: মুহম্মদ জাফর ইকবাল :
আর কত দিন এই ভাঙা রেকর্ড?
আজকে আমার একজন সহকর্মী তাঁর স্মার্টফোনে আমাকে একটি ভিডিও দেখিয়েছেন। আমি আমার জীবনে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক কোনো ভিডিও দেখেছি বলে মনে করতে পারি না।
ভিডিওটি একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর, ছেলেটি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলছে, সে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের উত্তরও সে পেয়ে গেছে। কিন্তু সেই উত্তরে বেশ কয়েকটি ভুল ছিল। ক্ষুব্ধ ছাত্রটি বলছে, কেন ভুল উত্তর সরবরাহ করে তাদের এভাবে উত্ত্যক্ত করা হয়?
যেকোনো হিসাবে এটিকে খুবই মজার একটি কৌতুক হিসেবে বিবেচনা করার কথা ছিল; কিন্তু আমি এই ভিডিও দেখে বিন্দুমাত্র কৌতুক অনুভব করিনি। আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করেছি। আমাদের দেশে আমরা নতুন একটি তরুণ প্রজন্ম তৈরি করেছি, যারা সাংবাদিকদের বলতে সংকোচ বোধ করে না যে তারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে। সেই প্রশ্নের উত্তর সরবরাহকারীদের ওপর তারা ক্ষুব্ধ হয়, যদি তারা উত্তরে ভুল করে। আমাদের এই নতুন প্রজন্ম ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।
এ রকম আগে ছিল না, এ রকম হয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দায়ী। আমরা হাতে ধরে এ রকম একটি প্রজন্ম তৈরি করেছি।
যদি এ দেশে প্রশ্ন ফাঁস না হতো, তাহলে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এ রকম হয়ে যেত না।
কাজেই আমি খুবই অসহায় বোধ করি যখন দেখি এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা বলেন, প্রশ্ন ফাঁস নতুন কিছু নয়, আগেও প্রশ্ন ফাঁস হতো। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সরকারের একটি দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টামাত্র। আমি এটিকে মোটেও ছোট একটি বিষয় হিসেবে দেখতে পারি না। আমার কাছে এটিকে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো মনে হয়, মহামারি প্লেগের মতো মনে হয়। প্রশ্ন ফাঁস আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটি অর্থহীন করে দিয়েছে। একটি ছেলে বা মেয়ের জিপিএ ৫ কথাটির অর্থ কী, আমরা জানি না। আসলেই সে ভালো একজন ছাত্র বা ছাত্রী হতে পারে কিংবা সে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া একজন অসৎ অভিভাবকের অসৎ সন্তান, অসৎ শিক্ষকের অসৎ ছাত্র হতে পারে! তুলনামূলকভাবে খারাপ গ্রেডের একজন ছাত্র বা ছাত্রী হয়তো আসলে একজন সোনার টুকরা ছেলে বা মেয়ে। তার চারপাশে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখেও সে প্রলোভনে পা দেয়নি, সৎ থেকেছে, মা-বাবার বকুনি খেয়েছে, বন্ধুদের হাসির পাত্র হয়েছে। কে এই প্রশ্নের জবাব দেবে?
শুধু কি তাই? পরীক্ষার নম্বর দিয়ে ছেলে-মেয়েদের কলেজ ঠিক করে দেওয়া হয়। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেওয়া ছেলে-মেয়েরা ভালো ভালো কলেজের সিটগুলো দখল করে নেবে। আমাদের সোনার টুকরা ছেলে-মেয়েরা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা তাদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান না, আমি শুনতে পাই।
আগে প্রশ্ন ফাঁস হতো কি না আমরা জানি না, যদি হতো অবশ্যই সেটি খুবই খারাপ একটি ব্যাপার হতো। কিন্তু আগে প্রশ্ন ফাঁস হতো বলে এখন প্রশ্ন ফাঁস হওয়াটি মেনে নিতে হবে—এটি নিশ্চয়ই একটি যুক্তি হতে পারে না। আগে এ দেশে রাজাকাররা গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়াত বলে এখনো তারা গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরবে, সেই কথাটি তো আমরা কখনো বলি না। খুঁটিনাটি না জেনেও শুধু কমনসেন্স দিয়ে অনেক কিছু বোঝা যায়। আগে প্রশ্ন ফাঁস করতে হলে কাউকে না কাউকে পুরো প্রশ্নটির একটি কপি জোগাড় করতে হতো, এখন তার দরকার হয় না। একটি প্রশ্নকে মাত্র এক ঝলক দেখার সুযোগ পেতে হয়, চোখের পলকে প্রায় অদৃশ্য একটি ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুলে নিয়ে আসা যায়। আমি নিজের কৌতূহলে পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানো এবং বিতরণ করার পুরো প্রক্রিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। আমি জানি, অনেক মানুষ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা অকারণে ও অপ্রয়োজনে এই প্রশ্নে হাত বোলানোর সুযোগ পায়। কাজেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরের একটি বিষয় নয়। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মাত্র একজন অসৎ মানুষের প্রয়োজন, যে এক ঝলক প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেলে সম্ভবত কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলতে পারে।
এখানে একটি কৌতূহলের বিষয় বলা যায়। আমি জানতে পেরেছি, বেশ কিছুদিন আগে একটি সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে বিজি প্রেসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়-সম্পত্তির খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল। (বিজি প্রেস হচ্ছে সেই প্রেস, যেখানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইত্যাদি গোপন কাগজপত্র ছাপানো হয়)। এই প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়-সম্পত্তি বা ব্যাংক ব্যালান্সের খোঁজখবর নেওয়ার উদ্দেশ্য খুবই সহজ, কেউ হঠাৎ করে বাড়াবাড়ি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে কি না, হঠাৎ করে কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে কি না, সেটি খুঁজে বের করা। যদি এ রকম কিছু দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে ‘ডাল মে কুচ কালা হায়। ’
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় তদন্তটি হঠাৎ করে ‘ওপরের’ আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই বিজি প্রেসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ উপায়ে বড়লোক হতে শুরু করেছে কি না, সেটি জানার আর কোনো উপায় থাকল না। আমি যেটি জানতে পেরেছি তার মধ্যে কতটুকু সত্যতা আছে জানা দরকার। কারণ এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে। ‘ওপরের’ আদেশটি কত ওপর থেকে এসেছে আমি সেটিও জানতে খুবই আগ্রহী।
