উপক্রমণিকা
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা সময়ের ঘূর্ণিতে বিস্মরণের অতলে হারিয়ে যায় অনেক স্মৃতি, অনেক ঐতিহাসিক সত্য। বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে পুরনো দিনের ইতিহাসকে সামনে আনার প্রচেষ্টাও কিন্তু থেমে নেই। সকল ক্ষেত্রে এই চেষ্টা সফল না হলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক দলিল কখনও কখনও খোলে দেয় অতীতের বন্ধ দরজা। সুযোগ সৃষ্টি হয় হারানো সময়ে উঁকি দেওয়ার। সম্প্রতি তেমন একটি ঐতিহাসিক দলিল থেকে আমরা জানতে পারি সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম দিকের অনেক অজানা কথা।
কেতাবি সংজ্ঞানুযায়ী ইতিহাস হলো ‘উৎপাদন-পদ্ধতি ও উৎপাদন-সম্পর্কের ক্রমবিকাশের কালানুক্রমিক বিবরণীর উপস্থাপন’।১ বর্তমান লেখাটিকে তাই ইতিহাস বলার ধৃষ্টতা দেখাবো না। তবে এটি উপাখ্যানও নয়। বরং সুনামগঞ্জ পৌরসভা কবে, কারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠানটির বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করাই মূলত এ লেখার উদ্দেশ্য। আর এই সমস্ত তথ্য-উপাত্ত কোনো গৌণ উৎস (secondary source) থেকে নয়, সরাসরি প্রাথমিক উৎস থেকে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কেউ এই জনপদের ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করতে চান, তবে হয়তো এইসব তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগতে পারে। সে যাই হোক, মূল প্রসঙ্গ অবতারণার আগে সুনামগঞ্জ নামের এই জনপদ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক কথা সংক্ষেপে সেরে নেওয়া যাক।
বাংলাভাষায় রচিত সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’ (১৮৮৬ খ্রি.)-এর লেখক মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ সুনামগঞ্জ সম্পর্কে লেখেন, ‘সুনামগঞ্জের বাজারে চুনের বিস্তর কারবার হয়। এই বাজার অতি পুরাতন-ইহা পূর্ব্বে বাণিয়াচুঙ্গের জমিদারের অধিকারে ছিল। ২৫ বৎসর হইল মৃত আলিরজা চৌধুরী প্রভৃতি ঐ বাজারটি ক্রয় করিয়াছেন’।২ পরবর্তীতে বাজারের মালিকানা হাত বদল হয়। জলসুকার জমিদার গিরিশচন্দ্র রায়ের পরিবার গত শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত এই বাজারের স্বত্বাধিকারী ছিলেন।
মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ যদিও সুনামগঞ্জকে অতি পুরাতন বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কতটা পুরাতন তা উল্লেখ করেননি। বাজারকেন্দ্রিক সুনামগঞ্জ নামের এই জনপদটির পত্তন যে ইংরেজ রাজত্বের প্রথমদিকেও হয়নি তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার জেনারেল জেমস্ রেনেল কর্তৃক অঙ্কিত মানচিত্রে৩। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের এই মানচিত্রে আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ, ধর্মপাশা, লাউড়, জগন্নাথপুর, পানাইল, দীঘলি ইত্যাদিসহ ছোটবড় বহু জনপদ গুরুত্বের সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু উক্ত মানচিত্রে সুনামগঞ্জের কোনো অস্তিত্ব-ই নেই।
মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ কর্তৃক উল্লেখিত ‘চুনের বিস্তর কারবার’কে কেন্দ্র করেই হয়তো এই গঞ্জটির পত্তন হয়ে থাকতে পারে। চুনের জমজমাট ব্যবসায় সম্পর্কে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লেখেন, ‘ছাতকের নিকটবর্তী উতম (উতমা) ও ব্রহ্ম পাহাড়ে প্রচুর পরিমাণে চূণা পাথর পাওয়া যায়। ঐ সকল স্থান হইতে “চূণা পাথর” সংগৃহীত হইয়া থাকে, এবং ছাতক হইতে সুনামগঞ্জ পর্য্যন্ত নদীর ধারে ভাটায় জ্বালাইয়া তাহা ব্যবহারোপযোগী করিয়া লয়।
