর অনুরোধ জানিয়ে অফিসে এসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আহ্বান জানালেও তিনি অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। পরে জরুরি কাজ ফেলে জেলা প্রশাসক ছুটে এসে তার অনশন ভাঙ্গিয়ে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
জানা গেছে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের তেঘরিয়া পীরবাড়ি এলাকার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরের মেয়ে সানজিদা আক্তার সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলে মুক্তিযোদ্ধা বাবা জানতে পারেন ‘ইংরেজি নন ক্রেডিক ও রসায়ন’ বিষয়ে নিয়মিত পাঠদান না হওয়ায় এই দুটি বিষয়ে মেয়ের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। নিয়মিত ক্লাস করার পরও কেন পরীক্ষা খারাপ হলো জানতে চাইলে মেয়ে তাকে জানায় ‘ইংরেজি নন ক্রেডিক কম্পোলসারি’ বিষয়ে কোন ক্লাস হয়নি। ‘রসায়ন’ বিষয়েও গোটা কয়েকটি ক্লাস হয়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মেয়েকে ইংরেজি ও রসায়ন প্রাইভেট পড়াতে না পারায় এ বিষয়টি মালেক হুসেন পীরকে পীড়া দেয় এবং মেয়ে নিয়মিত কলেজে গেলেও কেন এই দুটি বিষয়ে ক্লাস হয়না এ নিয়ে ক্ষুব্দ হন তিনি। বৃহষ্পতিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামের অফিসের দরোজার সামনে ফ্লোরে বসে ব্যতিক্রমী অনশন শুরু করেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে প্রশাসকের কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাকে অনশনের কারণ জানতে চেয়ে অফিসে এসে কথা বলার অনুরোধ জানালেও তিনি জেলা প্রশাসক ছাড়া কারো সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে তাদের সাফ জানিয়ে দেন।
বৃহষ্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায় পাকা ফ্লোরে একটি ফাইল হাতে বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর। শীতের মধ্যেই পাকা ফ্লোরে একটি হাফহাতার শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়ে প্লোসে বসেছিলেন তিনি। এই প্রতিবেদক ও তার বাল্যবন্ধু ও সহযোদ্ধা আবু সুফিয়ান এর কারণ জিজ্ঞেস করলেও তিনি তখন কোন উত্তর দেননি। এই সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিসের দরোজায় ‘জেলা প্রশাসক বাইরে আছেন’ প্ল্যাকার্ড ঝূলছিল। জানা গেছে জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম একটি উপজেলায় অফিসের রুটিন কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই খবরে খবর পেয়ে প্রায় বেলা সাড়ে ১১টায় অফিসে আসেন জেলা প্রশাসক। তিনি মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরের হাত ধরে তাকে অনুরোধ জানিয়ে তার অফিস রুমে নিয়ে কথা শোনেন। এসময় জেলা প্রশাসককে মালেক হুসেন পীর পুরো ঘটনা খুলে বলেন। জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধার মুখ থেকে বিষয়টি শোনার পর তাকে এ বিষয়ে লিখিত আবেদন করার অনুরোধ জানান। পাশাপাশি এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর বলেন, আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া চলার অন্য কোন অবলম্বন নেই। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এই ভাতার টাকায়ই চলি। এ থেকেই স্কুল পড়–য়া ছেলে ও কলেজ পড়–য়া মেয়ের পড়ালেখার খরচও বহন করছি। উদ্ভিদবিদ্যায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমার মেয়ে নিয়মিত কলেজে ক্লাসও করে। কখনো সাধারণত সে ক্লাস ফাকি দেয়না। কিন্তু ইংরেজি ও রসায়ন বিষয়ে কোন ক্লাস হয়না। ক্লাস না হওয়ায় আমার মেয়ের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এ বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় ও ক্ষুব্দ করে। তাই প্রতিবাদে এই অনশন করেছি। জেলা প্রশাসক আমাকে লিখিত আবেদন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে তিনি বিশেষ ভাবে অবগত করবেন।
জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর আমার কার্যালয়ের দরোজার সামনে কিছুক্ষণ অনশন পালন করেছেন। আমার কর্মকর্তারা আমার অনুপস্থিতিতে তাকে অনশন ভঙ্গ করে অফিসে বসে বিষয়টি খুলে বলার আহ্বান জানালেও তিনি আমাকে ছাড়া কাউকে বলবেননা বলে অফিসারদের জানিয়ে দেন। আমি খবর পাওয়ার পরপরই ছুটে এসে অনুরোধ করে অনশন ভঙ্গের বিষয়টি তাকে অফিসে বসিয়ে শুনেছি। রসায়ন ও ইংরেজি বিভাগে ক্লস না হওয়ায় তার অনার্স পড়–য়া মেয়ের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলে তিনি অবগত করেছেন। আমরা এ বিষয়ে খোজ খবর নিব। পাশাপাশি তিনি লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাব।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুস সাত্তার বলেন, কলেজে ইংরেজি বিভাগে আমাদের একাধিক শিক্ষক রয়েছেন। নিয়মিত ক্লাসও হয়। তবে রসায়ন বিভাগে শিক্ষক কম। ক্লাস না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্লাস হয়নি কেউ আমাদের কখনো অবগত করেনি। শিক্ষকরা ক্লাস না করলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তিনি আরো বলেন, আমার কলেজে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। এর মধ্যে মহিলা কলেজে ৫ জন শিক্ষককে যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস নিতে অনেক সমস্যা হচ্ছে।
উল্লেখ্য ৫নং সেক্টরের বালাট সাব সেক্টরের প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর। নিজের জমিজমা বিক্রি করে তিনি জনস্বার্থে বিভিন্ন বিষয়ে মামলা করে ন্যায় প্রতিষ্টার সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছেন। তার মামলার প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সহকারি কমিশনার, সিভিল সার্জন সিলেটের বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ অনেকে জেল খেটেছে।