বাঙালি মানুষ গুজব ছড়াতে ভালোবাসে। গুজব তার পরমাত্মীয়। ‘তিলকে তাল বানিয়ে’ কথাটা তো আর এমনি এমনি আসেনি। গুজব ছড়ানো আমাদের মজ্জাগত অভ্যেস। যখন ফেসবুক আসেনি তখন মুখে মুখে গুজব ছড়াত। গুজবের বিড়াল হয়ে যেত বাঘ, গুজবের শিয়াল হয়ে যেতে সিংহ। ফেসবুক আসার পর আমরা ভাবলাম, এবার বুঝি গুজবের দিন শেষ। তথ্যের অবাধ প্রবাহ। সত্য ঘটনাটি সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু না, গুজবের ক্ষমতা আরো বাড়ল। বলা যায় গুজবের ডানা গজাল। আগে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গুজব পৌঁছতে লাগত কয়েকদিন। এখন কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায় গুজব। অপরাধীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়ায় ফেসবুকে। মানুষ সেই গুজবে বিশ্বাস করে। শুরু করে সহিংসতা। ফেসবুকে গুজব ছড়ায় মুসলমানদের কোরান অবমাননা করেছে অমুক হিন্দু। গুজবে বিশ্বাস করে মুসলমানরা হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। গুজবের কী ক্ষমতা!
প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত একজন বিবেকবান মানুষ, ধারা যাক তিনি একজন শিক্ষক, একজন নেতা বা একজন লেখক। তিনি কি গুজবে বিশ্বাস করবেন? না, তিনি তা করতে পারেন না। তিনি হুটহাট মন্তব্য করেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, যাচাই করেন, তারপর মন্তব্য করেন। কেননা তার মন্তব্যের মূল্য আছে। তার মধ্যে আর সাধারণ দশজন মানুষের মধ্যে ফারাক আছে। সাধারণ মানুষ তাকে বিশ্বাস করে, তার কথার গুরুত্ব দেয়, তাকে বাতিঘর ভাবে। কিন্তু তিনিও যদি যাচাই-বাছাই না করে গুজবটির প্রচার শুরু করেন, তখন সাধারণ মানুষ সেটিকে আর গুজব ভাবে না, সত্যি বলে ধরে নেয়।
ধরা যাক তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিলেন, ‘কুমিল্লায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে কতিপয় দুস্কৃতিকারী।’ আধা ঘণ্টার ব্যবধানে তার পোস্টটিতে লাইক পড়ল কয়েক হাজার, কমেন্টও পড়ল অসংখ্য, শেয়ারও হলো কয়েক শ। তার কথায় বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। উত্তেজিত জনতা সেই কতিপয় দুস্কৃতিকারীকে গণধোলাই দিয়ে মেরেই ফেলল। তাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেই নিরীহ মানুষটি তার ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট দিল, ‘আমি সুস্থ আছি, আমি মরি নাই।’ তখন কী হবে? যা হওয়ার তা কিন্তু হয়েই গেছে। সমাজের একজন অগ্রসর মানুষের কথা এমনই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে এখন। আমরা প্রত্যেকেই কবি-লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। একই সঙ্গে আমরা প্রচারকামীও। আমাদের পোস্টে লাইক পড়তে হবে। হাজার হাজার লাইক। লাইকের জন্য সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে পোস্ট দিতে হবে। নইলে মানুষ উত্তেজিত হবে না। নিজে হিরো হওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই না করে একটি গুজবকে আরো উসকে দিতে হবে। তাতে সমাজের কী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেই ভাবনা আমাদের নেই।
আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের উদয় হোক।
(লেখকে ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া)