ইকবাল কাগজী ::
‘[…] তাঁর চোখে, তাঁর হাতের ক্যামেরার চোখে সখের বশে যে সব ছবি তোলেছেন এই নিতান্ত সখের আলোকচিত্র সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষের জীবন প্রকৃতি এবং সংগ্রামের মহাকাব্য হয়ে উঠেছে।’ এই মন্তব্যটি করা হয়েছে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী প্রদর্শন করে। প্রদর্শনীটি কার, কোথায়, কখন হয়েছে? প্রদর্শনীটি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির লোকসংস্কৃতির সংগ্রহশালায়। গত ৩০ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রচারপাতায় লেখা হয়েছে, ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে সুনামগঞ্জের রূপ সৌন্দর্য প্রচারে “বিউটিফুল সুনামগঞ্জ” শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ॥ উদ্বোধক : ড. মোহাম্মদ সাদিক, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ॥ প্রদর্শনীতে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জনাব মো. সাবিরুল ইসলাম-এর তোলা ছবি প্রদর্শিত হবে।’
প্রদর্শনী সংক্রান্ত এই জ্ঞাতব্যের পর আরও একটি জরুরি জ্ঞাতব্য থেকে যায় যে, মন্তব্যটি কার। যেহেতু মন্তব্যটি দিয়ে প্রতিবেদনটির শুরু। মন্তব্যটি যে-কোনও একজনের তো বটেই। এই যে-কোনও একজন হলেন উক্ত প্রদর্শনীর উদ্বোধক, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। কিন্তু মন্তব্যটি কমিশনার সাদিকের নয় কবি সাদিকের, আমার অন্তত তাই মনে হয়। কারণ জগতে একমাত্র কবিই হলেন কবিদ। প্রদর্শনীটি দেখার পর মনে হলো, আলোকচিত্রী আপাদমস্তক একজন কবি। কবি না হলে কেউ এমন করে ছবি তোলতে পারেন না। কবিতা রচনা আর ছবি তোলা কখনও এক নয়। তা সকলেই জানি। কিন্তু এই প্রদর্শনীতে মোট ৯৭টি চিত্রের আলোছায়ার খেলায় যে চিত্রকল্প মূর্ত হয়ে উঠেছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই এক একটা নিরুপম কবিতা হয়ে উঠেছে। তা ৯৭টি চিত্রকবিতা মিলে একটা চিত্রমহাকাব্য তো হতেই পারে। কেউ যদি এই ছবিগুলোর নিহিতার্থের একটি সাদামাটা বিবরণও তৈরি করেন, তবে তা ‘সুনাগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষের জীবন প্রকৃতি এবং সংগ্রামের মহাকাব্য’ হয়ে উঠবেই, তাতে বিচিত্র কী, বরং সেটাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য। কথা হলো সে মহাকাব্যটি রচনার জন্য আর একজন কবি চাই।
কী নেই ছবিগুলোতে? সুনামগঞ্জের সামগ্রিক সংস্কৃতির ছবিকাব্য এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যে-কেউ একটু মুক্তচিন্তার মনের চোখটি খোলে চাইলেই সহজেই এই সত্যকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। ছবিগুলোর কয়েকটির একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। যদিও সেটা হবে ছবিগুলোর যথার্থতাকে প্রকাশ করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র, এর বেশি কীছু নয়।
একটি ছবিতে এক কৃষক। খিল নৌকার ডরায় স্তূপ করা ধানের ছড়া। দূরে কালচে সবুজ গ্রাম, নীলচে পাহাড়, পাহাড়ের মাথার উপর সাদা আকাশ। নৌকার ডরায় স্তূপীকৃত ধানের ছড়াগুলোর একটি আলাদা তাৎপর্য আছে। ধান কেটে কৃষক আঁটি বাঁধে। এখানে ধান আঁটি বাঁধা নয়। সুতরাং ধান ডুবে যাবার সময় কৃষক ডুবন্ত ধান কেটে তাৎক্ষণিক নৌকায় জমা করেছেন অথবা ধান ডুবে যাওয়ার পর আঁচড়া দিয়ে জলের নিচ থেকে ধানের ছড়াগুলো সংগ্রহ করেছেন, জলে ডোবার বেশ কীছুদিন পর ধানগাছ পচে গিয়ে আকশিতে জড়িয়ে আঁচড়ার টানে যখন ছিঁড়ে যাবার মতো নরম হয়েছে। অর্থাৎ ছবিটার একটি আলাদা ভাষা আছে। এটি সুনামগঞ্জে বন্যায় ফসলডুবি থেকে উদ্ভূত কৃষকের জীবনের নিদারুণ দুর্গতির কথা ব্যক্ত করে। এই ছবিটা কেবল ছবি নয়, সুনামগঞ্জের মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার অসাধারণ গল্প, প্রকৃতি ও মানুষের মিথষ্ক্রিয়ার কাহিনী। এর বাইরে এর রঙের রকমফেরের খেলা তো আছেই।
