অনলাইন ডেস্ক ::
হাওর এলাকার উন্নয়নে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর মহাপরিকল্পনা নিলেও তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে হাওর উন্নয়ন বিষয়ক এক গোলটেবিল আলোচনায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মজিবুর রহমানের উপস্থিতিতেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান মন্ত্রী।
সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ ও অক্সফাম যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
দুই দশক ধরে হাওর জনপদের উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার মোস্তাফা জব্বার বলেন, “৩৭৩টি হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য হাওর উন্নয়ন বোর্ডের যে ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা তারা নিতে পারেনি। হাওরের উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান হল। কিন্তু আমি তো কোথাও এর বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। কোটি টাকার প্রকল্প কেবল কি দলিলে থেকে গেছে?”
২০১২ সালে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর হাওর উন্নয়নে ১৫৩টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
নেত্রকোণার হাওর এলাকা থেকে উঠে আসা মন্ত্রী জব্বার নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
“হাওর এলাকায় টেলিযোগাযোগ বিস্তৃতির জন্য মন্ত্রণালয়ে যে তহবিল বরাদ্দ হয়েছিল, তা কিভাবে ব্যয় করা হবে এ নিয়ে কোনো সভা করেনি মন্ত্রণালয়,” বলেন মন্ত্রী।
হাওরের পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, হাওরের পরিবেশ অপরিবর্তিত রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থা, মৎস্য ও প্রাণিস¤পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে নানা পরামর্শ দেন মোস্তাফা জব্বার।
হাওরের মিঠা পানির সদ্ব্যবহার, ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ আহরণ বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, কৃষি ব্যবস্থার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের পরামর্শও দেন তিনি।
নেত্রকোণার ধর্মপাশা থেকে গারো পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে হাওরের মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জ শহর অবধি একটি রেললাইন নির্মাণ করা গেলে তা পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেও মনে করেন মোস্তাফা জব্বার।
সভায় মূল প্রবন্ধে সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজের পরিচালক আনিসুল ইসলাম নিজেদের একটি গবেষণার ফলাফল থেকে পাওয়া হাওরের পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে বন্যায় হাওরের ফসল ভেসে গিয়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন ফসলের প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মিঠা পানির উৎসস্থলে যেখানে একসময় ৭০ থেকে ৮০ প্রজাতির প্রায় এক লাখ পরিযায়ী পাখি যেখানে আসত, সেখানে এখন প্রজাতির সংখ্যা নেমে এসেছে ৪০ হাজারে, পাখির সংখ্যাও নেমে এসেছে ৩৫ হাজারে।
একসময় হাওরাঞ্চল থেকে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও এখন ১৪১ প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে খা-া জমির সংখ্যা কমছে, হাকালুকি-টাক্সগুয়ার-বাইক্যা বিল থেকে হারাতে বসেছে ৩০ প্রজাতির উদ্ভিদ।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, হাওরে এখন ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। মাত্র ২৬ শতাংশ কৃষক এখন হাওরের ৬৫ ভাগ জমির মালিক।
আনিসুল ইসলাম বলেন, “বাকি ৭৪ শতাংশ কৃষক বর্ষা মৌসুম এরে বেকার হয়ে পড়েন। এই হার বাড়তে বাড়তে হাওরের কৃষক এখন পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন। কেউবা হাওর ছেড়েও চলে যাচ্ছেন।” হাওরের ২৯ শতাংশ তরুণ এখনও বেকার বলে জানান তিনি।
হাওর এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আনিসুল ইসলাম জানান, হাওরে শিক্ষার হার ৩৮ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭১ শতাংশ শিশু ভর্তি হলেও বছর ঘুরতেই ৪৪ শতাংশ শিশু ঝরে পড়ে।
সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের হার যেখানে ৯৪.৯ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সেই হার ৭৯.৯ শতাংশ।
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার চালচিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, হাওরে এর গড় হার ৪৪ শতাংশ, সর্বনি¤œ নেত্রকোণায় ৩৫ শতাংশ।
হাওরে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক সমস্যাও মেটেনি, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়নি।
আনিসুল ইসলাম পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাওর জরিপ নিয়েও অভিযোগ তোলেন।
তিনি বলেন, “এই জরিপে বলা হয়েছে, হাওরে কোনো দারিদ্র্য নেই। তাই বিশ্ব ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ফুড ব্যাংক যখন দরিদ্র এলাকার উন্নয়নে নানা তহবিল প্রদান করছে, তখন হাওর এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমরা ওদের বলতে গেলে বলছে, আমরা তো তোমাদের সরকারি পরিসংখ্যান ফলো করছি।
সভায় আলোচক হিসেবে যোগ দেন অক্সফাম বাংলাদেশের ইকোনমিক জাস্টিস অ্যান্ড রেজিলেন্স প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. খালিদ হোসেন। এছাড়া সভার আয়োজক দুটি সংস্থার কর্মকর্তারাও অংশ নেন।
আলোচকরা পরিবেশ আইন, জলবায়ু পরিবর্তন নীতিমালা ও প্রয়োগ পরিকল্পনা, জাতীয় পানি-মৎস্য-জলমহাল-ভূমি-কৃষি নীতি নিয়ে সমালোচনা করেন।
তারা বলেন, এসব নীতিতে ‘ফাঁকফোকড়’ থাকায় হাওরের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
হাওরের ইকোসিস্টেমের কথা মাথায় রেখে সরকারি ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানোর পরামর্শ দেন আলোচকরা। হাওরের ৯ লাখ ৬৭ হাজার জেলে পরিবারগুলোর আর্থিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় আনতে হবে বলে মনে করেন তারা। সে উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিশ্চিত করতে হবে নারীর অংশগ্রহণ।
গতবছরের এপ্রিলের শুরুতে আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায় হাওরের বোরো ফসল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এপ্রিল থেকে মে মাসে হাওরের ৬ জেলায় প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বোরো ফসলের ক্ষতি হয়।
বন্যা থেকে ফসল বাঁচাতে হাওরে নিমজ্জিত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা উঠে আসে আনিসুল ইসলামের প্রতিবেদনে।
তিনি বলেন, ১৮২৬ কিলোমিটার নিমজ্জিত বাঁধ ২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর আমন ধান রক্ষা করতে পারে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
হাওরের জীববৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখে জলমহাল নীতিমালার বেশকটি অধ্যাদেশ পরিবর্তনের দাবি আসে সভা থেকে। হাওরের কয়েকটি অঞ্চলকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করলেও অনেক স্থানে তা গড়ে না উঠেনি।
মৎস্যজীবীদের কথা ভেবে পাঁচ বছরের জন্য এই হাওরগুলোতে ১৫ শতাংশ এলাকা অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে বলে মত দেন আলোচকরা।
হাওরে মানবস¤পদ উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণের কথাও বলেন তারা। পাশাপাশি শিশু-মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো, পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার কথাও আসে।