ইংরেজ রাজত্বের প্রথমে, রেসিডেন্ট (কালেক্টর) লিন্ডসে সাহেব চূণার কারবার করেন। তৎপর “ইংলিস কোম্পানী” বহুকাল যাবৎ ছাতকে চূণার কারবার করিয়া আসিতেছিলেন; সম্প্রতি (১৯০২ খৃষ্টাব্দে) ময়মনসিংহের গৌরিপুরস্থ স্বদেশবৎসল জমিদার শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ঐ ব্যবসায় করিতে আরম্ভ করিয়াছেন।’৪
উল্লেখ্য, রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ সালে সিলেট আসেন এবং প্রায় ১২ বছর এ অঞ্চলের রেসিডেন্ট অর্থাৎ প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। পাণ্ডয়ার নিকট একটি চুনাপাথরের পাহাড় দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। লিন্ডসে স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘চমৎকার দৃশ্য। সমগ্র পাহাড়টি খাঁটি অ্যালবাস্টার চুনায় পরিপূর্ণ। মনে হলো, এখান থেকে সমস্ত বিশ্বের চাহিদা মেটানো যায়।’৫ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিদের চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ছিল। অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি লিন্ডসে সাহেব শুরু করেন চুনের ব্যবসা। এটি এতোই লাভজনক ছিল যে, মাত্র ১২ বছরে তিনি বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান। দেশে ফিরে গিয়ে স্কটল্যান্ডে জমিদারি কেনেন এবং কোম্পানির একজন সামান্য রাইটার হয়ে উঠেন লর্ড রবার্ট লিন্ডসে।
কালক্রমে চুন ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে সুনামগঞ্জ বাজার। চুন ব্যবসায়কে কেন্দ্র করেই একসময় কলকাতা পর্যন্ত চালু হয় স্টিমার সার্ভিস। চুনাপাথর প্রক্রিয়াজাত হয়ে চলে যেতো কলকাতায়। সুনামগঞ্জ হয়ে উঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। এ-থেকে সহজেই অনুমেয়, কোম্পানি আমলেই সুনামগঞ্জ বাজারের গোড়াপত্তন এবং ক্রমবিকাশ আরম্ভ হয়। কাজেই কোনো এক যুদ্ধে বীরোচিত অবদানের জন্য মোগল সম্রাট কর্তৃক সৈনিক সুনাম উদ্দিনকে ভূমি দান, অতঃপর সেই বীর সৈনিক কর্তৃক নিজ নামে গঞ্জ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত চালু হওয়া গল্পের ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে। মোগল আমলেই যদি গঞ্জটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তবে ১৭৭৬ সালে জেমস রেনেলের মানচিত্রে (যা ‘Actual Map’ ’ হিসাবে খ্যাত) গঞ্জটিকে কেন চিহ্নিত করা হয়নি? ছোটখাটো জনপদও যেখানে চিহ্নিত হয়েছে, সেখানে আস্ত একটি গঞ্জ কী করে রেনেল সাহেবের দৃষ্টি এড়ালো! তাছাড়া ‘সুনাম উদ্দিন’ সম্পর্কেও কেউ কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য কিংবা প্রমাণ এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করতে পারেননি। তাই কারো কারো প্রশ্ন, ‘সুনাম উদ্দিন’ নামটিই একটি বানানো গল্প? সংস্কৃত সু+নামন্ থেকে ‘সুনাম’৬ শব্দের উৎপত্তি। এর সঙ্গে আরবি শব্দ ‘উদ্দিন’ মিলে হয়েছে ‘সুনাম উদ্দিন’। এরকম দ্বি-ভাষিক অর্থাৎ সংস্কৃত-আরবির সম্মিলনে সৃষ্ট শব্দে কোনো ব্যক্তির নাম রাখার নজির মোগল আমলে পাওয়া অসম্ভব বলেও অনেক বিদ্বজন মনে করেন।