একটা সময় ছিল, যখন কোনোভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করতে রাজি হয়নি যে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমি তখন অসহায় বোধ করেছি। কারণ আমি জানি, একটি সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমে সমস্যাটি বুঝতে হয়। যদি সমস্যা আছে সেটি মেনেই নেওয়া না হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান করা হবে কেমন করে? শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, এখন সবাই জানে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। সেটি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, হাইকোর্ট থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করার ব্যাপারে সুপারিশ দেওয়ার জন্য দুটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি দুটির একটির দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। ২০১৪ সালে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য আমি যখন শহীদ মিনারে বৃষ্টির মধ্যে বসেছিলাম তখন আমার সঙ্গে সারা বাংলাদেশের একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন, তিনি অধ্যাপক কায়কোবাদ! কাজেই আমি নিশ্চিতভাবে জানি, প্রশ্ন ফাঁসের এই অভিশাপ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে আন্তরিক মানুষটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। আমি অনুমান করতে পারি এই কমিটি নিশ্চয়ই কোনো কিছু ধামাচাপা দেবে না, সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করবে এবং নিশ্চিতভাবে একটি সমাধান খুঁজে বের করবে।
প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটি যখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি তখন সেটি বন্ধ করার এক ধরনের আয়োজন শুরু হয়েছে। তবে আয়োজনটি ‘প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ’ করার জন্য নয়, আয়োজনটি ফাঁস হয়ে যাওয়া ‘প্রশ্ন বিতরণ’ বন্ধ করার জন্য। আমরা যদি ধরে নিই প্রশ্ন ফাঁস আমরা বন্ধ করতে পারব না, সেটি হতেই হবে, আমরা শুধু এর বিতরণটি বন্ধ করব, তাহলে বুঝতে হবে আমরা প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের যুদ্ধে আগেই পরাজয় স্বীকার করে বসে আছি। আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই যে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব নয়, অবশ্যই সম্ভব—শুধু সেটি আন্তরিকভাবে চাইতে হবে। যদি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা যায়, তাহলে তার বিতরণ বন্ধ করার জন্য আলাদা করে নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে হবে না। যে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সেটি বিতরণ করবে কেমন করে?
যারা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে তারা মোটামুটিভাবে তার একটি প্যাটার্ন লক্ষ করে আসছে। মূল প্রশ্নটি অনেক আগেই ফাঁস হয়, সেটি ধাপে ধাপে বিতরণ করা হয়। যখন পরীক্ষা প্রায় শুরু হতে যাচ্ছে তখন বিনা মূল্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। একেবারে শেষ ধাপে যখন এটি খুচরা হিসেবে বিতরণ করা হয় তখন তাদের কাউকে কাউকে ধরা হয়েছে; কিন্তু তারা নেহাতই চুনোপুঁটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছিল, প্রশ্ন ফাঁসকারীকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারলে তাকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। অনেককেই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে (এর মধ্যে বাসবোঝাই এসএসসি পরীক্ষার্থীও আছে), তাদের কয়জনের ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কে জানে।
প্রশ্ন ফাঁসকারী চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তার করেছেন—এ রকম একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে নতুন একটি তথ্য দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসের এই রমরমা ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিকাশ। বিকাশে টাকা পাঠানোর পুরো ব্যাপারটি যেহেতু পানির মতো সোজা, তাই এটি অপরাধীচক্রের সবচেয়ে প্রিয় পদ্ধতি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এ রকম একটি পদ্ধতিতে টাকা পাঠানো হলে কে পাঠাচ্ছে এবং কার কাছে পাঠাচ্ছে তার একটি হদিস থাকবে। কিন্তু আমি সবিস্ময়ে ও মহা আতঙ্কে আবিষ্কার করেছি সেটি সত্যি নয়। কোনো রকম নিয়ম-নীতি না মেনে বিকাশে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলা সম্ভব এবং সেই অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনও সম্ভব। যে বড় পুলিশ অফিসারটির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তিনি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, এই বিকাশ প্রযুক্তির কারণে কিডন্যাপিং অনেক বেড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, যে প্রযুক্তি অপরাধীদের টাকা লেনদেনে সাহায্য করে, আমাদের দেশ কি সেই প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়েছে?
আমি কখনো বিকাশ ব্যবহার করে টাকা পাঠাইনি। তাই এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি কিছু জানি না; কিন্তু সহজ প্রশ্নটি তো করতেই পারি। যদি এই প্রক্রিয়ায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে টাকা লেনদেন করতে পারে, তাহলে তার দায়দায়িত্ব কি বিকাশকে নিতে হবে না?
আবার প্রশ্ন ফাঁসের মূল ব্যাপারটিতে ফিরে আসি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, একটি প্রশ্ন পুরোপুরি এবং অন্যগুলো আংশিক ফাঁস হয়েছে। যেগুলো ফাঁস হয়েছে সেগুলোর পরীক্ষা কি আবার নেওয়া হবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, যদি নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হয় তার প্রশ্ন আর ফাঁস হবে না? যদি হয় তখন কী হবে?
আমি আমার ভাঙা রেকর্ড বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আর কত দিন?
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।