হিরণ্ময় রায়:
ইদানিং না শুনতে চাইলেও, একটি কথা প্রায়ই শুনতে হয় সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা নিয়ে। বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রতি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের উষ্মা প্রায় প্রতিহিংসায় রূপ নিয়েছে। কথাচ্ছলে চাকুরি প্রার্থীদের ভিড়ে মিশে গিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে চাকুরি প্রত্যাশীদের মনে একরকম ক্রোধের জন্ম দিচ্ছে এই বিশেষ শ্রেণীর লোকেরা। এদের নিয়ে একটু চিন্তা করলে বা এদের পরিচয় খোজঁ করলে দেখা যাবে এরা সুনির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠিভুক্ত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সাংস্কৃতিক প্রতিবিপ্লবের হাত ধরে রাজনীতি, বাণিজ্য, সরকারি দপ্তরগুলোতে এরা ঝেকে বসে ডালপালা ছড়ায়। দীর্ঘ একুশ বছরে ক্ষমতার অংশ হয়ে এদের শিকড় অনেক দূর ছড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দল এবং এর নেত্রীর অকল্পনীয় ত্যাগ, সংগ্রামের পর যখন আবারও এদেশে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় বসে, তখন অনেক জনকল্যাণকামী সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও, প্রশাসনের স্তরে স্তরে বসে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি হোচট খায় পাঁচ বছরের মাথায়। কোন কারন ছাড়াই। দলটির কার্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরত আসলে, প্রতিক্রিয়াশীলদের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে আশংখায় দলটির মূল নেতৃত্বকে চিরতরে সড়িয়ে দিতে চলে নৃশংস হামলা। নেতাকর্মিদের উপর নেমে আসে নজিরবিহীন ভয়াবহ নির্যাতন। এরপরও সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে দলটি ক্ষমতায় ফিরে। দলটি ক্ষমতায় ফিরে সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭৫ পরবর্তীতে রাষ্ট্রযন্ত্রে উপেক্ষিত প্রায় হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ সপক্ষ শক্তিকে ফেরাতে সরকারি চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করে। এতে মর্মে আঘাত লাগে প্রতিক্রিয়াশীলদের। কারণ প্রতিবিপ্লবের সবচেয়ে বড় জবাব এই সিদ্ধান্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা রাষ্ট্রযন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজ বপন করলে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ক্ষত সারতে শুরু করবে। এতে স্বার্থে আঘাত পড়বে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় মিত্রদের। তাই সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র হননের পাশাপাশি চলছে চাকুরি প্রত্যাশী বেকার শিক্ষিত যুবসমাজের মনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী নেতিবাচক প্রচারণা। কিন্তু যদি আমরা একটু ভাবি, তাহলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রে বসলে সামগ্রিক ভাবে দেশ ও জনগণের কল্যাণ সাধন হবে। কারণ তাঁরা তাদের পিতার আদর্শে উজ্জীবিত থাকলে তাদের পিতাদের অর্জিত এই স্বাধীন ভূখন্ডের কোন ক্ষতি করবে না। বরং দেশের উন্নয়নে তাদের থাকবে গভীর মমত্ববোধ। আমরা চারপাশে তাকালে যেসব উচ্চবিত্তদের দেখতে পাই, যেসব প্রাসাদোপম বাড়ি, উচ্চমূল্যের গাড়ি, বিপনিবিতান, ব্যবসায়ী বা ঠিকাদার দেখতে পাই, তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা নেই বললেই চলে। যাদের ত্যাগ ও রক্তে স্বাধীন এই দেশ, তারাই আজ সমাজে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত, কতক ক্ষেত্রে নি:স্ব। অথচ দেশবিরোধী শক্তিরা দেশের ভিতরে গড়ে তোলেছে বিকল্প অর্থনীতি, বিত্তের পাহাড়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার মূল আদর্শবিরোধী কর্মকান্ডের বহুল প্রসার ঘটেছে এইসব অপশক্তির হাত ধরে। ৭৫ পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্ম জানতেই পারেনি তাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল ইতিহাস। স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী এই শক্তিকে কাউন্টার করতে সরকারিযন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তিকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এরজন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকা অনিবার্য। বেকারদের অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন, কিন্তু দেশ প্রেমিক শক্তি সরকারি যন্ত্রে কাজ করলে দেশ উন্নত হবে দ্রুত, বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগও। এমন এক সময় আসবে যখন সাধারণ মানুষের মননে থাকবে মুক্তচিন্তা, উদারনীতি। তখন এই কোটা রাখার প্রয়োজন পড়বে না।