তবে এই গঞ্জের নামকরণ বিষয়ে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লেখেন, ‘সুনামগঞ্জ সাবডিভিশনে জলাভূমি ও বিস্তৃত হাওরের বাহুল্য লক্ষিত হয়। এই স্থানে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য ধৃত হয় ও তাহা শুষ্ক করিয়া ব্যবসায়ীগণ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রেরণ করে। সুনামগঞ্জ হইতে প্রচুর পরিমাণে ঘৃত রপ্তানি হইয়া থাকে। সুনামগঞ্জ বাজারের নামটি এইরূপে জনৈক ব্যবসায়ী কর্তৃক প্রদত্ত হয় বলিয়া শুনা যায়। এই বাজারের নামানুসারেই ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্ট জেলায় সুনামগঞ্জ সাবডিভিশন স্থাপিত হয়।৭ অর্থাৎ উপরিউক্ত কথায় অনুুমিত হয় যে, এই বাজারের প্রসিদ্ধ পণ্য মাছ, শুটকি ও ঘি প্রভৃতির সুনাম থেকে গঞ্জটির নামকরণ করা হয়েছে সুনামগঞ্জ।
আবার অনেকের ধারণা, চুন ক্রয়-বিক্রয়ের জমজমাট গঞ্জ ‘চুনামগঞ্জ’ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ‘সুনামগঞ্জ’। তাঁদের যুক্তি, ‘চুন থেকেই চুনাম> সুনাম শব্দের উৎপত্তি’।৮ স্থানীয় উচ্চারণে ‘চুন’ অনেকটা ‘সুন’ (soon)-)-এর মতো উচ্চারিত হয়। ইংরেজদের উচ্চারণও হয়তো এরকম ছিল, তাই দেখা যায় গত শতকের প্রথম দিকেও সরকারি দলিল-দস্তাবিজে ইংরেজরা U’র পরিবর্তে ‘O’ দিয়ে লিখতো Sonamganj’ বানানটি।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ নামের উৎপত্তি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা এখনও সম্ভব হয়নি, বরং রয়েছে মতভেদ। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সুনামগঞ্জ নামক গঞ্জটির নামানুসারেই যাত্রা শুরু হয় সুনামগঞ্জ মহকুমার। ‘চারটি থানা (সুনামগঞ্জ, ছাতক, ধর্মপাশা ও দিরাই), তিনটি আউট পোস্ট (তাহিরপুর, পাড়ুয়া ও জগন্নাথপুর) এবং একটি কালেক্টরির উপবিভাগ (রসুলগঞ্জ) নিয়ে স্থাপিত হয় সুনামগঞ্জ সাব-ডিভিশন।’৯
মহকুমা স্থাপিত হওয়ার পরই গঞ্জটির কাঠামোগত মৌলিক ক্রমবিবর্তন আরম্ভ হয়। গঞ্জ ক্রমে রূপান্তরিত হয় শহরে। বাংলার রাষ্ট্রসীমার চেয়ে দূরবর্তী হলেও এটি তখন বিছিন্ন জনপদ ছিল না। সময় সাপেক্ষ হলেও নৌপথে তখনকার বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার সঙ্গে অথবা ঢাকার মতো বড়ো নগরের সঙ্গে ছিল সরাসরি যোগাযোগ। এ-দিক দিয়ে জেলা সদর শ্রীহট্টের চেয়ে সুনামগঞ্জ ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। তখনও রেলপথ স্থাপিত না হওয়ায় শ্রীহট্ট থেকে এ-পথেই কলিকাতার সঙ্গে যাতায়াত করতে হতো। প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপিত হওয়ায় অনেক উকিল-মোক্তার জেলার ভিতর ও বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসতে থাকেন। আসতে থাকেন শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র বলে ব্যবসায়ীগণও প্রসিদ্ধ এই নদীবন্দরের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তবে সুনামগঞ্জের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই উকিল-মোক্তারগণের প্রাধান্যই ছিল সুস্পষ্ট।
সুনামগঞ্জ নামক গঞ্জটির আশেপাশে কয়েকটি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। এসব গ্রামের মধ্যে মল্লিকপুরের শর্মা পরিবার ও তেঘরিয়া গ্রামের মরমী সাধক হাছন রাজার পরিবারের মতো প্রভাবশালী কয়েকটি জমিদার পরিবার ছিল আগে থেকেই। তবে মহকুমা স্থাপিত হওয়ার পর সুনামগঞ্জে জমিদারগণের আনাগোনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জমিদারগণও শ্রীহট্টের শস্যভাণ্ডার হিসাবে খ্যাত সুনামগঞ্জ অঞ্চলে জমিদারি ক্রয়ে আগ্রহী ছিলেন। জেলা সদর থেকে দূরবর্তী বলে এই মহকুমা সদরেই সরকারি খাজনা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়। তখন পর্যন্ত সূর্যাস্ত আইন চালু থাকায় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এবং জমিদারি পরিচালনার