আরো একধাপ অগ্রগতি :
স্থানীয় স্বশাসন পদ্ধতির বিবর্তনের ধারায় নিয়োগকৃত (appointed) সরকারি কর্মকর্তার পরিবর্তে একজন অনাধিকারিক (হড়হ-ড়ভভরপরধষ) অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা নন এমন একজন নাগরিককে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করার বিষয়টি এক পর্যায়ে সামনে চলে আসে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শ্রীহট্ট হতে পৌরসভায় ডি.সি.’র চিঠি আসে। পৌর-কমিশনারগণ প্রথমে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট বিষয়টি সুরাহা করার লক্ষ্যে সভায় বসেন, কিন্তু তাঁরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে সভাটি পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মূলতবি রাখা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখের সভায় বিষয়টি পুনরায় উত্থাপিত হয়। লক্ষণীয় যে, সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিশনারগণ বিষয়টির ফয়সালা করেন। আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে বিষয়টি ভোটে দেওয়া হয়। উপস্থিত সাতজনের মধ্যে ৫ জন কমিশনারই চেয়ারম্যান পদে রাজকর্মচারী নিয়োগ না দিয়ে একজন অনাধিকারিককে নির্বাচিত করার পক্ষে ভোট দেন। তবে একজন কমিশনার একবছর পরে এই পদ্ধতিটি চালুর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন এবং অবশিষ্ট একজন ভোট প্রদানে বিরত থাকেন। উল্লেখ্য, সেদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান রায় সাহেব অমরনাথ রায়, কমিশনার লালা প্রসন্নকুমার দে, বাবু গিরিশচন্দ্র রায়, বাবু নরেন্দ্র লাল রায়, মুন্সী কাদির বক্স, মুন্সী ফয়েজ আলী এবং বাবু ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী। পৌরচেয়ারম্যান মৌলভী মফিজুর রহমান (এসডিও) সাহেবের সভাপতিত্বে উক্ত সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভার কার্যবিবরণীর ২নং দফাটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো:
2. Read D.C.’s letter no. 693 – 95 J, Dated 6.8.18 with enclosures
The question of electing of non-official chairman to this Municipality was discussed and put to vote. Out of 7 commissioners present 5 voted for it, one voted for having this after a year and one reserved his vote. 40
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায় সূচিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। তবে আগের মতোই কেবল সীমিত সংখ্যক বিত্তশালী করদাতা (রেইট পেয়ার) তাদের কমিশনার নির্বাচন করবেন। নূতন নিয়মানুসারে, নির্বাচিত ও মনোনতি পৌরকমিশনারগণ বসে বেছে নেবেন চেয়ারম্যান। এই সামান্য পরিবর্তনটুকু তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় অর্থাৎ একটি পরাধীন দেশের নাগরিকগণের জন্য একটি বিরাট পাওয়া।
উপরিউক্ত সভার কিছুদিন পর ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে রায় সাহেব অমরনাথ রায় ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাবু মথুরাচন্দ্র দত্ত। অক্টোবরের ৩ তারিখে কমিশনারগণ তাঁকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেন। ফলে মথুরাচন্দ্র দত্ত হলেন সুনামগঞ্জ পৌরসাভার তৃতীয় ভাইস চেয়ারম্যান।
1. Resolved that the resignation tendered by Rai Shaheb Amarnath Roy owing to pressing private necessities be accepted and that Babu Mathura Chandra Dutta the officiating vice chairman be elected vice chairman in his place. 41
এরপর আসে চেয়ারম্যান নির্বাচনের সেই প্রতীক্ষিত দিনটি (১৭ জানুয়ারি ১৯১৯ খ্রি.)। ভাইস চেয়ারম্যান মথুরাচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে সভার কার্যক্রম আরম্ভ হয়। চেয়ারম্যান মৌলভী মফিজুর রহমান সভায় উপস্থিত হয়ে চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি কমিশনারগণকে অবহিত করেন। তিনি আরও জানান যে, এখন কমিশনারগণের উচিত একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা। এরপর তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুনামগঞ্জ পৌরসভার তৃতীয় চেয়ারম্যান মৌলভী মফিজুর রহমান (এসডিও) হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর পিতা।
সভা চলাকালীন অমরনাথ রায় চেয়ারম্যান পদে তাঁর প্রার্থীতার কথা ঘোষণা করেন। সভ্যদের মাঝ থেকে অমরনাথ রায়ের নাম চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রস্তাব করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর এভাবেই নির্বাচিত হয়ে গেলেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম কোনো নন-অফিসিয়াল চেয়ারম্যান।
