বিশেষ প্রতিনিধি:
‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইলো না।’ বরেণ্য শিল্পী রুনা লায়লার গাওয়া এই গানটি শুনেননি এমন মানুষ পাওয়া এ দেশে দুষ্কর। গানে রুনা লায়লা পান খেয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে প্রেমের যে আহ্বান করেছেন বর্তমানে সেটা অলীক অতীত। পান খেয়ে এখন আর মানুষ প্রেমকে আহ্বান করে না, মরণব্যাধী রোগকে আহ্বান করছে। যদিও পান মানুষের পাচকের ও যকৃতের উপকারে কাজ করে কিন্তু পানের সাথে মিশিয়ে সুপারিসহ আরো যা খাওয়া হচ্ছে তা মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। পানের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সুপারি। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের অধিকাংশ সুপারি ব্যবসায়ীরা এসব সুপারিতে হরহামেশাই মেশাচ্ছেন ক্ষতিকর সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড নামের একটি কেমিক্যাল জাতীয় পাউডার। যা ইথিলিন নামক পদার্থ থেকে তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে এটি ‘হাইড্রোজ’ পাউডার নামে পরিচিত। সুপারির মাঝে কালো কালো দাগ উঠাতে, সুপারিকে সাদা রাখতে, হলদেটে করতে, সাধারণ ক্রেতাদের কাছে সুপারিকে দৃষ্টিনন্দন করতে এবং চড়াদামে বিক্রি করতে এই অতিমাত্রার ক্ষতিকর পাউডারটি মেশানো হয় বা হচ্ছে। যা মানব দেহের অনেক ক্ষতি করে থাকে। রক্তসঞ্চালন বন্ধ, কিডনি দূর্বল করা, যকৃতের সমস্যা ও চর্মরোগের মতো রোগও হয় এই পাউডার ব্যবহারে। শুধু ‘হাইড্রোজ’ পাউডারই নয়, সুপারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘এরাড’ ও বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। একেক দোকানি একেক ধরণের ‘ফরমালিন’ জাতীয় ক্ষতিকর এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছেন। তবে দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ‘হাইড্রোজ’ পাউডার সহজলভ্য হওয়ায় এটাই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘হাইড্রোজ’ পাউডারটি লন্ড্রির লোকেরা ও গৃহিনীরা কাপড়ে মাড়ের কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও ‘আইকা’ ও ‘গাম’ তৈরিতে এই ‘হাইড্রোজ’ পাউডার ব্যবহার করা বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি। তিনি বলেন, যদি বরিক পাউডারের মতো দেখতে এই পাউডারটি খোলাহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে পাঁচ মিনিট রাখা হয় তাহলে হাতে পচন ধরে যাবে। মারাত্মক পঁচা দুর্গন্ধ বেরোবে। যা মানুষের শরিরে কি ধরণের ক্ষতি করতে পারে তার ধারণা দিয়েই যায়।
বিভিন্নসূত্রে জানা যায়, মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ক্ষার বহনকারী এই পাউডারটি কয়েক দফা সুপারিতে ছিটানো হয়ে তাকে। দেশের মূল আড়ৎ থেকে যখন স্থানীয় ‘মহাজন’ প্রকৃতির পাইকারি বিক্রেতার হাতে পড়ে তখন বস্তা থেকে খোলে বিছিয়ে ‘এরাড’ বা ‘হাইড্রোজ’ ব্যবহার করা হয়। উপরের আবরণসহও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, আবার আবরণ ছাড়াও হয়ে থাকে। তবে আপাত দৃষ্টিতে আবরণ ছাড়া সুপারিতে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক একটু বেশিই। পাইকারি বিক্রেতার চেয়ে খুচরা বিক্রেতারা কয়েকগুণ বেশি (বিশেষ করে আবরণ ছাড়িয়ে যেসব দোকানিরা সুপারি বিক্রি করে থাকেন) পাউডার ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিদিন সকালে দোকান খোলে সুপারির পানি পরিবর্তন করেন অধিকাংশ দোকানিরা। এসময় পাউডার ছিটানো হয়। কখনো কখনো দিনে দুইবার ছিটানো হয় এসব পাউডার। প্রকাশ্যে এসব পাউডার ব্যবহার করা হচ্ছে এ উপজেলায়। এসব বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয় না বা হচ্ছে না প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সাধারণ মানুষ এ নিয়ে শংকিত। তারা আশা