সুবিধার জন্য অনেক জমিদার মহকুমা সদরে আসতে থাকেন। কেউ খোলেন কাচারি, কেউবা সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তখনকার সময়ে এই সমস্ত অভিজাত শ্রেণির লোকেরাই লেখাপড়া করতেন, উকিল-মোক্তার হতেন। সমাজের নেতৃত্বও ছিল এই শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির হাতে। শহর গঠনে এইসব নবাগত জমিদারগণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সুনামগঞ্জের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর, পানি সুপেয়, মাটি উর্বর। তাছাড়া সুনামগঞ্জের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশও মানুষকে আকৃষ্ট করে। ১৯২৪ সালে রাজনৈতিক সম্মেলনে সভানেত্রীর পদ অলঙ্কৃত করতে সুনামগঞ্জে এসেছিলেন সুপ্রসিদ্ধ কবি, কংগ্রেস নেত্রী ও বাগ্মী দেশনেত্রী শ্রীমতি সরোজিনী নাইডু। তিনি সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক রূপমাধুরীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, , Here at Sunamganj, where the mountain kisses the sky, the sky kisses the mountain, the Surma flows by the skirt of the mountain and the Bulbul sings in the bush by its side. One cannot but be a poet.10
এসব কারণে অনেকেই এখানে থিতু হয়ে যান। এই সমস্ত শিক্ষিত লোকজনের ক্রমাগমনে এক সময় বহু সংস্কৃতির এক মিলনতীর্থে পরিণত হয় নবসৃষ্ট জনপদটি। তাছাড়া মহকুমা সদর বলে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রসিদ্ধ সকল জিনিসের সমাবেশ ঘটতে থাকে এখানে। ফলে স্থানীয় উন্নত লোকসংস্কৃতির সঙ্গেও ঘটে নবাগত আধুনিক সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া। আর এভাবেই প্রসিদ্ধ নদীবন্দরটি অচিরেই পরিণত হয় এক উচ্চ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মান সম্পন্ন বর্ধিষ্ণু জনপদে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে তৈরি করে এক সম্প্রীতির শহর।
নগরায়ন প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় নগর ব্যবস্থাপনা তথা নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণের। এ লক্ষ্যে প্রথমে গঠিত হয় একটি টাউন কমিটি। টাউন কমিটির প্রধান হতেন পদাধিকার বলে মহকুমা হাকিম। এই টাউন কমিটি থেকেই গত শতকের দ্বিতীয় দশকে জন্ম নেয় সুনামগঞ্জ পৌরসভা (Municipality)। উল্লেখ্য, পৌরসভার আগে লোক্যাল বোর্ডও গঠিত হয়েছিল। লোক্যাল বোর্ডের অধিক্ষেত্র ছিল মহকুমাব্যাপী।
উপমহাদেশে মিউনিসিপ্যাল শাসন পদ্ধতির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মাদ্রাস মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন গঠিত হয়েছিল। এরপর মুম্বাই ও কলকাতায় ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ শাসনামলে এই পদ্ধতির ক্রমোন্নতি হয়। প্রধান প্রধান কয়েকটি শহরে কেবল সীমাবদ্ধ না রেখে স্থানীয় স্বশাসন ((Local self-government) ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে কানাচে। বিভিন্ন সময় এই সংক্রান্ত আইনে সংস্কার আনা হয়। ১৮৮৪ সালে মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাক্ট ((Act III B.C. of 1884) পাস হওয়ার পর দেশের নানা প্রান্তের ছোটবড় নানা শহরে ক্রমশ পৌরসভা গঠিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যন্ত অঞ্চল সুনামগঞ্জ মহকুমা সদরেও প্রতিষ্ঠিত হয় পৌরসভা। কিন্তু ঠিক কখন গঠিত হয় সুনামগঞ্জ পৌরসভা? কারা ছিলেন প্রথম চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও কমিশনারবৃন্দ?