যদিও বলা হয়ে থাকে যে, অমরনাথ রায় সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান, কিন্তু পৌরসভার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তিনি প্রকৃতপক্ষে চতুর্থ চেয়ারম্যান। তাই আমাদের প্রস্তাব, তাঁকে সরাসরি প্রথম চেয়ারম্যান না বলে, বলা যেতে পারে কমিশনারগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান। পূর্বের তিনজনের নামও অনার বোর্ডে সংযুক্ত করা উচিত এবং তাঁদের নামের পাশে লেখা যেতে পারে নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও সুদীর্ঘকাল। কারণ ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানি শাসকের সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদ সর্বসাধারণের ভোটাধিকার মেনে নেয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে আসে সেই সুযোগ। সেই অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান হলেন দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী।
উপরিউক্ত সভায় অর্থাৎ ১৭ জানুয়ারি ১৯১৯ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় পৌরসভার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় বিদায়ী চেয়ারম্যান মৌলভী মফিজুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। উল্লেখ্য যে, চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও তিনি পৌরকমিশনার হিসাবে বহাল রইলেন। চেয়ারম্যান নির্বাচনের সেদিনের সভার কার্যবিবরণীর ভাষাটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নিম্নে তা উদ্ধৃত হলো:
Proceedings of a meeting of the commissioners of the Sunamganj Municipality held on the 17th Day of January 1919.
Present: Rai Shaheb Amarnath Roy
Lala Prasanna Kumar Dey
Babu Narendra Lal Roy
Assistant Surgeon
Munshi Fayiz Ali
Dewan Ganiur Raja Chowdhury
Mouluvi Mafuz Ali
Munshi Kadir Box
Babu Iswar Chandra Chowdhury
Vice Chairman (Mathura Chandra Dutta Presided the meeting)
S.D.O. (the appointed chairman) intimated to the commissioners that he retired from his office as chairman and that commissioners should now proceed to elect a chairman. Saying this he left the meeting.
Rai Shaheb Amarnath Roy having intimated his candidature for the chairmanship it was proposed from the chair that he be elected and this was carried unanimously.
Resolved that the commissioners place on record their deep sense of thankfulness and gratitude to the retired chairman Maulvi Mafizur Rahaman for the keen interest taken by him in the affairs of the Municipality during the term of his office.
নূতন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক উন্নয়নমূলক কাজে তিনি হাত দেন। এ সময় (২৪ ডিসেম্বর ১৯১৯ খ্রি.) আরও একবার পৌর উপবিধি পাস হয়। তাছাড়া নিম্ন প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় (lower primary girls’ school), , যেটি বর্তমানের সতীশচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও রাজগোবিন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়নে এবং এদেরকে মিড্ল ইংলিশ স্কুলে রূপান্তরের জন্য চেষ্টা তদবির শুরু হয়। পাঠদানসহ নানা দিক দিয়ে গালর্স স্কুলে তখন খুব নাজুক অবস্থা বিরাজমান ছিল। এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য পৌর চেয়ারম্যান স্কুল কমিটি পুনর্গঠিত করেন। বাবু কালীজয় ভট্টাচার্য্যকে স্কুল কমিটির সম্পাদক এবং মৌলভি মুনাওওর আলী বি.এ., এলএল.বি., বাবু গোপেন্দ্র কুমার চৌধুরী বিএল, বাবু প্যারীমোহন দাস (উকিল) ও বাবু রামকিশোর চৌধুরী (মোক্তার)-কে সদস্য মনোনীত করা হয়।৪২
পৌরসভার দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ। এ সময় ওয়ার্ডের সীমানা সম্ভবত কিছুটা রদবল করা হয়। নির্বাচনের ফলাফল নি¤েœ উল্লেখ করা হলো:
১নং ও ২নং ওয়ার্ডে একত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একত্রে এই দুই ওয়ার্ডের জন্য কমিশনারের পদ নির্ধারিত ছিল দুটি। প্রার্থী ছিলেন চারজন। তাঁদের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। বাকি তিনজনের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। বাবু কৈলাশ চন্দ্র দাস ৪১ ভোট, বাবু পবিত্রনাথ পুরকায়স্থ ৪০ ভোট এবং মুন্সী ফয়েজ আলী ৪১ ভোট পান। এই দুই ওয়ার্ড থেকে কৈলাশচন্দ্র দাস ও ফয়েজ আলী কমিশনার নির্বাচিত হন।
