অনলাইন ডেক্স:
বিস্মৃতির কোন অতলে হারিয়ে গিয়েছিল গানটি! ইংল্যান্ডের পাগলপারা সমর্থকরাও তা আর সেভাবে গায় না অনেক দিন। সপ্তাহ দুয়েক আগ পর্যন্ত রাশিয়ার শহরে শহরে, রাস্তা-মেট্রো-গ্যালারিতে শোনা যায়নি তা উচ্চস্বরে।
কিন্তু ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ অভিযাত্রা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে গানটির সুরও চড়ছিল ক্রমশ—‘ফুটবল ইজ কামিং হোম’।
নাহ, বিশ্বকাপ ট্রফির আর ফেরা হলো না ফুটবলের জন্মস্থানে। কাল সেমিফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ১-২ গোলে হেরে মৃত্যু হলো ইংল্যান্ডের স্বপ্নের। আর ক্রোয়াট স্বপ্নে লাগল হাজারো রং। প্রথমবারের মতো যে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলবে তারা! ১৫ জুলাইয়ের সেই চূড়ান্ত মহারণে ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ ফ্রান্স।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ক্রোয়েশিয়া প্রথম বিশ্বকাপ খেলে ১৯৯৮ সালে। সবাইকে চমকে উঠে যায় সেমিফাইনালে। সেই অর্জন ছাড়িয়ে গেল তারা কাল। এ স্বপ্নপূরণ করা গোলটি অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে।
ম্যাচের ১০৯তম মিনিটে। ইভান পেরিশিচের হেডে বল যায় মারিও মান্দজুকিচের কাছে। মার্কার জন স্টোনস যেন ঘুমিয়ে ছিলেন। দারুণ প্রতিক্রিয়ায় মাটি কামড়ানো শটে বল জালে পাঠিয়ে দেন এই ফরোয়ার্ড। যা ইংল্যান্ডকে পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে আর ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে যায় ফাইনালে।
এই অতিরিক্ত সময়ে এর আগেও গোলের কাছাকাছি গিয়েছিল দুই দল। ৯৯তম মিনিটে কিয়েরান ট্রিপিয়েরের কর্নারে দারুণ হেড স্টোনসের।
বারপোস্টের ওপরের বাঁ দিকের কোণ দিয়ে তা চলে যাচ্ছিল জালের দিকে। গোললাইনে দাঁড়িয়ে হেড করে নিশ্চিত গোল বাঁচান ক্রোয়াট ডিফেন্ডার ভারসালিকো। আর এই অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে পেরিশিচের ক্রসে মারিও মান্দজুকিচের ছোঁয়াও গোলে রূপান্তরিত প্রায়। ইংল্যান্ড গোলরক্ষক কোনোক্রমে ঠেকান তা। মান্দজুকিচের গোলের সময় তা আর পারেননি।
দুই সেমিফাইনালের মধ্যে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দ্বৈরথটিকেই ধরা হচ্ছিল ফাইনালের আগের ফাইনাল। তবে সেন্ট পিটার্সবার্গের গ্যালারির উত্তেজনা-উন্মাদনা এর সঙ্গে মানানসই ছিল না ঠিক। কাল ইংল্যান্ড-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে গ্যালারির লড়াইয়ে অন্তত বিপুুল ব্যবধানে জিতে গেছে মস্কোর লুঝনিকি। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী খেপাটে সমর্থকরা তো ছিলই। লাল-সাদা দাবা বোর্ডের ক্রোয়াট সমর্থকদের উচ্ছ্বাসেরও কমতি ছিল না।
মাঠের ফুটবলে অবশ্য নিজেদের ট্রেডমার্ক জার্সি পরেনি ক্রোয়েশিয়া। অচেনা কালো জার্সিতে প্রথমার্ধে অচেনা ছিল তাদের পারফরম্যান্সও। ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে ইংল্যান্ডের গোল পেয়ে যাওয়াও এর একটি কারণ। সে গোলদাতাও কে? কিয়েরান ট্রিপিয়ের। জাতীয় দলের জার্সিতে ক্যারিয়ারের প্রথম গোলেই দুই কিংবদন্তি ববি চার্লটন ও গ্যারি লিনেকারের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি এই ডিফেন্ডার। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে গোল করা তৃতীয় ইংরেজ হয়ে গেছেন যে ট্রিপিয়ের! কী অসাধারণ সেই গোল! ডেলে আলিকে লুকা মডরিচ ফাউল করলে ইংল্যান্ড ফ্রি কিক পায় বক্সের ঠিক বাইরে। দেয়ালের ওপর দিয়ে বল ভাসিয়ে ক্রোয়াট গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচের বাঁ দিক দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেন ট্রিপিয়ের। চলতি বিশ্বকাপে এটি ইংল্যান্ডের ১২তম গোল; এর মধ্যে নবম গোল হলো ডেড বল সিচুয়েশন থেকে—ফ্রি কিক, কর্নার, পেনাল্টির উৎস মিলিয়ে।