একটি ছবি : চারদিকে ঢোলকলমি আর জল থৈ থৈ। ঢেউ। দূরে গ্রামের সবুজ ছায়া। একলা একটি বাড়ি। বাড়ির চারপাশের ঢাল মাটিভরা বস্তা বিছিয়ে ঢেকে দিয়ে ভিটের মাটিটুকু আফালের ঢেউ থেকে রক্ষার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। ছবিটি দেখেই মনে হয় বাড়িটি ভয়ে ভয়ে আছে। তার ভয় হাওরকে, হাওরের জলকে, জলের ঢেউকে, সর্বনাশা আফালকে। কবিতা আর কাকে বলে। জীবনের কবিতা তো লেখা আছে এই ছোট্ট ছবিটিতেই।
ছবিগুলোর বহর ফারে যদি হয় ১০ ইঞ্চি তবে দীর্ঘে ১৫ ইঞ্চি তো হবেই, অনুমান করছি। মাপটা কমবেশিও হতে পারে। এই মাপেরই আর একটি ছবি : লাল জল, মাঝি ও ১০/১২ জনের মতো লোকে বুঝাই নৌকা, জলের পরে কলো গ্রাম, গ্রামের মাথার উপরে লাল আকাশ, লাল আকাশের মাঝে হালকা হলুদ ও গাঢ় লালের ছোপের আল্পনা।
কিংবা অন্য একটি ছবি : জল, জলে গাছের সরি, তার পেছনে সবুজনীল পাহাড়, ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ, সে-আকাশে মাঝে মাঝে নীলের ছোপ। এই ছবিটি কোন্ স্থানের জানি না। তবে ছবিটি দেখে টাঙ্গুয়ার কথা মনে পড়ছে খুব। টাঙ্গুয়ার সঙ্গে পাহাড়ের একটা সম্পর্ক আছে। কবিতার মধ্যে কবি যে-অর্থ ভরে দেন সে-অর্থের অতিরিক্ত কোনও অর্থ যখন কবিতার পাঠকের কাছে ধরা দেয়, তখনই কবিতাটি আর কবির কবিতা থাকে না পাঠকের হয়ে ওঠে এবং এই করে কবিতাটি পায় সার্থকতার মর্যাদা। এই ছবিটিও আলোকচিত্রীর ছবি থাকে না দেখতে দেখতে ছবিটি দর্শকের তোলা ছবি হয়ে উঠে। ক্যামেরায় তোলা ছবিকে তো এমনই সার্থক ছবি হতে হবে। তবেই তো তাকে বলবো ছবি তোলা, ছবি তোলনেওয়ালাকে বলবো আলোকচিত্রী।
বলছিলাম ছবিগুলোতে কী নেই। আসলে আছে সবকীছুই। তাই বর্ণনা দিতে গেলে সত্যিসত্যি একটা মহাভারত রচিত হয়ে যাবে। যে-কয়টা দিয়েছি, আপাতত তাতেই হবে বোধ করি। ছবিগুলোর কোনওটিরই নামকরণ করা হয়নি। সময় এবং স্থানের উল্লেখ নেই। দিনের সময় ও আকাশের রঙবদলের সঙ্গে ছবির রঙ বদলে যায়, বদলে যায় ছবির ভাষা, ছবির বক্তব্য। ছবি ছাপতে না পারলে ছবিকে কীভাবে পাঠকের কাছে হাজির করতে পারা যায়। বাক্যের কেরদারিসমা দেখিয়ে যেভাবেই বর্ণনা করি না কেন সেটা যে শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তারপরও না পারতে কয়েকটি ছবিকে উল্লেখ করতেই হচ্ছে, যৎকিঞ্চিৎ ধারণা দেওয়ার আশায় : অসীম নীলাকাশে একা একটি চিল, মুখোমুখি দুইটি পাখির বিশ্রম্ভালাপ, জেলেরা জোড়ানৌকা দিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, একজন জলের উপর টং বেঁধে বড়শিতে মাছ ধরছে, নদীর পাড়ে ভাঙন কবলিত বাড়ির পিছনের চিলতে আঙিনায় পরিত্যক্ত নিরাপদ পাটাতনে বসা গ্রাম্যবধূর ছোট মেয়েটি তাঁর উঁকুন বেছে দিচ্ছে, নদীর ভয়ংকর ভাঙনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক নিঃসঙ্গ পথিক, একটি চৈত্রের খরায় ফাটা চৌচির মাঠে একাকী একটি বৃক্ষের ওপাশে সবুজ গ্রাম, কোথাও সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় হচ্ছে ইত্যাদি। প্রত্যেকটি ছবিতে আলো ও রঙয়ের যে-অসামান্য সমাবেশ ঘটেছে তার কোনও তুলনা নেই। হরেকরকম ও মাত্রার এই আলো ও রঙ বিভিন্ন অনুপাতে মিলেমিশে দর্শকের মনে কাব্যপাঠের আসর শুরু করে দেয়। সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
আমি খুব বেশি একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী মনোযোগ দিয়ে কখনও দেখিনি। এবারই প্রথম এতো বেশি সময় নিয়ে দেখলাম। মনে হলো, কই নিজ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কীছু তো ভাবতে হচ্ছে না, ভাবনা তো এমনি এমনিই এসে ভিড় করছে মনের অলিন্দে। ছবি তো কথা কইছে মনের সঙ্গে। মনে হচ্ছে যে-ছবি মনের সঙ্গে কথা কইতে জানে না সেটা কোনও ছবি নয়। এই ছবিগুলো সুনামগঞ্জের কাব্যপাঠ করা শুরু করে দিয়েছে শুরু থেকেই।
ছবিগুলোর ফাঁকফোঁকড়ে আছে জীবন, জীবিকা, জীবনের সংগ্রাম, জীবনের ও প্রকৃতির নানা রঙের খেলা। হাওর, আকাশ, পাহাড়, বৃক্ষ, সূর্য, মানুষের মিথষ্ক্রিয়ার রসায়ন; প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হয়ে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে তার কথকতা। আসলে জগৎটা দিনের প্রতিটি প্রহরে আকাশের রঙ বদলের সঙ্গে মাটির প্রকৃতির রঙবদলের একটা অপরূপ খেলাঘর। এই খেলাঘরই জীবনের নাট্যমঞ্চ। এই ছবিগুলো সে-খেলাঘরের কথকতার কাব্য।
লেখক: কবি, গবেষক ও সাংবাদিক।