বর্তমানে সুনামগঞ্জ পৌরসভার নামফলকে লেখা আছে প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৯ খ্রি. এবং অনার বোর্ডে প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে লেখা রয়েছে রায় বাহাদুর অমরনাথ রায়ের নাম। তাছাড়া বিশিষ্ট লেখক অ্যাডভোকেট আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন তাঁর ‘সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে লেখেন, ‘রায় বাহাদুর অমর নাথ রায় সুনামগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটিরও প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এ পদের দায়িত্ব পালন করেন।’১১ দীর্ঘদিন ধরে এ তথ্যই চালু আছে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জ পৌরসভার একটি রেজুলেশন বইয়ে পৌরসভার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও কার্মযজ্ঞ সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্য আমরা দেখতে পাই। উক্ত রেজুলেশন বইয়ে ১৮ এপ্রিল ১৯১৫ খ্রি. থেকে ২২ অক্টোবর ১৯২১ খ্রি. পর্যন্ত পৌর-কমিশনারগণের কার্যবিবরণীসমূহ লিখিত আছে। এসব তথ্য-উপাত্তসমূহ কেবল পৌরসভা সম্পর্কে নয়, সুনামগঞ্জ শহরের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও আলোকপাত করে। সময় ও আবহাওয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে বইটি এখনও টিকে আছে। এটি সুনামগঞ্জের অতীত ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের ভিত্তিতেই মূলত বর্তমান লেখার পরবর্তী অংশ অগ্রসর হয়েছে। উল্লেখ্য, রেজুলশন বইটি প্রয়াত পৌর মেয়র আয়ূব বখত জগলুল সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘরে হস্তান্তর করেন। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিলে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে থেকে দলিলটি একদিন হয়তো নষ্ট হয়ে যেতো। হারিয়ে যেতো আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাসের একটি অধ্যায়। ইতিহাসের এই অমূল্য উপদানটি জনসম্মুখে নিয়ে আসার জন্য প্রয়াত মেয়রকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। দলিলটি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় জনাব মো. সাবিরুল ইসলামের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।
তথ্যসূত্র:
১. দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি, ভারত-ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, প্রথম বাংলা, অনুবাদ সংস্করণ: ২০০২; পৃ. ০১
২. মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ, শ্রীহট্ট দর্পণ, প্রথম প্রকাশ: ১৮৮৬, কলকাতা, উৎস সংস্করণ: আগস্ট ২০০২ খ্রি.; পৃ. ২৭
৩.. An Actual Survey of the Province of Bengal, Bihar by Major James Rennell Esq. Engineer, Surveyor General, East India Company, 1776.
৪. অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪; পৃ. ৬৬
৫. রবার্ট লিন্ডসে, সিলেটে আমার বারো বছর, ভাষান্তর: আবদুল হামিদ মানিক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট, দ্বিতীয় সংস্করণ: মার্চ ২০১৩ খ্রি.; পৃ: ৪৭
৬. আধুনিক বাংলা অভিধান, সম্পাদক: জামিল চৌধুরী, বাংলা একাডেমি, ২০১৬ খ্রি.; পৃ. ১৩৩৬
৭. অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, উত্তরাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ, উৎস প্রকাশন, ঢাকা; পৃ. ৩৯৯
৮. দীপক রঞ্জন দাশ, পণাতীর্থ পরিক্রমা; পৃ. ২৪
৯. মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ, শ্রীহট্ট দর্পণ, প্রথম প্রকাশ: ১৮৮৬, কলকাতা, উৎস সংস্করণ: আগস্ট ২০০২ খ্রি.; পৃ. ২৭
১০. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আত্মজীবনী, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, আগস্ট ২০০৭ খ্রি.; পৃ. ৪২
১১. আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ডিসেম্বর ১৯৯৫ খ্রি.; পৃ: ১৫১
(সৌজন্য: সুনামকণ্ঠ)