শুরুতে গোল দিয়ে উজ্জীবিত ইংল্যান্ড আর গোল খেয়ে ঝিমিয়ে পড়ার দশা ক্রোয়েশিয়ার। তাতে করে প্রথমার্ধে লিড দ্বিগুণ করার বেশ কয়েকটি সুযোগ পায় গ্যারেথ সাউথগেটের দল। এর মধ্যে ৩০তম মিনিটে হ্যারি কেইনের মিসটি দৃষ্টিকটু। জেসে লিনগার্ডের চমৎকার থ্রুতে ক্রোয়াট গোলরক্ষককে একা পেয়ে যান; কিন্তু তাঁর শট ফিরিয়ে দেন সুবাসিচ। ফিরতি বলও গিয়ে পড়ে ইংল্যান্ড অধিনায়কের কাছে। এবার বারে মেরে দেন কেইন। মিনিট পাঁচেক পর স্কোরকার্ডে নাম তোলার সুযোগ আসে লিনগার্ডের সামনেও। প্রতি আক্রমণে কেইনের পাসে বিপজ্জনক জায়গায় বল পান ডেলে আলি। তাঁর কাটব্যাকে বক্সের মাথায় লিনগার্ড একেবারে ফাঁকায়। সময় নিয়ে, লক্ষ্য স্থির করে বল পাঠাতে পারতেন প্রার্থিত ঠিকানায়। পারেননি; পোস্টের বাইরে চলে যায় বল।
বিচ্ছিন্ন কিছু সুযোগ ক্রোয়েশিয়াও পায়। একবার ডানপ্রান্ত থেকে আন্তে রেবিচের ক্রসে যেমন দারুণ ইন্টারসেপশন জন স্টোনসের। আরেকবার বাঁ দিক থেকে আসা ক্রসে দ্বিতীয় পোস্টে ওৎ পেতে থাকা রেবিচের পায়ের ডগা থেকে বল ক্লিয়ার করেন অ্যাশলে ইয়াং। আরেকবার ইভান রাকিটিচ উড়ে আসা বলে প্রথম টাচটি দারুণ নিয়েও শট নিতে দেরি করে ফেলেন। তবু প্রথমার্ধ এগিয়ে থাকার স্বস্তি নিয়েই শেষ করে ইংল্যান্ড। ইতিহাসের পক্ষপাতও তখন তাদের দিকে। সব শেষ ১৮টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মধ্যে প্রথমার্ধ এগিয়ে থেকে শেষ করা দল হেরেছে কেবল একবার। ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে ইতালির সেই পরাজয় টাইব্রেকারে।
নকআউট পর্বের আগের দুটো ম্যাচই টাইব্রেকারে জিতেছে ক্রোয়েশিয়া। মানসিক ধকল তো রয়েছেই, শারীরিক ক্লান্তিও কম নয়। তার ওপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুরুতে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়া। ক্রমশ মিইয়ে আসা পারফরম্যান্সে মনে হচ্ছিল ক্রোয়াটরা বুঝি আর পারবে না। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে কী প্রবল দাপুটে প্রত্যাবর্তনই না তাদের! সেটি কেবল সমতা ফেরানো গোলের কারণে নয়, আরো বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরি করার কারণেও। ভাগ্য পক্ষে থাকলে ৯০ মিনিটেই তো জিতে যেতে পারত ক্রোয়েশিয়া।
সমতা ফেরানো গোলটি ৬৮তম মিনিটের। ডান দিক থেকে সাইমে ফ্রাসাইয়াকো অসাধারণ ক্রস হেড করে ক্লিয়ার করতে চান কাইল ওয়াকার। লাফিয়ে ওঠা ইভান পেরিশিচ এই ইংলিশ ডিফেন্ডারের মাথার ওপর থেকে বুটের ফ্লিকে দারুণ ফিনিশিংয়ে বল পাঠিয়ে দেন জালে। মিনিট তিনেক পর পেরিশিচের বাঁ পায়ের শটে গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড পরাস্ত; ইংল্যান্ডের ত্রাতা হয় পোস্ট। ওখানে লেগে আসা ফিরতি বলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে না পারার দোষে দুষ্ট অবশ্য আন্তে রেবিচ। আর ৮৪তম মিনিটে পিকফোর্ডের দুর্বল ক্লিয়ারেন্সে আবার বক্সে বল পেয়ে যান পেরিশিচ। তাঁর শট যায় বার উঁচিয়ে। অন্য কোনো দিনে হ্যাটট্রিকও হয়ে যেতে পারত এই উইঙ্গারের।
কোণঠাসা ইংল্যান্ড নির্ধারিত সময়ের শেষ ১৫ মিনিটে বেরোয় খোলস ছেড়ে। রহিম স্টার্লিংয়ের বদলে মার্কাস রাশফোর্ড নামার পর গতি বাড়ে খেলায়। ক্রোয়েশিয়াও ততক্ষণে অনুপ্রেরণায় টগবগিয়ে ফুটছে। ফলে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে জমে ওঠে খেলা। ইংল্যান্ড হাফ চান্স পেয়েছে বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে ভালো সুযোগ পান হয়তো অধিনায়ক কেইন। কিন্তু ইনজুরি সময়ে ফ্রি কিকে বলে মাথা লাগাতে পারেন না ঠিকভাবে। খেলা তাই অবধারিতভাবে গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে।
সেখানেই ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল রূপকথার সবচেয়ে আনন্দময় গল্পটি লেখেন মারিও মান্দজুকিচ। আর আরো একবার হতাশার আগুনে পুড়তে হয় ইংল্যান্ডকে। তাদের সমর্থকদের ‘ফুটবল ইজ কামিং হোম’ গানটিও গেল থেমে। কান্নায়। বেদনায়।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ।