ডা. এম. নূরুল ইসলাম::
গত কয়েকমাস যাবত পুরো সুনামগঞ্জ জেলার বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর মানুষজন যাদের ঘরে গৃহপালিত পশু যেমন গরু/ছাগল/ভেড়া আছে, তারা একটি আতঙ্কের মধ্যে আছে। আর তা হলো, শিয়াল/কুকুড়ের কামড়ের ভয়! জলাতঙ্ক রোগের ভয়!
কারন ইতোমধ্যে অনেক কৃষকের গৃহপালিত পশু শিয়ালের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এবং অনেকে বাধ্য হয়ে ভয়ে শিয়ালের কামড়ে আক্রান্ত পশুটিকে মেরে মাটিতে পুতে ফেলছেন। শুধু কি তাই? অনেক জায়গায় মানুষজনও পাগলা শিয়াল/কুকুড়ের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন।
গতো শুক্রবারে আমার খুব পরিচিত এক চিকিৎসক এক রোগিকে জলাতঙ্ক রোগ সন্দেহে সিলেটের সংক্রামক হাসপাতালে পাঠালে, সেখানেও তাকে জলাতঙ্ক রোগি হিসেবে রোগ নির্ণীত হয়। তিনি কোন রকম প্রটেকশন ছাড়া রোগির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়, ভয়ে বাধ্য হয়ে নিজেই প্রফাইলেক্সিস টীকা নেয়া শুরু করেন।
পুরো ব্যাপারটি আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্য ও সাধারন মানুষের প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রাকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করছে। চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে অনেকে মোবাইল কল করে পরামর্শ নেয়ার চেষ্টা করছেন, অনেকে এ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কিছু লেখার জন্য আহবান জানিয়েছেন। আজকের লেখাটি মূলত সে জন্যেই।
জলাতঙ্ক কি?
জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়া চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় যা ‘জধনবং’ হিসেবে পরিচিত, একটি ভাইরাস জনিত রোগ। ল্যাটিন শব্দ ‘জধনবং’ এর অর্থ ‘পাগলামী করা’।
কাদের মাধ্যমে ছড়ায়?
‘জধনবং’ ভাইরাসটির সাধারণ বাহক হলো কুকুড়, শিয়াল, ইঁদুর, বিড়াল, চিকা, বাদুড়, বানর, বেজি ইত্যাদি। অর্থ্যাৎ এসব প্রাণী যদি উক্ত ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় কিংবা বাহক হয় তবে তাদের কামড়/আচঁড় দ্বারা জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে।
কিভাবে শরীরে প্রবেশ করে?
সাধারনত এসব প্রাণীর লালারসের মাধ্যমে নতুন/পুরাত ক্ষত যেমন কামড়/আচঁড়ের মাধ্যমে যদি উক্ত ‘জধনবং’ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তের সংস্পর্শ আসলে জলাতঙ্ক রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি/প্রাণীর ধীরে ধীরে অনেকগুলো উপসর্গ দেখা দেয়। তন্মধ্যে প্রধানতম উপসর্গ হলো আক্রান্তকারী পানি দেখলেই ভয় পায়। পানি খাওয়া বা পান করার সময় খাদ্যনালীর উপরের অংশের মাংশপেশীর অসহনীয় মারাতœক সংকোচন হয়, যা তাকে পানি আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলে। মূলত এ থেকেই এর নামকরণ ‘জলাতঙ্ক’।
এ রোগ থেকে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কতো?
মূলত একবার কেউ যদি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়, তার আর বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। অর্থ্যাৎ এ রোগের মৃত্যুর হার প্রায় ১০০%।
বাঁচার উপায় কি?
বাঁচার উপায় হচ্ছে ভ্যাক্সিনেসন বা টীকা। অর্থ্যাৎ কুকুড়/শিয়াল/বিড়াল/ইদুঁর/বাদুড়/চিকা/বানর ইত্যাদি প্রাণী দ্বারা কামড়/আঁচড়ের শিকার কাল বিলম্ব না করে যা করবেন-
১) আক্রান্ত স্থান সাবান/এন্টিসেপটিক দিয়ে ভালো করে ধূয়ে ফেলুন।
২) আক্রান্ত স্থান খোলা রাখুন।
৩) তাৎক্ষণিক নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্র/চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে টীকা গ্রহণ করুন। এ ক্ষেত্রে মোট ৬ বার টীকাগ্রহণ করতে হবে। সময় গণনা শুরু করতে হবে যেদিন প্রথম টীকা দেয়া হবে সেদিন থেকেই। টীকা প্রদানের দিনগুলো হলো-
পথম টীকা—-০দিন অর্থ্যাৎ প্রথমদিন
দ্বিতীয় টীকি—৩য়দিন
তুতীয় টীকা—-৭তম দিন
চতুর্থ টীকা ——-১৪ তম দিন
পঞ্চম টীকা——-৩০তম দিনে
ষষ্ঠ টীকা———-৯০তম দিনে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে একমাত্র টীকা/ভ্যাক্সিনই পারে মরণঘ্যাতি জলাতঙ্ক রোগ থেকে বাঁচাতে। অর্থ্যাৎ নিয়ম মেনে সঠিক সময়ে যদি টীকা নেয়া যায় তাহলে এ রোগ হবার সম্ভাবনা আর থাকে না।
প্রতিটি জেলাতেই সিভিল সার্জন মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ টীকা প্রদান করা হয়।
গ্রামে-গঞ্জে কুকুড়ের কামড় নিয়ে যে সমস্ত কুসংস্কার আছে তাতে কর্ণপাত না করে আক্রান্ত ব্যাক্তি সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে জলাতঙ্ক রোগ থেকে বাঁচতে টীকা নিন। কারন এ রোগে একবার কেউ আক্রান্ত হলে বাঁচার আর কিন্তু কোন পথ থাকে না!
লেখক: বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে কর্মরত। সুনামগঞ্জ বিএমএ’র সেক্রেটারি।