রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু
১৯৭১ সালের শেষের দিকে একটি জাতির উপর বর্বোরচিত হামলা হচ্ছে। ঘরবাড়ি নির্বিচারে জ্বালিয়ে বেশুমার মানুষ মারছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ঘটছে ঘনধর্ষণ ও গণহত্যার ঘটনা। এমনি চিত্র পত্রিকায় দেখে শিউরে উঠি। নির্যাতিত সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশ কোথায়-কিভাবে যেতে হয় আমি তা জানি না। মনে মনে সংকল্প করি লেখনির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করব।
আমার এই চিন্তার মধ্যেই আবার আমেরিকার নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদমহ বুদ্ধি দিয়েও সাহায্য করছে। আমেরিকার এই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ শুরু করেছিলাম। আমি পুরোপুরিভাবে আমাদের আমেরিকা সরকারের এই নীতির বিরোধতা করি। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর স্মৃতিচারণ করছিলেন বিশিষ্ট লেখক মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রবাসী বন্ধু স্যালি উইলোবি। স্মৃতির ঝাপি খুলে তিনি একাত্তরের নানা ঘটনার বর্ণণা করছিলেন। তার চোখে মুখে উদ্বেগ।
আমেরিকার ম্যারিল্যান্ডের বাল্টিমোরে জন্ম নেয়া উইলোবি ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকার সাগরের পাশে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ দেখতে পান। তখন তিনি তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ খবর সংগ্রহ করে জানতে পারেন অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আমেরিকার নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানকে সরবরাহ করছিল, যা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের নীরিহ মানুষকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল। উইলোবি তখন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ছোট একটা দল গড়ে তুলেন। যার নাম দিয়েছিলেন ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ এন্ড মুভমেন্ট ফর নিউ সোসাইটি। সেদিনের বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানানো সংগঠন সম্পর্কে উইলোবি বলেন, আমরা এই দল গঠন করে সিদ্ধান্ত নেই আমরা আমাদের সরকারকে সাবেক পশ্চিমা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিরত করবো। তখন পাকিস্তান থেকে আগত শূন্যে জাহাজে ত্রাণ সামগ্রীর সাথে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হতো। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ বাল্টিমোর বন্দরে এসে পৌঁছুনোর সাথে সাথেই আমরা ছোট ছোট ডিঙ্গি (নৌকা) দিয়ে ঘিরে ধরে বাধার সৃষ্টি করি। আমি তখন কিছুটা অনুভব করতে পারলাম এই ডিঙ্গিতে আমার মৃত্যুও ঘটতে পারে। পুলিশের ডিঙ্গিগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের ঠিকে থাকাও কঠিন ছিল। কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের ডিঙ্গিগুলো আমাদের একেবারে কোনঠাসা করে ফেরে। আমাদের ১৭/১৮টি ডিঙ্গি নৌকাকে ঘিরে ফেলে পুলিশের প্রায় দুইশত ডিঙ্গি। এক পর্যায়ে আমাদের আটক করে জেলে নিয়ে যায়। সারারাত জেলে রেখে পরদিন কোর্টে চালান করে। কোর্টের জজ ভাল থাকায় আমাদের প্রতি সদয় হন এবং আমরা মুক্তি পাই। আমাদের পুরো দলটি লংশোরম্যানস ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে। উল্লেখ্য আমারেকিাতে ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী। দীর্ঘ আলোচনার পর ইউনিয়নের শ্রমিকরা পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য অস্ত্র সমেত মালামাল জাহাজে তুলতে ও নামাতে অস্বীকার করেন। ফলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয় লাভ করি। অস্ত্র সরবরাহের পথ বন্ধ করে সরকার। এভাবেই আমেরিকা কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে নীরিহ মানুষের উপর সামরিক হামলায় ব্যবহৃত বিরাট অস্ত্রের চালান আটকে দেই আমরা।
আমরা প্রাথমিকভাবে অস্ত্র সরবরাহের পথ বন্ধ করে নিক্সন প্রশাসনের ঘুম হারাম করে ফেলি। সাময়িক এই বিজয়ের পর আমরা আরো কিছু কর্মসূচির কথা ভাবতে থাকি। কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের পাশে থাকা যায়, তাদের সহযোগিতা করা যায়। উইলোবি বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নেই ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে প্রতীকী অনশন করবো। আমরা হোয়াইট হাউসের আশেপাশে ক্যাম্প তৈরি করে লিফলেট বিলি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। এভাবে অনেক মানুষের সহযোগিতা পাই আমরা।
উইলোবি বলেন, আমি যখন কিশোরী, কিছুটা বুঝতে শেখেছি তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তখন থেকেই আমি বিশ্বেও যে কোন নিরীহ জাতির উপর অন্যায় দেখলে প্রতিবাদের চেষ্টা করি। চুপ থাকতে পারি না। প্রতিবাদী হয়ে উঠি। উইলোবি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ২৪ বছর ছিল। টগবগে যৌবনে অনেক উম্মাদনা থাকে। তাই মৃত্যুর পরোয়ানা কাাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানীদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের জাহাজ বাল্টিমোরে যুদ্ধ জাহাজ আটকে দিয়েছিলাম। আমার জীবনের এটি একটি বিরট ঘটনা।
বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর কখনো সেখানে ভ্রমণ করেছেন কি না এমন প্রশ্রেন উত্তরে বলেন, ২০১১ সালে আমাকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালে আমি সেখানে যাই। বাংলাদেশের বন্ধুদের আথিয়েতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা খুবই ভালো। তাঁর বাবা দেশের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন অথচ তাঁকেই মেরে ফেলা হলো। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জার।
বাংলাদেশের নানা প্রশংসা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে এতো সুন্দর একটি দেশ তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। সত্যি আমি আনন্দিত আমি অবিভূতত।
স্যালি ইউলোবি ম্যারিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনথ্রোপলোজিতে মাস্টার্স করে স্বাধীনভাবে আর্টিস্ট পেশাকে বেঁচে নেন। বিশেষ হাতের কাজ করেন বেশি। কাঠ দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী ও আসবাবপত্র তৈরি করে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কলেজে পড়া অবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এখনো মানুষের পক্ষে তার অবস্থান স্পষ্ট রয়েছে।
##
আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক রণেন্দ্র তালুকদার পিংকুর ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বন্ধু’ শিরোনামে প্রবাসী বন্ধুদের নিয়মিত লিখবেন হাওরটুয়েন্টিফোরডটনেটে। আজ প্রকাশ হলো স্যালি উইলোবিকে নিয়ে।