করছেন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় যে বিভাগ উপজেলায় নিয়োজিত আছেন অচিরেই এর একটি বিহীত ব্যবস্থা নিবেন। এসব বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনারও পরামর্শ দেন কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলা বাজার, আক্তাপাড়া (মিনাবাজার), শান্তিগঞ্জ বাজার, পাথারিয়া বাজার ও নোয়াখালি বাজারসহ ছোট বড় সব বাজারে শতাধিক পান সুপারির দোকানদার আছেন। এর মাঝে পাগলা বাজারেই আছেন ২১ জনের মতো। আক্তাপাড়া (মিনাবাজার) প্রায় ১২ জন। বাকী বাজারগুলোতে গড়ে ৮ থেকে ১০জন করে দোকানদার আছেন। পাইকারী বিক্রেতা আছেন ৫ থেকে ৬ জন। এদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয় দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পান সুপারির বাজার। এদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ী আছেন পাগলারই তিন জন। এই তিনজনই গণগহারে ‘হাইড্রোজ’ মিশিয়ে সুপারি বিক্রি করেন বলে অভিযোগ আছে। আবার এই তিন জনের একজন ‘হাইড্রোজ’ পাউডার মজুত করে রাখেন বলে খবর চাউর আছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। পাগলা মধ্য বাজারের একটি বিখ্যাত মুদির দোকানে ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি প্রতি এসব সাদা বিষাক্ত পাউডার কিনতে পাওয়া যায়। পাউডার পানিতে মিশিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রাখলেই সুপারি হলদেটে বা সাদা হতে থাকে। এসব সুপারি চড়াদামে বিক্রি হয় সাধারণ ক্রেতাদের মাঝে। টাকা দিয়ে মানুষ কিনে নেয় রোগ। মানুষতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে লাভবান হয় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা।
পাগলা শত্রুমর্দন (বাঘেরকোনা) গ্রামে মখলিছুর রহমান মখলিছ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় সব ব্যবসায়ীরা এই পাউডার ব্যবহার করে থাকেন। এই পাউডার মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করে। এই পাউডার ব্যবহারে বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।’
পাথারিয়া বাজারের এক দোকানি তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউডার ব্যবহার করার কথা স্বীকারে করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো ছুনো পুঁটি, রাঘব বোয়ালরা এই পাউডার বেশি ব্যবহার করে থাকেন। আমরা তো কম ব্যবহার করি। তারা শত শত বস্তায় ব্যবহার করে থাকেন। পাউডার কিনে নিয়ে আসেন তারা।’
একই শর্তে পাগলা বাজারের তিন ব্যবসায়ী জানান, ‘আমরা ব্যবহার করি ঠিক। না করলেও পারি। সুপারিকে বেশি দিন সুন্দর করে রাখার জন্য এটা ব্যবহার করি। আর করবো না। তবে, আমাদের আগে পাইকারি বিক্রিতে যারা এটার ব্যবহার বেশি করেন তাদেরকে আটকানো উচিৎ।’
পাগলা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার ডা: হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এই পাউডারটি মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। চর্মরোগ, গ্যাস্ট্রিকসহ নানান সমস্যা হতে হতে পারে।’
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এটি মূলত সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। ইথিলিন থেকে তৈরি এই পাউডার চকচক করার জন্য তকারা ব্যবহার করে। এক ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। দেখতে বরিক পাউডারের মতো। মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর একটি পদার্থ। বিশেষ করে কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি করে বেশি। এটার ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি। এটি অসাধু ব্যবসায়ীরা সুপারিতে ব্যবহার করার খবর পেয়েছি। আমি ইউএনও স্যারের সাথে আলোচনা করে একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যা কি না দেখবো। এটি বন্ধ করা দরকার।