৩ নং ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিলেন তিনজন, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটকে দরখাস্ত দিয়ে একজন প্রার্থী নির্বাচন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন নেন। এই ওয়ার্ডের জন্য কমিশনারের পদ নির্ধারিত ছিল দুটি। ফলে বাকি দুই প্রার্থী বাবু কামিনী মোহন দে ও মৌলভি আব্দুল মজিদ নির্বাচিত বলে ঘোষিত হন।
৪ নং ওয়ার্ডের জন্য কমিশনার পদ নির্ধারিত ছিল তিনটি। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেন ছয়জন। তাঁদের মধ্যে দুইজন নির্বাচনের পূর্বে এবং একজন নির্বাচনের পর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগে সরে দাঁড়ান। ফলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাকি তিনজন নির্বাচিত হন। নির্বাচিত কমিশনারগণ হলেন বাবু মথুরাচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র রায় এবং নগেন্দ্রলাল রায়।
৫ নং ওয়ার্ডে মুন্সী কাদির বক্স মিয়া একাই মনোনয়নপত্র জমা দেন। আর কোনো প্রার্থী না থাকায় তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।৪৩ এছাড়া দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী ও সহকারী সার্জন মনোনীত কমিশনার হিসাবে এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বদলির পূর্বপর্যন্ত এসডিও মফিজুর রহমান সাহেবও কমিশনার হিসাবে পৌরবোর্ডে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পৌরসভার উন্নয়নে অবদানের জন্য এসডিও সাহেবের বিদায়ের সময় কার্যবিবরণীতে লেখা হয়:
Resolved that the commissioners of the Municipality convey their hearty thanks to Moulvi Mafizur Rahman, the later S.D.O. and an outgoing commissioner, for the keen interest he took in the affairs of the Municipality.44
সাধারণ নির্বাচনের পর মে মাসের ৮ তারিখ মথুরাচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় রায় সাহেব অমরনাথ রায় ও বাবু মথুরাচন্দ্র দত্ত দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে পুনঃনির্বাচিত হন। সভার কার্যবিবরণীতে লেখা হয়:
As proposed from the chair, it is resolved that Rai Shaheb Amarnath Roy be elected chairman of this Municipality and this was carried unanimously.
Babu Mathura Chandra Dutta be elected vice chairman of this Municipality.45
সুনামগঞ্জ পৌরসভার পূর্বোক্ত রেজুলেশন খাতায় রেকর্ডকৃত শেষ সভার কার্যবিবরণীটি লেখা হয় ২২ অক্টোবর ১৯২১ খ্রি. তারিখে। উক্ত সভাটিও চেয়ারম্যান রায় সাহেব অমরনাথ রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর সভাপতিত্বে পরে আর কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। তবে পৌরসভার অনারবোর্ড অনুযায়ী ১৫ নভেম্বর থেকে চেয়ারম্যান হিসাবে মৌলভি মুনাওওর আলীর কার্যকাল আরম্ভ হয়।
এই পর্যায়ে এসে আমরা বর্তমান লেখার আপাতত ইতি টানতে চাই। এই লেখায় সুনামগঞ্জ পৌরসভার গোড়ার দিকের কুশীলবদের সম্পর্কে এবং তাঁদের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও এটি একটি খণ্ডিত চিত্র। তবে এই চিত্রটিকে পূর্ণাঙ্গ করা মতো আরও উপাদান পাওয়া যায় কিনাÑ এ ব্যাপারে আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে। এই বিষয়ে পৌরপরিষদ যদি সহযোগিতা করেন তবে হয়তো সুনামগঞ্জ পৌরসভার একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হবে। [সমাপ্ত]
তথ্যসূত্র :
40. Ibid, Proceedings of a meeting of the commissioners of the Sunamganj Municipality held on 7. 9. 1918. Page: 99.
41. Ibid, Proceedings of a meeting of the commissioners of the Sunamganj Municipality held on 3.10.18. Page: 100.
42. Ibid, Proceedings of a special meeting of the commissioners held on 21. 7. 20. Page: 146.
43. Ibid, Proceedings of a special meeting of the commissioners held at 4 PM on 22.2.1920, after the general meeting to hold the the second general election of Commissioners of this Municipality. Page: 139-140.
44. Ibid, Proceedings of a special meeting of the commissioners held on 25.1.21.
45. Ibid, Proceedings of a special meeting of the commissioners held on 8.5.1920. Page: 144.